ভারত কী করে ভাগ হলো? কেন ভাগ হলো? অপ্রতিরোধ্য ছিল কি? ভারত ভাগ কী এড়ানো যেত না? নাকি দেশভাগের শর্ত মেনে না নিলে স্বাধীনতা এই কাঙ্খিত সত্যটি আরো দূরে সরে যেত? অথবা এই শর্ত কি আমাদের রাজনীতিকদেরই উদ্ভাবিত? হিন্দু-মুসলিম ঐক্য কি কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না? নাকি, প্রাচীন ভারত থেকে শুরু করে আমাদের সামাজিক কাঠামোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই অনৈক্যের বীজ? ভারতবাসীর তখনকার প্রধানতম প্রতিনিধি কংগ্রেস কি তার রাজনৈতিক দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে পেরেছে? একটি নিখুঁত সংগঠিত রাজনৈতিক দল কি কংগ্রেস, না গোষ্ঠীতন্ত্রের ভূত তখন থেকেই তার মজ্জাগত? ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাস কি গোষ্ঠীতন্ত্রের ইতিহাস? মুসলিম লিগ কি ব্রিটিশ রাজশক্তিরই সৃষ্টি? বাংলার ‘বিগ ফাইভ’ কারা? মহাত্মা গান্ধি, জিন্নাহ, নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল, লর্ড ওয়েভেল, লর্ড মাউন্টব্যাটেন কে কীরকম দায়িত্ব পালন করেছেন বা এড়িয়ে গেছেন কি? এরকমই অসংখ্য জরুরি প্রশ্নের পুঙ্খানুপুঙ্খ, চুলচেরা বিশ্লেষণ এই গ্রন্থের পাতায় পাতায়। কোনো মনগড়া কাহিনি নয় বা দিবাস্বপ্নের মতো আজগুবি ঘটনার সম্মিলন নয় যথেষ্ট নথিপত্র, সাক্ষী-সাবুদ, লিখিত ঘোষণাপত্র তুলে ধরে এই গ্রন্থ ইতিহাস-নির্ভর এক প্রামাণ্য দলিল। সেই অগ্নিগর্ভ সময়ের পর্দার অন্তরালে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার বিশ^স্ত ধারাবিবরণী লিপিবদ্ধ রয়েছে শুধু নয়, তৎকালীন রাজনীতিবিদদের হঠকারিতা ও অদূরদর্শিতা এবং ভারত বিভাগের গোপন কথাটি সরাসরি ফাঁস করে দিয়েছেন ‘ভারত কী করে ভাগ হলো’ গ্রন্থে। যে কোনো অনুসন্ধিৎসু পাঠকের কাছে, তা তিনি দেশবিভাগে ক্ষতিগ্রস্থ হোন, না-ই হোন, ভারত-ভাগের ইতিহাস জানতে হলে এই গ্রন্থ অপরিহার্য।
দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল ও শ্রীমতী হেমন্তকুমারী শাসমলের একমাত্র পুত্র বিমলানন্দ শাসমল মেদিনীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৪ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি কলকাতায় গান্ধিজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে গান্ধিজি তাকে বলেছিলেন, "You have to carry on the work of your father." ছাত্রাবস্থায় তিনি পিতৃহীন হন। ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৪৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দুর্ভিক্ষপীড়িতদের মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য লেখক ভারতরক্ষা আইনে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৯৪৫-এ তিনি সোদপুরে খাদি প্রতিষ্ঠানে গান্ধিজির অবস্থানকালে তাঁর শিবিরে সংবাদপত্র জগতে যোগাযোগকারী কর্মী হিসেবে কাজ করতে থাকেন। এই সময় তিনি গান্ধি শান্তি সেবাদল নামে এক অহিংস কর্মীদল গঠন করেন। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় তিনি গুরুতরভাবে আহত হয়ে সাতাশ দিন অজ্ঞান অবস্থায় পি. জি. হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তখনকার রাজনীতি ছিল পঙ্কিলতায় ভরা, এই ধারণায় লেখক স্বাধীনতার পর থেকে রাজনীতি-জগৎ থেকে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। লেখক প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “বেদান্ত দর্শন ও বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিক সূত্র” এই বিষয়ের উপর ফরাসি ভাষায় ডক্টরেট হন এবং ফ্রান্সের জাতীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিষদ থেকে স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। লেখকের সংক্ষিপ্ত ভাষ্য রেডিওযোগে সমগ্র ইউরোপে প্রচারও করা হয়েছিল এবং বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আলবার্ট সোয়াইৎযার তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। লেখক আইন পাশ করেন এবং বিভিন্ন কলেজ যেমন- সুরেন্দ্রনাথ, সিটি কমার্স, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী প্রভৃতি কলেজে অধ্যাপনা করেন। সমাজসেবার কাজেও লেখক অগ্রণী ছিলেন। বছর খানেক মাদার টেরিজার সঙ্গে কুষ্ঠরোগীদের সেবাও করেছেন। এ ছাড়া অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য হিসাবে বিভিন্ন দেশের অত্যাচারিত ও নিপীড়তদের পক্ষ নিয়ে অনেক তদবির করেছেন। কিছুদিন আগে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির বন্দীদের স্বপক্ষে আবেদন জানালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার সহানুভূতির সাথে বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছিলেন। মেদিনীপুরের সেন্ট্রাল জেলে তিরিশ জন তফসিলি জাতির বন্দীদের জন্য প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের কাছে আবেদন করে মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। ছাত্রাবস্থায় লেখক তাঁর কাব্যগ্রন্থ “পতিতা” প্রকাশ করেন। তাঁর গদ্য-পদ্যের সংকলন “এসো রেণু” খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ১৯৬৮ সালে তিনি “লা ভেরীতে” (সত্য) নামে ইংরেজি সাপ্তাহিক কাগজও বের করনে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করে লেখক দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ওই রিপোর্টে বিধানচন্দ্র রায়সহ কয়েকজন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ হয়েছিল। লেখকের অনুপম অবদান প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইতিহাসের তথ্য ও তত্ত্ব সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক দলিল “স্বাধীনতার ফাঁকি”।