সম্পাদকের কথা : আমরা কৃতজ্ঞ। কারণ এই বৈশ্বিক মহামারীতে আল্লাহতায়ালা আমাদের দুজনকেই সম্মুখসারী থেকে সরাসরি করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা করার সুযোগ করে দিয়েছেন। ফলে মহামারীর সার্বিক আবছায়া চিত্রটিকে জুম করে কাছ থেকে দেখার সুযোগটি আমরা পাচ্ছি। একদিকে তীব্র শ্বাসের কষ্ট নিয়ে আমাদের সব প্রচেষ্টা বিফল করে কারো চলে যাবার বেদনাটি আমাদের যেমন স্পর্শ করেছে, আবার কেউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার ক্ষণটিতেও আমাদের চোখে আনন্দ খেলেছে৷ ডিউটি সেরে ক্লান্ত হয়ে ফেরার সময় দেখি বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্যবিধির কোনো তোয়াক্কা করছেন না। দল বেঁধে মানুষ রাস্তায়। অর্ধেকের মাস্ক নেই। যাদের আছে, নাক-মুখ না ঢেকে থুতনির সৌন্দর্যবর্ধনের কাজে ব্যস্ত সে মাস্ক। অন্যদিকে ফেইসবুকে নানা ভুল তথ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে, মেসেজে মানুষের শত শত প্রশ্ন– “এটা হলে কী করব? ওটা হলে কোথায় যাবো? উনি যে সেটা শেয়ার করেছেন?” তাদের দোষ দেওয়া যায় না। এমন রোগ তো পৃথিবী আগে কখনও দেখেনি৷ যেখানে সারাবিশ্বের চিকিৎসা-বিজ্ঞানীরাই নতুন নতুন বিষয় নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন সেখানে জনসাধারণের দ্বন্দ্বে ভোগাই স্বাভাবিক। বইটি লেখার পেছনে মূলত দুটো প্রেরণা কাজ করেছে। মানুষ জানতে চায় তার জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো, যা তার প্রতিদিনের জীবনে কাজে লাগবে, যা দিয়ে তিনি সরাসরি উপকৃত হবেন৷ কিন্তু ‘কিতাবি’ ভাষায় উপদেশ দিলে অনেকেই সেটির প্রতি আগ্রহ হারান। সুতরাং এমন এক ধাঁচে লিখতে হবে যেন তিনি লেখাগুলো ‘ঔন’ করেন, যিনি তাকে তথ্যগুলো জানাচ্ছেন তাকে আপন ভাবেন৷ জনসাধারণের অনেক অনেক প্রশ্নের উত্তর একসাথে দিতে পারবে আবার নতুন করে কিছু বিষয়ে ভাবতে শেখাবে এমন কোনো বই বাংলা ভাষায় আমাদের চোখে পড়েনি। এই অভাবটির জায়গা আমরা আনাড়ি হাতে কিছুটা পূরণের চেষ্টা করেছি। আমরা এখনও বিশ্বাস করি সচেতনতাই পারে এই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের প্রধান হাতিয়ার হতে৷ আর সচেতনতা আসবে জ্ঞান থেকে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি কোনো অর্থেই গৌণ নয়। কত কত পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম মানুষ এ মহামারীতে কাজ হারিয়েছেন, কত কত মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছন৷ মানুষের কষ্টের কোনো শেষ নেই। অনেকে পারেন না ভিক্ষা করেন৷ আবার কত মানুষ বুকে-পেটে জগদ্দল পাথর নিয়েও কাউকে একটু সাহায্যের কথা মুখ ফুটে বলতে পারেন না তীক্ষ্ণ আত্মসম্মানবোধের কারণে৷ এ মানুষগুলোর পাশে কে দাঁড়াবে? আমরা যারা দিনে তিন বেলা পরিবার নিয়ে অনায়াসে খেতে পারি তাদেরই তো দাঁড়ানো উচিত। এই বইটি থেকে প্রাপ্ত অর্থ আমরা এই মহামারীতে অভাবে থাকা মানুষদের জন্য বরাদ্দ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের এই উদ্যোগে ‘ভূমিপ্রকাশ’-কে সাথী হিসেবে পেয়ে আমরা যারপরনাই কৃতজ্ঞ এবং আনন্দিত। এ বইটিকে দুটো প্রান্ত থেকে আমরা সামনে টেনে নেবার চেষ্টা করেছি৷ একদিকে আমি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, WHO, CDC, NHS, Harvard, UNICEF, BBF-এর মতো নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত তথ্য-জ্ঞান থেকে সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে সচরাচর মনে ঘুরপাক খেতে থাকা প্রশ্নগুলোর সহজ করে উত্তর দিয়েছি। অন্যদিকে রাইয়িক বিশ্বনন্দিত বিভিন্ন জার্নাল যেমন : Emergency Medicine Journal, The Lancet, Journal of American Medical Association, New England Journal of Medicine, Journal of Clinical Virology, British Medical Journal, Annals of Emergency Medicine ঘেঁটে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন নতুন অজানা কিন্তু জানা উচিত এমন সব বিষয় তুলে ধরেছেন। একদিকে তা জনসাধারণের আগ্রহ যেমন মেটাবে অন্যদিকে বিজ্ঞ পাঠকদের ভাবনার নানা খোরাক দেবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
প্রিয় পাঠক, প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো নতুন তথ্য আসছে। কিছু ধারণা বদলে যাচ্ছে৷ হয়তো আরো নতুন তথ্য আসবে। অনেক সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মতামতেরও হেরফের হয়। আমরা চেষ্টা করেছি সবশেষ নির্ভরযোগ্য তথ্যগুলোই আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আপনাদের সামনে উপস্থাপনের জন্যে। নতুন তথ্য এলে তাকে সাদরে বরণ করে নেবেন সেটিই কাম্য। তবে অবশ্যই বিশ্বস্ত উৎস থেকেই সেটি নেবেন। এ বইটি যখন আপনি পড়বেন তখন দুটো বিষয় ভাববেন। আপনি বইটি কিনেছেন যে অর্থটি ব্যয় করে তা হয়তো আজ কাউকে শুধু লবণ-ভাত খাওয়ার বদলে বড়ো মাছ না হোক অন্তত ডিম ভাজা দিয়ে ভাত খাবার সুযোগ করে দিয়েছে। হয়তো আপনার আশেপাশেরই কোনো মাকে তার শিশুর ক্ষুধার্ত মায়াময় মুখটা অসহায়ের মতো আজ রাতে দেখতে হচ্ছে না, শিশুটি ভালোভাবে খেয়ে ঘুমিয়েছে। হয়তো আপনার এই অর্থের সাথে আরও অনেকের অর্থ মিলে কোনো নিম্ন-মধ্যবিত্ত চাকুরিচ্যুত নিরুপায় বাবার আয়ের একটা ব্যবস্থা হয়েছে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি ভাববেন, দুজন চিকিৎসক আপনার এবং আপনার পরিবার সুস্থ থাকার জন্যে আপনাকে ভালোবেসে কিছু কথা বলছেন। যা মেনে চললে আপনি উপকৃত হবেন। আপনি যা জানলেন তা অপরকে জানান।