‘‘প্রিয় চন্দ্রিমা"বইটির ১ম ফ্লাপের কিছু কথা ও ভূমিকা: ভালােবাসা! সে কী? নিজের রঙ না হারিয়ে অন্যের রঙে রঙিন। হবার নাম ভালােবাসা ভেতরের রােদুরটাকে না লুকিয়ে অন্যের। ছায়ায় শান্তির নীড় খোজা ভালােবাসা।। ঝোঁকের বশে ধরে ফেলা হাতটাকে নিজের করে ভেবে নেয়াই ভালােবাসা। আসলে এ বড় গােলমেলে, বেখাপ্পা বােকামি, এর নামই তাে ভালােবাসা। লাভক্ষতির হিসেব না জানা অদ্ভুতরকম এক। মূর্খতাই ভালােবাসা। “আমি কত যােগ্য তুমি কত পিছিয়ে, তােমার সাথে কী করেই বা যায় আমার!” হয়ত যায় না! এই সহজ অংকটার কথা না। শােনা অনুভবগুলােই ভালােবাসা।। অন্ধ আবেগ তবু ঝড়ের মাঝে শক্ত মাটিতে। মুখ বুজে থাকাটা নেহায়েত গোয়ার্তুমি; নিকষ আমার হৃদয়ে আলাের একটু কিরণ। বােকা বােকা স্বপ্নের জাল বােনাই ভালােবাসা! সত্যি বড় তিকর, বড় যন্ত্রণার , বড়। ঝামেলাদায়ক অদ্ভুত এক রােগ বটে এই। ভালােবাসা। তবুও কিছু মানুষ আজীবন এই মরণব্যাধির রােগী যারা নিজেকে বিলীন করে হয় মৃত্তিকায় গড়া প্রতিমা আহামরি কিছু হয়ত নয় শুধু চায় হতে অর্কের প্রিয় চন্দ্রিমা।। - শারমিন আঞ্জুম । "প্রিয় চন্দ্রিমা" গল্পের নামের মাঝেই ছুঁয়ে আছে কেমন যেন একটা আপন আপন ভাব। একটা মিষ্টতা। চন্দ্রিমা বা ইমা যেন আমাদের পাশের বাড়ীর শান্ত, স্নিগ্ধ, শ্যামলবরণ মেয়েটি। সাধারণ দেখতে হলেও মেয়েটি প্রখর অনুভূতি সম্পন্ন তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারিণী। জন্মলগ্ন থেকেই যার জন্য কেউ একজন নির্দিষ্ট হয়ে আছে। অর্ক, যার চোখের সামনে ইমার জন্ম আর বেড়ে ওঠা। সময়ের ব্যবধানে সেই অর্ক ইমার মাঝে দূরত্ব তৈরী হয়। যদিও তখনাে মুখে প্রকাশ হয়নি ভালােবাসার কথা। তবুও অবচেতনে দুজনে দুজনার বিশ্বস্ত সঙ্গী। | একসময় মেধাবী অর্ক নিজের উচ্চশিক্ষার স্বপ্নপূরণে বিলেত পাড়ি জমায়। এদিকে অর্কের পরিবার মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তে শ্রেণীতে উপনিত। তাই পুত্র গরবে গরবিনী মা ভুলে যান ইমার পরিবারের প্রতি আন্তরিকতা। এদিকে বাল্যপ্রেমের ঘাের কাটিয়ে বিলেতে স্বপ্নপূরণের ঘােরে মগ্ন অর্ক ওরফে নাইমের জীবনে আসে কিছু কঠিন বাস্তবতা। অর্কের উচ্চাশার স্বপ্ন পূরণে জীবনের সাথে করা কপ্রােমাইজ যেন আমাদের চেনা গল্পই। | নিজের স্বপ্নপূরনের পর বাস্তবে ফেরা অর্কের অবচেতনের ইমা তখন জেগে উঠে। সেই ইমা আর নেই আগের মতাে। সেও এখন নিজের মেধার প্রকাশ ঘটিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছুতে ব্যস্ত। দুজনের বেছে নেয়া দুটা পথে আবার কখন যােগসূত্র তৈরি হলাে, আবার অজান্তেই তারা প্রেমে পড়ল। কিন্তু ততদিনে বাস্তবতা পরিবর্তন হয়ে গেছে।অর্কের সামনেও আসে তার অজানা অতীত। অর্কের মনে দ্বিধার ঝড়। তার প্রিয় চন্দ্রিমাকে সে কোন অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির মুখােমুখি করতে চায়না। এই ঝড়ের মােকাবেলা করতে তাদের ভালােবাসা কী যথেষ্ট শক্তি রাখে? তারা কী সাহস নিয়ে এগিয়ে যাবে, না লাভ ক্ষতি বিচার করে এখানেই থেমে যাবে তাদের পথচলা? ভালােবাসা কী আসলেই হিসেব করে হয়? উচ্চাশা পূরণে বিবেকের দংশন সহা কতটা যুক্তিযুক্ত? সত্যি ভালােবাসার ভিত্তি হলাে বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবােধ আর মানসিক বােঝাপড়া। সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে চন্দ্রিমা কি পেরেছিল প্রাণহীন মাটির প্রতিমা থেকে অর্কের শক্তি হতে? তার ভালােবাসার আলােয় উদ্ভাসিত প্রিয় চন্দ্রিমা হয়ে উঠতে? | অর্ক আর চন্দ্রিমা ছাড়াও আরাে কিছু চরিত্র মন কাড়ে গল্পে। ইমার বাবা নজরুল সাহেব ভাড়াটিয়া বাড়িওয়ালির চিরপরিচিত মধ্যবিত্ত খুনসুটি নিগার, নিলুফারের সম্পর্ক যা আরােপিত নয় মােটেও। বাঙালী মায়েদের সন্তান বাৎসল্যের উদাহরণ এই চরিত্রগুলাে আমরা সহজেই আশেপাশেই দেখতে পাই। অবন্তী, সজল, তানিম, পাভেল, সবার কিছু না কিছু ভুমিকা আছে গল্পটায়। আরাে একটি উল্লেখযােগ্য চরিত্র এলিজা হার্লে বা লিজা। যেটা কাল্পনিক হলেও অতিরঞ্জিত মনে হয়নি মােটেও। ভালাে মতাে ভেবে দেখলে এই বিশ্বায়নের যুগে প্রবাসী কোন তরুণের সাথে এমন চরিত্র দেখা পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। লিজা ও তার চিন্তা ভাবনার প্রতি সঠিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করা হয়েছে তবে আমার মতে চরিত্রটায় আরেকটু ব্যাপ্তি দেয়া প্রয়ােজন ছিল। | প্রিয় চন্দ্রিমা উপন্যাসটায় মূল গল্পের সাথে সমান্তরাল ভাবে রয়েছে কিছু পার্শ্ব গল্প। যেমন অবন্তীর মেকি সামাজিকতা রক্ষার নামে তিক্ত দাম্পত্যর গল্প তার মন মানসিক দ্বন্দ্ব, মেডিকেল কলেজের মতাে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে চোখের আড়ালে ঘটে যাওয়া কিছু সামাজিক নােংরামি ও তার সম্ভাব্য প্রতিকার সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। | ডাক্তার হওয়ার পেছনে ইমার কঠিন পরিশ্রম ও অবশেষে ডাক্তার শবনমে পরিণত হবার গল্পটা অসাধারণ। একজন চিকিৎসক হিসেবে তার মানবিকতা আর দায়িত্বশীল আচরণ হৃদয় ছুঁয়েছে। মধ্যবিত্ত চেনা জীবনের পাশাপাশি সেলুলয়েডের জগতের কিছু ঘটনাও এসেছে গল্পের প্রয়ােজনে যা গল্পে ভিন্ন একটা মাত্রা দিয়েছে। মানুষের উচ্চাশার তৃষ্ণার এক ভয়াবহ রূপ দেখানাের চেষ্টাটা ভালাে লেগেছে। সব মিলিয়ে মিষ্টি মন ছুঁয়ে যাওয়া পারিবারিক একটা গল্প। যার মাঝে আছে নানা নাটকীয় মােড়। চমৎকার মনে দাগ কাটার মতাে কিছু সংলাপ। পড়তে গিয়ে মনে হয় খুব কাছের মানুষগুলাের গল্প হলাে প্রিয় চন্দ্রিমা। যা পাঠক হৃদয়ে স্থান করে নেবে বলেই আমার বিশ্বাস।