"অসহযোগ আন্দোলন ৭১ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৭১-এর অসহযােগ আন্দোলন ছিলাে সুস্পষ্ট দিক চিহ্নবাহী এক স্বর্ণময় অধ্যায়। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতি এই প্রথমবারের মতাে সুকঠিন একতায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়াজ তুলেছিলাে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। মুক্তিপাগল নিরস্ত্র মানুষ নির্দ্বিধায় নিঃশঙ্কচিত্তে সেদিন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলাে। প্রাণ দিয়েছিলাে অকাতরে। রক্তের বন্যায় ভেসেছিলাে রাজপথ-জনপদ। প্রতিবাদ জানাতে পথে নেমেছিলাে স্কুল-কলেজের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সরকারি-বেসরকারি-স্বায়ত্ব শাসিত প্রতিষ্ঠানের আমলা-কেরানি। পথে নেমেছিলাে ঠেলাওয়ালা-রিকসাওয়ালা, মাঠের কৃষাণ, নাওয়ের মাঝি, পত্রিকার হকার, প্রেস শ্রমিক, বন্দর শ্রমিক, ডাক্তার-নার্স, শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-রাজনীতিক-আইনজীবীবুদ্ধিজীবী আর ছাত্র। রাজপথ মুখর করেছিলাে হাজারাে শিশু-কিশাের আর নারী সমাজ। আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম ঘােষণা করেছিলাে বসন্ত রােগাক্রান্ত রােগী, অন্ধ-এতিম আর কারারুদ্ধ বন্দী। হাইকোর্ট, জজকোর্ট, স্কুল কলেজবিশ্ববিদ্যালয় সরকারি-বেসরকারি অফিস, কলকারখানা, যানবাহন ছিলাে বন্ধ। রেডিও- টেলিভিশনের শিল্পী-কর্মীরাও বেয়নেট-বন্দুক উপেক্ষা করে স্টেশন ছেড়ে পথে নেমেছিলাে। মানুষ মার্শাল ল' অগ্রাহ্য করলাে। আর এই উত্তাল আন্দোলনের অবিসাংবাদিত নেতা ছিলেন শতাব্দির শ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক, মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নির্দেশে ব্যাঙ্ক লেনদেন করেছে, বেতন দিয়েছে, দেশ চলেছে। মার্চের অসহযােগ আন্দোলনের এই বিশালত্ব, সমাজের সকল শ্রেণি ও স্তরের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, আন্দোলনের গতি প্রকৃতি ও তার ক্রমবিকাশের নির্ভরযােগ্য রােজনামচা বর্তমান গ্রন্থ। বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস নির্মাণে, ঘটনা বিশ্লেষণে অনুসন্ধিৎসু গবেষক-পাঠকদের কাছে এ-গ্রন্থ একটি প্রামাণিক দলিল হিসেবেই প্রমাণিত হবে। এই কালিক ইতিহাসপঞ্জি নির্মাণে অনুমান-আবেগ নয় বরং আদি-অন্ত সমকালীন পত্র-পত্রিকা ব্যবহার করে সম্পূর্ণ নিরাবেগ নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে নৈর্ব্যক্তিকতায় পৌছানাের সযত্ন প্রয়াস লক্ষ্য করা যাবে। নানা কৌণিক বিচারে গ্রন্থটির গুরুত্ব অপরিসীম।
ড. সুকুমার বিশ্বাসের জন্ম ১৯৪৫ সালে। ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পােস্ট ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করেন। কিন্তু এখানেই গবেষকদের গবেষক’ নামে খ্যাত ড. বিশ্বাসের গবেষণাকার্য শেষ হয় না। পরবর্তীকালে জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে ইনস্টিটিউট অব ডেভলপিং ইকনমিজ-এ ফেলাে হিসেবে এবং হিরােশিমা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। এ ছাড়া টোকিয়াে ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজ-এ ওরাল হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশন নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমীতে বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন দীর্ঘ তিরিশ বছর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তন্নিষ্ঠ গবেষণার পাশাপাশি উভয় বাংলায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রামাণ্য ইতিহাস রচনাও তার অন্যতম কৃতিত্ব। ড. বিশ্বাসের উল্লেখযােগ্য গ্রন্থগুলি হল : বাংলাদেশের নাট্যচর্চা ও নাটকের ধারা ১৯৪৭-১৯৭১, অসহযােগ আন্দোলন '৭১ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মুক্তিযুদ্ধে রাইফেলস ও অন্যান্য বাহিনী, একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সিপিআইএম ও গণশক্তি, Communal Riots in Bangladesh and West Bengal 1947-1964, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আগরতলা ত্রিপুরা : দলিলপত্র, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১: নারী, প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশগ্রহণকারীর বিবরণ।