ইমাম নববী এবং রিয়াদুস সালেহীন আল্লামা ইমাম নববী (রহিমাহুল্লাহ) এর জীবনীঃ বিশ্বখ্যাত হাদীস গ্রন্থ ‘রিয়াদুস সালেহীন’ এর রচয়িতা হলেন, বিশিষ্ট মুহাদ্দিস, বহু গ্রন্থের লেখক, জগত বিখ্যাত হাদীস বিশারদ ও ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ। তার নাম হলো, শায়খ মুহিউদ্দিন আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনে শারফ আল নাবাবী আল দামেশকী। তার ডাকনাম আবু যাকারিয়া, মূলনাম ইয়াহইয়া এবং লকব-উপাধি মুহিউদ্দিন। ৬৩১ হিজরীর ৫ই মুহাররামে তিনি সিরিয়ার রাজধানী দামেশকের নিকটবর্তী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৭৬ হিজরীর রজবে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। তিনি মাত্র ৪৫ বছর জীবিত ছিলেন। এ মহান ব্যক্তি শৈশব থেকেই অত্যন্ত ভদ্র, শান্তশিষ্ট ছিলেন। কৈশোরেই পবিত্র কুরআনের হিফয সম্পন্ন করেন। তার অসাধারণ স্মরণশক্তি, প্রতিভা ও জ্ঞান অন্বেষণের প্রতি গভীর অনুরাগ তার শিক্ষকগণকে আকৃষ্ট করেছিলো। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি পবিত্র কুরআন, হাদীস, নাহু, সারফ, মানতিক, ফিকহ ও উসূলে ফিকহ ইত্যাদি বিষয়ে ব্যুতপত্তি অর্জন করেন। হাদীস ও ফিকহে তিনি আত্মার খোরাক বেশী পেতেন। তাঁর সৌভাগ্য তিনি সে কালের শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ আলেম ব্যক্তিদের সান্নিধ্য লাভ করেছেন এবং জ্ঞান আহরনের উচ শিখরে আরোহণ করেন। তিনি উন্নত চরিত্র, তাকওয়া ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অত্যন্ত সাধারণ আহার করতেন, মোটা কাপড় পরতেন এবং সারা জীবন কৃচ্ছ্র সাধনায় কাটান। তিনি সকলের নিকট ছিলেন গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। জীবনে কখনো অর্থ, সম্মান, পদ ও ক্ষমতার পেছনে ছোটেননি। কারো থেকে দান গ্রহণ করেননি। সারাজীবন ইলমের প্রচার ও প্রসারে এবং ইবাদত বন্দেগিতে কাটাতেন। তার ছাত্র ছিলো অসংখ্য। রিয়াদুস সালেহীন সম্পর্কেঃ হাদীস মানব জাতির অমূল্য সম্পদ। বিশেষতঃ মুসলিম উম্মাহর জন্য আলোক-বর্তিকা, ইহকাল ও পরকালের মুক্তি ও নাজাতের উসিলা। মহানবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুপম জীবনাদর্শ জানতে হলে এবং জীবনের সকল স্তরে তা বাস্তবায়ন করতে হলে হাদীস অধ্যয়ন অপরিহার্য। কেননা, মহান আল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের মাঝেই আমাদের জন্য উন্নততর ও সুন্দরতম আদর্শ রেখেছেন। এ আদর্শকে জানতে হলে হাদীস গ্রন্থ পড়তে হবে ও বুঝতে হবে। হাদীসের জ্ঞান ভান্ডার বিশাল। বছরের পর বছর অধ্যয়ন করেও এ বিরাট ও বিশাল ভান্ডার থেকে নিজের প্রয়োজনীয় জ্ঞান চয়ন করা কষ্টসাধ্য। কিন্তু আমাদের পূর্বসুরী উলামায়ে কেরাম অক্লান্ত পরিশ্রম করে পরবর্তী উম্মাতের জন্য বিষয়ভিত্তিক হাদীস বিন্যাস করে উম্মাতের জন্য বিরাট উপকারের ব্যবস্থা করেছেন। মহান আল্লাহ তাদের উত্তম জাযা দান করুন।
আল্লামা ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ-এর বিশ্বখ্যাত ও অমূল্য “রিয়াদুস সালেহীন” গ্রন্থখানা উম্মাতে মুসলিমার জন্য অনন্য উপহার। দীর্ঘদিন পরিশ্রম ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে তিনি বিষয়ভিত্তিক এ গ্রন্থটি রচনা করেছেন। পবিত্র কুরআনের সাথে হাদীসের যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান তা বুঝানোর জন্য তিনি অধ্যায় ও অনুচ্ছেদের প্রথমেই বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত কুরআনের আয়াত সংযুক্ত করেছেন।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণও প্রদান করেছেন। সারা বিশ্বময় এ গ্রন্থটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত ও পঠিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর বহু ভাষায় গ্রন্থটি অনূদিত হয়েছে।
তাঁর পূর্ণনাম মুহিউদ্দ্বীন আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনুশ শায়েখ আবু ইয়াহইয়া মুররি ইবনে হাসান ইবনে হুসাইন ইবনে মুহাম্মদ ইবনে জুম‘আ ইবনে হেযাম আল-হেযামী আন-নববী। ‘মুহিউদ্দ্বীন’ তাঁর উপাধি এবং ‘আবু যাকারিয়া’ হলো কুনিয়াত তথা উপনাম। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি এতোটাই প্রসিদ্ধ ছিলেন এবং ইলম ও তাক্বওয়ার মানদণ্ডে এমন সমুন্নত হতে পেরেছিলেন যে, তাঁকে ‘মুহিউদ্দ্বীন মতান্তরে ‘মুহিউস্ সুন্নাহ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ৬৩১ হিজরীর মুহাররম মাসে দামেশকের নিকটবর্তী ‘নাওয়া’ নামক স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থানের দিকে সম্পর্কিত করেই তাঁর নামের শেষে ‘নাওয়ায়ী’ বা ‘নববী’ উল্লেখ করা হয়। এ ব্যাপারটা স্বতঃসিদ্ধ ও প্রমাণিত যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর যেসব বান্দাদের দিয়ে দীন ও মানুষের মহান খেদমত করান, ছোটবেলা থেকেই তাদেরকে সেভাবেই গড়ে তোলেন। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ’র ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। শৈশবে থেকেই তিনি ছিলেন আর সব শিশুদের চেয়ে আলাদা। অজপাড়া গ্রামে, নিম্নবিত্ত নিরক্ষর পরিবারে জন্ম নেওয়া সত্তে¡ও তাঁর সবটুকু ঝোঁক ছিলো ইলম অর্জনের দিকে। দোকানদার পিতা চাইতেন, ছেলে তার সাথে দোকানদারী করুক। কিন্তু তিনি পিতার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দামেশকের ‘আর-রাওয়াহিয়্যাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানে চলে যান ইলমের-অšে¦ষণে এবং আলেমদের সংস্পর্শে থাকার তাড়নায়। এখানে থেকেই তিনি ইলমের সবগুলো শাখায় নিজের উত্তরোত্তর ব্যুৎপত্তি ঘটান। ইমাম যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তিনি (নববী) দিন-রাত্রির বেশির ভাগ সময় জ্ঞানার্জনে ব্যয় করতেন। মেধা ও পরিশ্রমের জন্য তাঁকে দিয়ে উদাহরণ পেশ করা হতো।’ সারাদিনে একবার খেতেন। এমনকি পথ চলার সময়টুকুতেও মনে মনে পড়া আওড়াতেন। ৬৫১ হিজরীতে একুশ বছর বয়সে তিনি পিতার সাথে হজ্জ পালন করার জন্য মক্কায় যান। এই সফরকালে তিনি মক্কা-মদীনার শ্রেষ্ঠ আলেমগণের সান্নিধ্যে আসেন এবং হাদীস শাস্ত্রে বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেন। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ যেসব ওস্তাদদের নিকট থেকে জ্ঞানার্জন করেছেন, তাঁদের মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ আল-মাকদাসী, ইসমাইল ইবনে ইবরাহীম, আহমদ ইবনে আবদুদ্দায়েম, আবদুর রহমান আল-আন্বারী, ইবরাহীম ইবনে আলী আল-ওয়াসেতী প্রমূখ অন্যতম। ফিকহের ক্ষেত্রে নববী ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। শুধু অনুসারীই নয়, বরং তিনি ছিলেন মাযহাবের প্রধান বিশ্লেষক ও ইমামদের একজন। ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তিনি ছিলেন শায়খুল মাযহাব এবং তাঁর যমানার শ্রেষ্ঠতম ফকীহ’। যাহাবী বলেন, ‘তিনি ছিলেন মাযহাবের ব্যাখ্যাকারদের শিরোমনি’। তাঁর রচিত ‘রাওদাতুল ত্বালেবীন’কে শাফেয়ী মাযহাবের প্রধানতম ব্যাখ্যাগ্রন্থ ও তথ্যসূত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। অধিকাংশ শাফেয়ী আলেমদের মতো ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহও আকীদার ক্ষেত্রে ‘আশ‘আরী’ মতবাদের অনুসারী ছিলেন। যাহাবী, তাজউদ্দীন সুবকী, ইয়াফেয়ী-সহ তাঁর অপরাপর জীবনীকাররা এমনটাই উল্লেখ করেছেন। সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যায় তাঁর রচিত ‘আল মিনহাজ’ গ্রন্থে তিনি আশ‘আরী মতবাদসমূহকে ব্যাপকভাবে স্থান দিয়েছেন। ক্ষণজন্মা এই মহাত্মা বেঁচে ছিলেন মাত্র পয়তাল্লিশ বছর। কিন্তু এই স্বল্প সময়েও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে দিয়ে দীন ও ইলমের যে বিশাল খেদমত করিয়েছেন, তা সত্যিই বিরল। ইলমের প্রায় প্রতিটি শাখাতেই তাঁর রচিত গ্রন্থ রয়েছে, যেগুলো কেয়ামত পর্যন্ত মানুষকে উপকার দিয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ! বিশেষ করে ‘আল-আরবাঈন আন-নববীয়্যাহ’, ‘রিয়াদুস সালেহীন’ এবং ‘আল-আযকার’ এই তিনটি গ্রন্থ তো সর্বস্তরের মুসলিমের কাছেই সমানভাবে সমাদৃত এবং পঠিত। এছাড়া তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থাবলির মধ্যে অন্যতম হলো, (১) আল-মিনহাজ ফি শারহে মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ; (২) রাওদাতুল ত্বালেবীন ওয়া উমদাতুল মুফতীন; (৩) মিনহাজুল ত্বালেবীন ওয়া উমদাতুল মুফতীন; (৪) আদাবুল মুফতি ওয়াল মুসতাফতি; (৫) তুহফাতু তুল্লাবিল ফাদায়েল; (৬) আত-ত্বিবইয়ান ফি আদাবে হামালাতিল কুরআন। (৭) আত-তাহরীর ফি আলফাযিত তানবীহ; (৮) আল-উমদাহ ফি তাসহিহিত তানবীহ; (৯) আল ইদ্বাহ ফিল মানাসিক; (১০) আত তাইসীর ফি মুখতাসারিল ইরশাদ; (১১) ইরশাদু তুল্লাবিল হাক্বায়েক; (১২) আল-ফাতাওয়া; (১৩) আল মিনহাজ ফি মুখতাসারিল মুহাররার; (১৪) দাকায়েকুল মিনহাজ; (১৫) মুখতাসারু আসাদিল গাবাহ; (১৬) মানাকিবুশ শাফেয়ী; (১৭) মুহেম্মাতুল আহকাম; (১৮) রিসালাহ ফি ক্বিসমাতিল গানাঈম; (১৯) খুলাসাতুল আহকাম; (২০) বুসতানুল আরেফীন। এছাড়া তাঁর রচিত অসমাপ্ত গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়। তন্মধ্যে ‘আল মাজুমু শারহুল মুহায্যাব’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর মৃত্যুর পর ইমাম সুবকী রাহিমাহুল্লাহ এবং তারপর শায়েখ মুহাম্মদ নজীব এই গ্রন্থের রচনা সমাপ্ত করেন। এছাড়া ‘জামেউস সুন্নাহ’, ‘শারহুত ত্বানবীহ’, ‘শারহুল ওয়াসিত’, ‘শারহুল বুখারী’, ‘শারহু সুনানি আবু দাউদ’, ‘আল-আহকাম’ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ৬৭৬ হিজরীর রজব মাসের চব্বিশ তারিখে পয়তাল্লিশ বা ছেচল্লিশ বছর বয়সে এই মনীষী ইন্তেকাল করেন। তাজউদ্দীন সুবকী রাহেমাহুল্লাহ বলেন, ‘তাঁর মৃত্যুতে দামেশক ও তদ্সংলগ্ন শহরগুলো শোকে ডুবে গিয়েছিলো।’ জন্মস্থান ‘নাওয়া’তেই তাঁকে দাফন করা হয়। মহান আল্লাহ তাঁকে এবং তাঁর সকল খেদমতকে কবুল করুন।