দাস প্রথা গত হয়েছে বহু যুগ পূর্বেই। প্রচলিত আছে শায়েস্তা খানের আমলে সব কিছুই সস্তা ছিল। টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। ঐতিহাসিকরা মনে করত শায়েস্তা খানের আমলেই মানুষ সুখে শান্তিতে বসবাস করতেন। অথচ কলকাতা যাদুঘরে একটি দলিল আছে,যেখানে লিখা আছে শায়েস্তা খানের আমলেই গপীনাথ মজুমদার নামে এক অসহায় ব্যক্তি ১৬৬৮ সালের ১৩ই আগষ্ট নিজেকে ইসিদ্দর খানের কাছে বিক্রয় করেন। সে আমলের দাস প্রথার এমন আরো অনেক নজির আছে । দ্রব্যমূল্যের পাশাপাশি দূর্বল রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা মানুষের দারিদ্রতার সাথে যেমন সরাসরি সম্পর্ক তেমন ভাবে সামাজের ধনিকশ্রেণীর স্বার্থপরতাও অঞ্চল ভিত্তিক দারিদ্রতা সৃষ্টির জন্য দায়ী। যার প্রভাব সরাসরি গিয়ে পরে অল্প আয়ের মানুষদের ওপর। এরা সমাজের নিষ্পেষিত শ্রেণী। বলা হয় রাষ্ট্রের সকল সুযোগসুবিধা আর আধুনিক সভ্যতার যা কিছু আমরা দেখছি তাঁর সবই মানব কল্যাণে , কিন্তু নিষ্পেষিত শ্রেণীর কল্যাণে নয় যা আমাদের মনের দৃষ্টিকে একটু প্রসারিত করলে সহজেই বুঝতে পাব। এই নিপেড়িত আর নিষ্পেষিত শ্রেণী আধুনিক জীবন ব্যবস্থার কী’ইবা পেয়েছে ? যদি পেত তাহলে সূর্যুদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত গাধার খাটুনি এরাই কেন খাটছে ? তারপরও এরা জীবনের চাহিদা অনুযায়ী না পাচ্ছে পুষ্টিকর অন্ন আর না পাচ্ছে নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে নিজের অধিকার নিয়ে ভাল মন্দ একটু কথা বলার সুযোগ । বস্ত্র , বাসস্থান, উন্নতশিক্ষা আর একটু ভালো চিকিৎসা পাওয়ার কথা বাদই দিলাম। শায়েস্তা খান দিল্লির সম্রাটকে খুশি রাখার লক্ষ্যে অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের ফলেই স্বর্ণ ও রোপ্য মুদ্রার অভাব দিত। তিনি সম্রাটকে লাখ লাখ টাকা কর দিতেন , নজরানাও দিতেন। আবার সম্রাটকে টাকা ধারও দিতেন। সবকিছু ঠিক রাখার জন্য জাতীয় উৎপাদনের চোশট্টি শতাংশ আদায় করার ফলে জনগনের আয় কমে যায়। জনগনের হাতে আর যতেষ্ট অর্থ মুদ্রা থাকত না । আর চালের দাম কম হলেও শায়েস্তা খানের আমলে অনেক মানুষকেই না খেয়ে থাকতে হয়েছিল। ঠিক একই রকম ভাবে , আজও আমাদের রাষ্ট্রের ও সমাজের কর্তাব্যক্তিরা নিজের স্বার্থ হাসিল করার লক্ষ্যেই উপরের মহলের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত । যার ফলে গরীবের হক চলে যায় ওপর ওয়ালাদের বিলাশীতায় । আর তারাই ধন বৈষম্যের জন্ম দেয় । এভাবে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে হতদ্ররিদ্র । তবুও তাঁরা বাঁচতে চায় । আর এই বাঁচার নেশায় মত্ত হয়ে তাঁরা যা পায় তাই আঁকড়ে ধরে । তাদেরকে লাথি মারলেও ধনিক শ্রেণীর পা জড়িয়ে ধরে , শুধুমাত্র একটু বেঁচে থাকার জন্য। এভাবেই তাঁরা ক্রিতদাস হয়ে উঠে আর বরণ করে এই সমাজের ধনিকশ্রেণীর দ্ধারা সৃষ্ট নব্য দাসত্ব । এই বিবেকহীন ধনিকশ্রেণী সমাজের দরিদ্র ও হতদরিদ্র আর ক্ষুদার্ত মানুষদেরকে নানান কৌশলে ব্যবহার করছে। নব্য দাসত্ব প্রথা এই উঁচুশ্রেণির মানুষগুলো সমাজে কায়েম করে চলেছে নিরন্তর ভাবে। শায়েস্তা খানের আমলের মত আজও এই সমাজের মানুষে জীবনে এক থালা ভাতের চাহিদা পূরন হচ্ছে কিন্তু সমাজের প্রভুদের দায়বদ্ধতা, জবাবদীহিতা, লজ্জাবোধ আজ সমাজের তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। জ্ঞান আহরণের সীমা বেড়েছে তবে সুস্থজ্ঞানের অভাব আজও রয়ে গেছে। সমাজের মানুষ জীবনকে চালিয়ে নেওয়ার স্বার্থে নিজ বিবেককে বিকিয়ে দিচ্ছে কারো না কারো কাছে। বাধ্যহয়েই নিপীড়িত মানুষগুলো দাস বা দাসী হিসেবে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে । অর্থের প্রয়োজনে, নিজেকে প্রতিষ্ঠীত করার প্রয়োজনে এমনকি শাররীক প্রয়োজনেও দাসত্ব মেনে নিচ্ছে মানুষ। নিরীহ মানুষকে ক্ষামতার আর ধর্মের দ্ধারা অপব্যবহার করে সুনিপুণ ভাবে চেতনা নাশ করে রখছে এই সমাজের বৈষম্যের কারিগররা। মানুষের আত্না এই দাসত্ব থেকে মুক্তির পথ খুজে বেড়ায় অবিরাম । আর নব্যদাসত্ব থেকে সমাজের নিরীহ মানুষগুলোকে মুক্তি দিতে কিছু মানুষ সারাজীবন লড়ে যায় , লড়াই করে। এই লড়াকুরাই সমাজের বিষাক্ত মানুষরুপী কর্তাব্যক্তিদের চক্ষুশূল। নানান ঘটনা,দন্ধ, সংঘাত , ক্লাইম্যাক্স, এন্টিক্লাইম্যাক্স, প্রেম আর বিরহের ঘনঘটা নিয়েই চলমান এই সমাজের চিত্র ফুটে উঠেছে এ উপন্যাসে।