প্যারিস, অক্টোবর ১৫, ১৯১৭ ভোর প্রায় ৫টা। আঠারো জনের একটি দল প্রায় নিঃশব্দে উঠে এলো প্যারিসের নারী কারাগার সেন্ট ল্যাজারের দ্বিতীয় তলায়। দলটির বেশিরভাগই ফরাসি আর্মির অফিসার। টর্চহাতে একজন ওয়ার্ডার তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা এসে থামলেন ১২ নম্বর সেলের সামনে। কয়েকজন নান সেখানে জেলখানার দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। সিস্টার লিওনিদ সেলের দরজা খুলে দিলেন। তারপর নিজে ভেতরে ঢুকে অন্য সবাইকে বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন। ভেতরে ঢুেক তিনি দেয়ালে ম্যাচকাঠি ঠুেক ভেতরের আলো জে¡েল দিলেন। অন্য সিস্টারদেরকেও কাছে ডাকলেন সাহায্য করার জন্য। যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে সিস্টার লিওনিদ ঘুমিয়ে থাকা এক নারীর শরীর একটা ভাঁজ করা কাপড় দিয়ে জড়িয়ে দিলেন। যদিও ঘুম ভাঙার পর সবকিছুতেই বীতশ্রদ্ধ নারীটি ধীরে ধীরে জেগে ওঠার চেষ্টা করছিলেন। একসময় তিনি জেগে উঠলেন। মনে হচ্ছিল, তিনি এতক্ষণ একটা শাšিরÍ আবহের মধ্যে মগ্নছিলেন। কিন্তুতিনি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলেন যখন জানতে পারলেন, ক্ষমা প্রার্থনা করে প্রজাতন্ত্রের মহামান্য প্রেসিডেন্টের কাছে তিনি যে প্রাণভিক্ষার আবেদনপত্রটি পাঠিয়েছিলেন, তা নাকচ হয়ে গেছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, তিনি গভীরভাবে দুঃখ পেয়েছেন এবং সবকিছুথেকে অব্যাহতি পাওয়ার একেবারে শেষ প্রান্তেপৌঁছে গেছেন। তার যেন আর কিছুই করার ছিল না। ভেতর থেকে সিস্টার লিওনিদের সংকেত পেয়ে ক্যাপ্টেন বুচারডন ও বন্দিনীর উকিল মাতির ক্লানেটকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন ফাদার আরবক্স। কাছে এলে বন্দিনী তার উকিলের হাতে সপ্তাহখানেক ধরে লেখা একটা লম্বা চিঠি এবং বিভিন্নরিপোর্টের ক্লিপিংসহ দুটা ম্যানিলা খাম তুলে দিলেন। নানা ঘটনার পারম্পর্যহীনতার মধ্যেই সবকিছুঘটে যাচ্ছিল। তিনি পাশে রাখা কালো মোজাজোড়া পরে নিয়ে পা নামিয়ে দিলেন সিল্কের লেস লাগানো তার হাইহিল জুেতার ভেতরে। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে চলে গেলেন সেলের এক কোনায় প্রায় মেঝে পযর্š Íঝোলানো, হাতে ও কলারে পশুর লোমের ঝালর দেওয়া ফারকোটটির দিকে। সেটি নিয়ে ঘমু াবার সময় পরা ভারী সিল্কের দ্য স্পাই ষ ৭ কিমোনোর ওপর চাপিয়ে নিলেন। মাথার এলোমেলো কালো চুলে ব্রাশ করে বেঁধে নিলেন ঘাড়ের পেছন দিকে। মাথার ওপরে তুলে দিলেন ফেল্ট হ্যাট। বাইরে যাতে উড়ে না যায়, সেজন্য সেটিকে সিল্ক রিবন দিয়ে চিবুকের নিচে বেঁধে নিলেন। তারপর একটু ঝুঁকে কালো চামড়ার গ্লাভসজোড়া হাতে তুলে নিয়ে উদাসীনভাবে তাকালেন একবার সবার দিকে। শাšকÍ ণ্ঠে বললেন, ‘এবার আমি প্রস্তুত।’ একটুপরে একে একে সবাই সেন্ট ল্যাজারে বন্দিশালা ছেড়ে বাইরে এসে ফায়ারিং স্কোয়াডে যাবার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা যন্ত্রযানের দিকে এগিয়ে গেলেন। ইঞ্জিন চালুথাকা যন্ত্রযানে সবাই ওঠার পর তা চলতে শুরু করল নিদ্রামগ্ন শহরের নির্জন রাজপথে। এক ধরনের অপার্থিব শব্দ তুলে যন্ত্রযান এগিয়ে চলল ক্যাথরিন দ্য ভিনসেন ব্যারাকের দিকে। ১৮৭০ সালে জার্মানরা গুঁিড়য়ে দেওয়ার আগে সেখানে একটা দুর্গছিল। মিনিট বিশেক পর যন্ত্রযানটি গন্তব্যে পৌঁছে গেলে সবাই একে একে নেমে এলেন। সবার শেষে নামলেন বন্দিনী মাতাহারি। বারো সদস্যের সৈন্যদলটি ততক্ষণে তাদের কাজ শেষ করার জন্য দাঁড়িয়ে গেছে সারিবদ্ধভাবে। লাইনের একেবারে শেষ প্রান্তেহাতের তলোয়ার ওপর দিকে তুলে দাঁড়িয়ে আছেন একজন অফিসার। দজু ন নানের পাশে দাঁড়িয়ে ফাদার আরবক্স অভিযক্তু বন্দিনী সম্পর্কেকিছু বলার চেষ্টা করলেন। মাঝখানে তাকে থামিয়ে একজন লেফটেন্যান্ট হাতে একখণ্ড সাদা কাপড় নিয়ে এসে এক সিস্টারকে বললেন, ‘ওর চোখ দুেটা বেঁেধ দিন, প্লিজ।’ ‘আমি অবশ্যই এটা পরব,’ বস্ত্রখণ্ডটির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন মাতাহারি। তার উকিল মাতির ক্লানেট প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে একবার তাকালেন লেফটেন্যান্টের দিকে। লেফটেন্যান্ট বললেন, ‘মাদাম যদি এটা পছন্দ না করেন ক্ষতি নেই, এটা বাধ্যতামূলক নয়।’ মাতাহারিকে জোর করা হলো না, চোখ বাঁধাও হলো না। দ্য স্পাই ষ ৮ তিনি নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলেন। সরাসরি শূন্যদৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে দেখলেন ফায়ারিং স্কোয়াডের সদস্যদেরকে। একসময় পিস্ট্র ও নানরা সেইসঙ্গে লইয়ার মাতির ক্লানেট দূরে সরে গেলেন। এদিকে ফায়ারিং স্কোয়াডের কমান্ডার স্কোয়াডের সদস্যদেরকে তাদের রাইফেল পরীক্ষা থেকে বিরত রাখতে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এদিকে সেই তরোয়ালধারী অফিসার নিজের স্থানে গিয়ে দাঁড়ালেন, যাতে সবাই তাকে দেখতে পায়। তিনি তরোয়াল তুললেন। লক্ষ্য স্থির...। বন্দিনী মাতাহারি নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছেন। ভাবলেশহীন তার চোখমুখ। ভয়হীন। হালকা মৃদুহাওয়ায় উড়ছে তার ফারকোটের ফ্রিল। চারদিকের অন্ধকার এখন আর নেই। শুধুনৈঃশব্দ্যের চাদরে যেন ঢেকে আছে সব। দাঁড়িয়ে থাকা অফিসার হাত থেকে তার তরোয়াল নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। বাতাসে শব্দ তুলে সেটা গিয়ে সোজা বিদ্ধ হলো আর্কের ওপর। পরমহু ূর্তেগর্জেউঠলেন অফিসার, ‘ফায়ার...!’ মাথার ওপরে, দিগন্তজুড়ে সূর্যআলো ছড়াচ্ছে। সেই আলোয় প্রচণ্ড শব্দে রাইফেল গর্জেওঠার পর ঝলসে ওঠা নলের মুখ থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে বেরিয়ে আসছে ছোট ছোট নীলচে ধোঁয়া। ফায়ারিং স্কোয়াডের সৈন্যরা তাদের রাইফেলগুলো মাটিতে সারিবদ্ধভাবে নামিয়ে রাখল। মাতাহারি তখনো নিশ্চল দাঁড়িয়ে। কয়েক মুহূর্ত। ছায়াছবিতে মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে যেভাবে ছিটকে পড়ে যায়, মাতাহারি তেমনভাবে সামনে বা পেছনে ঝুঁকে পড়লেন না। হাতও ওপরে, নিচে বা পাশে ছুঁড়লেন না। তিনি বিধ্বস্তহলেন নিজের ভেতরেই। মাথা উঁচুই রইল। চোখ রইল খোলা। এই সময়ে ঘটনার ভয়াবহতায় একজন সৈন্য অজ্ঞান হয়ে গেল। দ্য স্পাই ষ ৯ ধীরে ধীরে মাতাহারির হাঁটুভাঁজ হয়ে গেল সামনের দিকে। শরীর কাত হয়ে পড়ে গেল। ডানদিকে। পা দুটো তার কোটের ভেতরে একবার একটুউঁচু হয়ে আবার নেমে গেল। মাটিতে নিশ্চল শুয়ে রইলেন মাতাহারি, ওপরে স্বর্গের দিকে মুখ করে। আকাশজুড়ে তখন সূর্যের আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। একটুপরে একজন থার্ডঅফিসার একজন লেফটেন্যান্টকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে এলেন সামনের দিকে। বুেকর সঙ্গে বাঁধা হোলস্টার থেকে তুেল নিলেন রিভলভার। তারপর হেঁটে গেলেন মাতাহারির নিশ্চল শরীরের দিকে। সামনে গিয়ে থামলেন একবার। তারপর একটুঝঁেুক রিভলভারের মাজল তাক করলেন সতর্কভাবে, চামড়া স্পর্শনা করে, মাতাহারির কপালের একপাশে। টানলেন ট্রিগার। পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে রিভলভার থেকে গুলি বেরিয়ে মাতাহারির মস্তিষ্ক ভেদ করে বেরিয়ে গেল অন্যদিকে। অফিসার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাকালেন একবার উপস্থিত সবার দিকে। তারপর ঘোষণা করলেন, ‘মাতাহারি ইজ ডেড।’
ব্রাজিলিয়ান ঔপন্যাসিক পাওলো কোয়েলহো ডি’সুজা ১৯৪৭ সালের ২৪ আগস্ট দেশটির রাজধানী রিও ডি জেনেরিওতে জন্মগ্রহণ করেন। একই শহরে তার শিক্ষাজীবনের শুরু এবং বেড়ে ওঠা। আইন বিষয়ে কিছুদিন পড়াশোনার পর ভ্রমণের নেশায় তা আর শেষ করতে পারেননি। ঐ সময়টা ভবঘুরের ন্যায় ঘুরে বেড়িয়েছেন মেক্সিকো, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, চিলিসহ ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে। এর পরপরই ছোটবেলার স্বপ্ন বই লেখাকে বাস্তবে রূপ দেন। ১৯৮২ সালে ‘হেল আর্কাইভস’ নামক বই দ্বারা সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ করেন। তবে এই প্রবেশ আকর্ষণীয় ছিলো না। এমনকি দ্বিতীয় প্রকাশিত বই ‘প্রাক্টিক্যাল ম্যানুয়েল অব ভ্যাম্পায়ারিজম’ তার নিজেরই অপছন্দের তালিকায় ছিলো। ১৯৮৭ সালে ‘পিলগ্রিমেজ’ এর পর ১৯৮৮ সালে প্রকাশ পায় তার আরেক বই ‘দ্য আলকেমিস্ট’। পাওলো কোয়েলহো এর বই হিসেবে ‘দ্য আলকেমিস্ট’ বইটিই মূলত কোয়েলহোর লেখক-জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তবে ‘৮৭ সালে বইটি প্রকাশিত হয়েছিলো ব্রাজিলের একটি ছোট প্রকাশনা সংস্থা থেকে, যারা ন’শোর বেশি কপি ছাপাতে নারাজ ছিলো। ১৯৯৩ সালে একই বই আমেরিকার বিখ্যাত প্রকাশনী হারপার কলিন্স থেকে প্রকাশিত হলে পাঠক মহলে হুলুস্থুল পড়ে যায়। বইটি এখন পর্যন্ত মোট ৮০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, যা পাওলো কোয়েলহো এর বই সমূহ এর মাঝে অনন্য। কোয়েলহোর কাহিনীগুলোর বিশেষত্ব হলো তার কল্পনাশক্তির জাদুকরী মোহ। কোনো সরল গল্প দ্বারা তিনি গভীর জীবন দর্শনবোধ পাঠকদের মাঝে সঞ্চালন করতে চান, এবং সফলতার সাথে করেও এসেছেন। পাওলো কোয়েলহো এর বই সমগ্র-তে স্থান পাওয়া উপন্যাসগুলোর মাঝে ‘দ্য আলকেমিস্ট’, ‘ব্রিদা’, ‘দ্য ডেভিল এন্ড মিস প্রাইম’, ‘দ্য জহির’, ‘দ্য ভ্যালকাইরিস’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ‘দ্য মাডি রোড’, ‘দ্য রং গিফট’, ‘দ্য জায়ান্ট ট্রি’, ‘দ্য ফিশ হু সেভড মাই লাইফ’, ‘আই উড র্যাদার বি ইন হেল’, ‘রিবিল্ডিং দ্য ওয়ার্ল্ড’ এর মতো ছোটগল্পগুলোতেও দর্শনের প্রমাণ মেলে, যা পাঠকদের গভীরভাবে ভাবতে শেখায়। পাওলো কোয়েলহোর আরেক পরিচয় তিনি গীতিকার। বেশ কিছু জনপ্রিয় ব্রাজিলীয় গানের জনক তিনি।