.. কপালগুণে আমাদের নানা ধরনের গণতন্ত্রের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে। প্রকৃতি কর্তৃক রাজা গোপালের নির্বাচন, ব্রিটিশ স্টাইল গণতন্ত্র, আইয়ুব খানের বুনিয়াদি গণতন্ত্র, একদলীয় গণতন্ত্র, এরশাদের সামরিক অংশীদারত্বের গণতন্ত্র এবং সর্বশেষ বারো ভূঁইয়ার দেশে ভূঁইয়া গণতন্ত্র বা সামন্ততান্ত্রিক গণতন্ত্র। সেই গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষাকল্পে আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তৈরি করি। দেশে-বিদেশে চোখ তুলে তাকালেও এবং আমাদের পিঠে হাত দিয়ে প্রশংসা করলেও অতিদ্রুত তা বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। আমি বলেছিলাম, এমন জিনিস কেবল আত্মসম্মানহীন গোষ্ঠী আমন্ত্রণ জানাতে পারে। এই কৃত্রিম উপগ্রহ সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে নিম্নচাপের সৃষ্টি করে। সেই চাপে দিশেহারা হয়ে তৎকালীন সরকার নিজের পছন্দমতো প্রধান উপদেষ্টা পাওয়ার জন্য বিচারকের বয়সসীমা বৃদ্ধি করে। নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয়। ... তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্রপতি নিজেই প্রধান উপদেষ্টার পদ অলংকৃত করলে ঘূর্ণিঝড়টি টর্নেডোতে রূপান্তরিত হয়। দেশ অচল হয়ে পড়ে। সরকারের ব্যর্থতা ভয়াবহ আকার ধারণ করলে রাষ্ট্রপতি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে পদত্যাগ করেন। ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। দেশের লোকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ... গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে বর্তমান সরকার যে উপপ্লবের সৃষ্টি করেছে, তার দায়িত্ব তাঁদেরই নিতে হবে। ... ভাবনা-এ বছরের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে যেন নবম সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। দুর্ভাবনা-সেই লক্ষ্য অর্জিত হবে তো!
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বাংলাদেশের একজন অন্যতম শিক্ষাবিদ, আইনজীবী ও বিচারক। ১৯২৮ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৌলভী মুহাম্মদ জহির উদ্দীন ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী এবং আইনজীবী। শৈশব থেকেই রাজনৈতিক বিষয়াদি ও সংস্কৃতির দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর তাঁরা তৎকালীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও পরবর্তীতে রাজশাহীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে বি.এ. (সম্মান) এবং ১৯৫১ সালে এম.এ. পাস করেন। এরপর ১৯৫৮ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তাঁর কর্মজীবনের শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদে যোগ দিয়ে। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা হাইকোর্ট বারে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়ের। সহকারী এডভোকেট জেনারেল, হাইকোর্টের ভাইস প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্য পদে দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৭৬ সালে তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি হন। ১৯৮৫ সালে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যোগ দেন। ১৯৯৫ সালে তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলাকালীন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একাধারে একজন আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ এবং অভিধানপ্রণেতা। তিনি একজন ভাষা সৈনিক; ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এর বই সমূহ ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগেরই বহিঃপ্রকাশ। তিনি উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বই সমূহ হলো ‘রবীন্দ্র সম্বন্ধে সঞ্জনা ও পার্থক্য বিচার (১৯৬৮)’, ‘যথা-শব্দ (১৯৭৪)’, ‘কোরআন সূত্র (১৯৮৪)’, ‘ভাষার আপন পর (২০১২)’ ইত্যাদি। তাঁর রচিত প্রবন্ধগ্রন্থের সংখ্যা ৪০টি। সাহিত্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরষ্কার (১৯৮৪), একুশে পদক (২০০৭) সহ আরো বেশ কিছু সম্মাননায় ভূষিত হন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এর বই সমগ্র পাঠকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ২০১৪ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।