মৌলিকভাবে সংকলিত ‘উমদাতুল আহকাম’ গ্রন্থটি একজন তালেবে ইলমের প্রথম ‘মতন’ (সংক্ষিপ্ত ইলমী ভাষ্য) হওয়া উচিত যা সে মুখস্থ করবে। আরব বিশ্বের অনেক দেশ যেমন, সৌদী আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, জর্দান, ইয়ামেন; অনুরূপভাবে আফ্রিকার অনেক দেশ যেমন, মিসর, লিবিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো, মৌরতানিয়া, সুদান, নাইজেরিয়া, সেনেগালসহ বহু দেশে যারা দীনের জ্ঞান অর্জন করে তাদেরকে প্রথমেই এ হাদীসগুলো মুখস্থ করানো হয়। সুতরাং, দীনী ইলম শিখতে আগ্রহী ব্যক্তির জন্য প্রাথমিক স্তরের শেষে বা মাধ্যমিক স্তরের শুরুতে এ গ্রন্থখানি অবশ্যই আয়ত্ব করে নিতে হবে। তাছাড়া দীনী ইলম শিখতে আগ্রহী এমন অনেক সাধারণ জ্ঞানপিপাসু রয়েছেন যারা প্রায়ই বলে থাকেন, কুরআন থেকে শিক্ষা গ্রহণের পরে প্রথম কোন্ গ্রন্থটি পড়ব, তাদের জন্য এটি অত্যন্ত উপযোগী। কারণ, এ গ্রন্থের হাদীসগুলোর সবই বিশুদ্ধ, কর্মমুখী ও সংক্ষিপ্ত শব্দ সম্পন্ন। উল্লেখ্য, সহীহ বুখারী ও মুসলিমের হাদীসের বিবিধ বর্ণনাকে এ গ্রন্থের লেখক অত্যন্ত সুন্দরভাবে সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। সেজন্য অনেকেই সেটার ব্যাখ্যা করেছেন। এ পর্যন্ত পঞ্চাশোর্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ আমার দৃষ্টিতে এসেছে। তাই আমরা প্রত্যেক মুসলিম ভাইকে অনুরোধ করবো, আপনারা নিজেরা এ কিতাবটি অধ্যয়ন করুন, আপনাদের সন্তানদেরকেও পড়তে দিন এবং মুখস্থ করতে বলুন। দীনের প্রাথমিক পাথেয় হিসেবে এটাকে তাদের হাতে তুলে দিন। ইনশাআল্লাহ আপনার সন্তান-সন্ততি দীনী ব্যাপারে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে বড় হবে, অপরাপর ছাত্রদের থেকে তাদের জ্ঞানের পরিধি বর্ধিত হবে। আর এর মাধ্যমে আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দো‘আপ্রাপ্ত হবেন, যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তা‘আলা এমন লোককে শুভ্র-আলোক উজ্জ্বল করে দিন, যে আমার কোনো কথা শুনেছে, তারপর তা মুখস্থ করেছে, তারপর যারা শুনে তাদের কাছে তা বর্ণনা করেছে...”।
ইমাম হাফেয তাকীউদ্দীন আবু মুহাম্মাদ আবদুল গনী ইবন আবদুল ওয়াহেদ আল-মাকদেসী আল-জুমা‘ঈলী আল-হাম্বলী রাহিমাহুল্লাহ। হিজরী ৫৪১ সালের রবিউস সানী মাসে বর্তমান ফিলিস্তিনের নাবলুস নগরীর “জামা‘ঈল” এলাকায় তাঁর জন্ম হয়। প্রথমেই তাঁর পরিবারসহ তিনি দামেশকে হিজরত করেন। ইলম অন্বেষণের জন্য অনেক দেশ তিনি সফর করেন। শুরুতে শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আহমাদ ইবন কুদামাহ আল-মাকদেসীর কাছে শিক্ষাগ্রহণ করেন। তারপর দামেশকের সে যুগের বিখ্যাত আলেমগণের সাহচর্য গ্রহণ করেন। তাদের থেকে ফিকহ ও অন্যান্য বিদ্যার জ্ঞান অর্জন করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন, শাইখ আবুল মাকারিম ইবন হিলাল, সুলাইমান ইবন আলী আর-রাহবী, আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবন হামযাহ আল-ক্বুরাশী। তারপর হিজরী ৫৬১ সালে তিনি বাগদাদ গমন করেন। সেখানে শাইখ আব্দুল কাদের আল-জীলানীর নিকট চার বছর অবস্থান করেন। সে সময় তিনি হাদীস ও ফিকহ শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তারপর হিজরী ৫৬৫ সালে তিনি দামেশকে প্রত্যাবর্তন করেন। সেখান থেকে তিনি ৫৬৬ হিজরীতে মিসর ও ইস্কান্দারিয়্যাহ গমন করেন। সেখানে তৎকালীন জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস হাফেয আবু তাহের আস-সিলাফীর কাছে অবস্থান করেন। ৫৭৬ সালে সিলাফীর মৃত্যু হলে তিনি সেখান থেকে ইসফাহান গমন করেন এবং সেখানে কিছুকাল অবস্থান করেন। তাঁর শিক্ষকগণের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- (১) আবুল ফাতহ ইবনুল বাত্তী, (২) আবুল হাসান আলী ইবন রাবাহ আল-ফাররা, (৩) ইবনুল মানী, (৪) শাইখ আব্দুল কাদের আল-জীলানী, (৫) হিবাতুল্লাহ ইবন হিলাল আদ-দাক্কাক, (৬) আবু যুর‘আহ আল-মাকদেসী, (৭) মা‘মার ইবনুল ফাখের, (৮) আহমাদ ইবনুল মুক্বাররাব, (৯) ইয়াহইয়া ইবন সাবেত, (১০) আবু বকর ইবনুন নাকূর, (১১) আহমাদ ইবন আব্দুল গনী আল-বাজেসরাঈ, (১২) হাফেয আবু ত্বাহের আস-সিলাফী, (১৩) মুহাম্মাদ ইবন আলী আর-রাহবী, (১৪) আব্দুল্লাহ ইবন বাররী, (১৫) আবুল মাকারিম ইবন হিলাল, (১৬) সালমান ইবন আলী আর-রাহবী, (১৭) আবুল মা‘আলী ইবন সাবের, (১৮) হাফেয আবু মূসা আল-মাদীনী। তাঁর ছাত্রগণের মধ্যে অন্যতম হলেন- (১) মুওয়াফফাকুদ্দীন ইবন কুদামাহ আল-মাকদেসী, (২) হাফেয ইয্যুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবন মুওয়াফফাকুদ্দীন ইবন ক্বুদামাহ, (৩) হাফেয আবূ মূসা আব্দুল্লাহ ইবন মুওয়াফফাকুদ্দীন ইবন ক্বুদামাহ, (৪) ফক্বীহ আবু সুলাইমান ইবন মুওয়াফফাকুদ্দীন ইবন ক্বুদামাহ, (৫) হাফেয দ্বিয়াউদ্দীন আল-মাক্বদেসী, (৬) খত্বীব সুলাইমান ইবন রাহমাহ আল-আস‘আরদী, (৭) শাইখ বাহা আব্দুর রহমান, (৮) শাইখ ফকীহ মুহাম্মাদ আল-ইউনীনী, (৯) আয-যাইন ইবন আব্দুদ দায়েম, (১০) আবুল হাজ্জাজ ইবন খলীল, (১১) আত-ত্বকী আল-ইয়ালযানী। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলির সংখ্যা ৫৬টি। তন্মধ্যে বিখ্যাত কয়েকটি হচ্ছে- (১) ‘উমদাতুল আহকাম, (২) আল-কামাল ফী আসমায়ির রিজাল, (৩) আল-মিসবাহ ফী ‘উয়ূনিল আহাদীসিস সিহাহ, (৪) নিহায়াতুল মুরাদ মিন কালামি খাইরিল ‘ইবাদ, (৫) তুহফাতুত ত্বালেবীন ফিল জিহাদি ওয়াল মুজাহিদীন, (৬) মিহনাতুল ইমাম আহমাদ, (৭) ই‘তিকাদুল ইমাম আশ-শাফে‘ঈ, (৮) মানাক্বিবুস সাহাবাহ, (৯) আন-নাসীহাহ ফিল আদ‘য়িয়াতুস সহীহাহ, (১০) আল-ইকতিসাদু ফিল ই‘তিক্বাদ, (১১) হাদীসুল ইফক, (১২) ফাদ্বায়িলি উমার ইবনুল খাত্তাব, (১৩) তালখীসু কিতাবিল কুনা লিল হাকিম, (১৪) আখবারুল হাসান আল-বসরী, (১৫) আশরাতুস সা‘আহ। তিনি ৬০০ হিজরীর রবিউল মাসের ২৩ তারিখ সোমবার মিসরে মারা যান এবং ক্বারাফায় তাকে দাফন করা হয়।