"জলের দেশে স্থলপদ্ম" বইটির 'গল্পের গল্প' নামক অংশ থেকে নেয়াঃ “পম সাে ব্লাফ, মে ফ্লেয়...” চঞ্চুতে খড় নিয়ে উড়ে যাওয়া একটা কবুতরকে নিয়ে আমি গল্প ফঁদতে চেয়েছিলাম, এবং সেই পঁাচাটাকে নিয়ে, যে মধ্যরাতে আমার জানালার শার্সিতে বসে আমার একাকিত্বের ঘনত্ব কমিয়ে এনেছিল। সঁওতাল রমণীর সাথে বাংলা মদ গিলতে গিলতে আমি রাত্রিকালীন নিস্তব্ধতা উপভােগ করেছি, তাকে নিয়েও একটা গল্প লেখার কথা ছিল আমার। ‘জলের দেশে স্থলপদ্ম’ নামক দীর্ঘ লেখাটা যখন লিখেছি, তখন আমার বুকে হাঁটু সমান বন্যার জল। চারদিকে থইথই পানি, অথচ একফোটাও পানযােগ্য নয়। আমি তৃষ্ণায় কাতর হয়ে লেখা শেষ করে সম্পাদনার জন্য যখন পুনরায় পড়ছিলাম, মনে হচ্ছিল— লেখাটাকে কুচি কুচি করে ছিড়ে যদি উড়িয়ে দিতে পারতাম— হয়তাে আমার তৃষ্ণা মিটত। কিন্তু তা পারিনি বলে— লেখাটা এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। নয়টা গল্পের মধ্যে— “পিপড়া এবং রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ শীর্ষক গল্প দুটি অনলাইনে প্রকাশ করেছিলাম। কিন্তু আমার মনে হয়েছে এই লেখা দুটোর গ্রন্থভুক্ত হওয়ার যােগ্যতা আছে। কাজেই একদম নতুন সাতটি গল্পের সাথে পূর্ব প্রকাশিত লেখা দুটোও যুক্ত করে দেওয়া হলাে। বিজ্ঞ পাঠক আমার এই অপরাধ ক্ষমা করবেন ভেবে আমি আশা বেঁধে বসে আছি। লেখক দুই ধরনের— Outliner Ges Pantser Outliner হলেন তারা যারা লেখার আগে একটা ছক কষে লিখতে বসেন। ঘটনাপ্রবাহ, চরিত্র সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত থাকে। এই ধরনের লেখকরা গল্পের শেষ লাইনটা সবার আগে লেখেন। Pantser লেখকরা যাযাবরের মতাে, কোথায় কখন রাত কাটাতে হবে, দুপুরে কীসের মাংস পুড়িয়ে খাওয়া হবে কিছুই জানা থাকে না। এরা একটা চরিত্র ঠিক করেন এবং ঈশ্বরের নামে লিখতে শুরু করেন, পাঠক যেমন পড়তে পড়তে গল্প জানতে পারেন, এই লেখকরা লিখতে লিখতে নিজের গল্প জানেন। আমি সম্ভবত এই দুই পক্ষের কোনােটাতেই বিলং করি না। কেননা লেখার পূর্বে আমার একটা প্ল্যান থাকে, আমি জানি আমার চরিত্রগুলাের পরিণতি কী হবে কিন্তু কীভাবে সেই পরিণতিতে পৌঁছব তা আমি জানি না। সেটা জানার জন্যই আমি গল্প লিখেছি। তবে এই গ্রন্থের একটি গল্প, যার নাম অলমােস্ট অটোবায়ােগ্রাফি’, এই লেখাটা আমি শতভাগ Pantser হিসেবে লিখেছি। লিখতে বসার পূর্বে আমার মাথায় ছিল শুধু একটি বাক্য, ‘একজন কবি, যিনি নিজের শ্রেষ্ঠ কবিতাটা লিখতে চান, যা তিনি লিখতে পারেননি এখনও। টাইপরাইটারের পাশে বােতল ভরতি সস্তার মদ, দশ টাকা দামের সিগারেটের প্যাকেট আর মাথায় শুধু ওই একটা বাক্যকে আশ্রয় করে আমি লিখতে আরম্ভ করেছিলাম। লেখা শেষ করে, পাকস্থলী ভরতি অ্যালকোহল নিয়ে আমি যখন ঘুমাতে গিয়েছি— তখন আমার কোনাে গল্পের কথা মনে ছিল না, আমি জানতাম না আমি কী লিখেছি, কেন লিখেছি। “মো সাে ব্লাফ, মে ফ্লেয়...” এই কথাটা বােদলেয়ারের। তিনি পাঠককে বলেছেন, “হে কপট পাঠক, দোসর...জমজ ভাই আমার।' এই বক্তব্যের সাথে একমত বলেই লেখার প্রথমে সম্বােধনে এই বাক্য লেখা হয়েছে। পাঠক যখন লেখকের বই হাতে তুলে নেন, আদতে তাদের মধ্যে আর কোনাে পার্থক্য থাকে না, যেন ওরা একে অন্যের প্রতিবিম্ব। গল্প লিখতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, কেউ আসলে নিজে ঠিক করতে পারে না যে আজ থেকে আমি লিখব, আমি লেখক হবাে। বরং অপার্থিবভাবে লেখা নিজেই একজন উপযুক্ত মানুষ খুঁজে বের করে, যার মাধ্যমে ওরা পৃথিবীতে অবতীর্ণ হতে চায়। লেখা নিজেই খুঁজে বের করে এমন একজন মাতাল মানুষকে, লেখা নিজেই নিজের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করার জন্য ওই মাতালের উপর ভর করে। আমি লিখছি, লিখে চলেছি, শুধু এটা জানার জন্য লেখাগুলাে পৃথিবীতে আসার জন্য আমাকে বেছে নিয়েছে কি না! যদি কখনাে জানতে পারি, ওরা আমাকে বেছে নেয়নি, আমি জোর করে ওদের জন্ম দিয়েছি, বৃদ্ধ দারােয়ানের ঘুম ঘুম চোখের কসম আমি সেদিন থেকে লেখালেখি ছেড়ে দেব।