মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের প্রথম উপন্যাস ‘আনোয়ারা’ প্রকাশের বছর ১৯১৪-তে কাজী নজরুল ইসলাম সহ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অনেক তরুণ-যুবক ভাইসরয় চার্লস হারডিঞ্জ-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পঞ্চম জর্জ-এর সাম্রাজ্য রক্ষা করতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জারমানি’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রওনা হয় ইউরোপের পথে। দক্ষিণ ভারত থেকে ফিরে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তাঁর ফিনিক্স স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকগণ সহ আশ্রয় নেন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন-এ। স্বাধীনতাকামী ৩৭৬ জন ভারতীয় হংকং থেকে ‘গুরু নানক জাহাজ’-এ যাত্রা করে কানাডায় পৌঁছে ব্যর্থ হয় আশ্রয় চেয়ে। পর-পর তিনটি উপন্যাস প্রকাশ হয় শরৎচন্দ্রের- পরিণীতা, বিরাজ বৌ ও প-িত মশাই। এমন এক সামাজিক-রাষ্ট্রিক পরিস্থিতি-পরিবেশে প্রকাশ মাত্র ‘আনোয়ারা’ ব্যাপক প্রিয়তা পায় মুসলিম পাঠক সমাজে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের পাশাপাশি ষাটের দশক পর্যন্ত সমান প্রচার ছিল এ উপন্যাসের, সেই সঙ্গে মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের হাসন-গঙ্গা বাহমণি, পরিণাম, প্রেমের সমাধি, গরীবের মেয়ে, দুনিয়া আর চাই না, প্রভৃতি উপন্যাসেরও। তাঁর সাফল্য অন্য অনেক মুসলিম ঔপন্যাসিককে উৎসাহিত করেছে সামাজিক ও ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায়। কি ছিল সেই প্রিয়তার ভিত্তি? লক্ষ্যযোগ্য বিষয় হলো- মোহাম্মদ নজিবর রহমান শুধু সাহিত্যিক ছিলেন না, শিক্ষক ছিলেন, তাঁর সাহিত্যও শিক্ষার আলো ছড়িয়েছে, আলোচনার বিষয় ও আদর্শ হয়েছে। খুব মনে আছে, ছোটবেলায় এসব কথাবার্তা-বিতর্ক শুনেছি ঘরে-ঘরে। তাঁর উপন্যাসের কোনও চরিত্র, কোনও ঘটনার উদাহরণ তুলে ধরে সমাজের ও পরিবারের নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হতো তখন, জীবন ও জগতের নানা সমস্যার সমাধান বের করা হতো। বিশ শতকের বেশির ভাগ সময় জুড়ে বাংলার মুসলমান তো অনেক কিছু শিখেছে তাঁর কাছ থেকেই। পেশাতেও ছিলেন শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক ছিলেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। সে মনোবৃত্তি তাঁর সজাগ ছিল সবসময়ই। সম্ভবত এ জন্যই এক অনিচ্ছুক ঔপন্যাসিক ইসমাইল হোসেন শিরাজী উপন্যাস রচনায় উৎসাহিত করেছিলেন তাঁকে। জাতির উন্নয়নকামী এক জননেতা হিসেবে তিনি জানতেন, আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে জাতীয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণে এক সহায়ক শক্তি হতে পারে সৃষ্টিশীল সাহিত্যশিল্প। সেই শিল্প-আকাক্সক্ষা কতখানি কি পূরণ করতে পেরেছিলেন নিভৃত জনপদ উল্লাপাড়ার হাটিকুমরুলের এক সাহিত্যসাধক তা নিয়েই সনিষ্ঠ গবেষক মোহাম্মদ জুলফিকারের মূল্যায়ন-গ্রন্থ ‘মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন: জীবন ও সাহিত্যকর্ম’। একজন নিবেদিতপ্রাণ সাহিত্যিকের জীবন ও তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যের বিষয় ও শৈলী এ গ্রন্থে বিশ্লেষিত হয়েছে তৎকালীন সমাজ-জগতের প্রেক্ষিত পটভূমিতে। মোহাম্মদ জুলফিকার পেশায় সাংবাদিক, তাই তাঁর অভিজ্ঞতা, অনুসন্ধিৎসা ও পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা এক নতুন আলোয় দৃশ্যমান করেছে এই বিস্মৃত সাহিত্যিকের অবহেলিত সৃষ্টিকর্মকে। এ গ্রন্থের মাধ্যমে একালের পাঠকেরা চিনে নেবেন আমাদের সাহিত্যের একজন বরণীয় স্মরণীয় ব্যক্তিত্বকে- এই কামনাই করি। সাযযাদ কাদির কবি ও বহুমাত্রিক লেখক সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট
Title
মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন : জীবন ও সাহিত্যকর্ম