"পথের পাঁচালী" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ ‘পথের পাঁচালী’ ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয়। একটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম, শ্রেষ্ঠ, কালােত্তীর্ণ এবং পাঠক সমাজে লেখকের জনপ্রিয়তার সৌধ সৃষ্টিকারী উপন্যাস। বাংলা উপন্যাসের ধারায় দক্ষতার বিচারে অথবা প্রিয়তায়, বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথশরৎচন্দ এবং তারাশঙ্কর-মানিক-বিভতিভষণ প্রায় এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত নাম। এঁদের মধ্যে বিভূতিভূষণ ব্যতিক্রম এবং বলবাে সৌভাগ্যবান এ কারণে যে, প্রথম উপন্যাসেই তিনি শ্রেষ্ঠতম অর্জনটুকু অধিকারে নিলেন। অবশ্য, তাঁর লােকপ্রিয়তার পেছনে ‘পথের পাঁচালী’ সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রায়ন এবং সাফল্য কম কার্যকর ছিল না। ‘পথের পাঁচালী’ সৌভাগ্য, এর প্রকাশের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের বেশ কয়েকজন কৃতী পুরুষ যুক্ত ছিলেন। প্রকাশ-পূর্বে শনিবারের চিঠির আসরে তা পঠিত হওয়ায় গুণী ও পাঠক মন্তব্যও পাওয়া যেত। সাময়িকপত্র মাসিক বিচিত্রায় ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যা থেকে ‘পথের পাঁচালী' ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হতে থাকে। বিচিত্রার সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বিভূতিভূষণের দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে জানিয়েছেন যে, এর আগে প্রবাসী পত্রিকা কর্তৃপক্ষ উপন্যাসটি ছাপাতে চায় নি, পাণ্ডলিপি ফেরত দিয়েছে। প্রবাসীর সহকারী সম্পাদক ও শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাস এবং সাহিত্যিক গােপাল হালদারের আগ্রহে নব প্রতিষ্ঠিত রঞ্জন প্রকাশালয় থেকে 'পথের পাঁচালী' গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রকাশকালে উপন্যাসটি চার পর্বে বিভক্ত ছিল; বল্লালী বালাই, আম-আঁটির ভেঁপু, উড়াে পায়রা, অক্রুর সংবাদ। দ্বিতীয় প্রকাশকালে আম-আঁটির ভেঁপুর সঙ্গে উড়াে পায়রা একীভূত হয়। ‘পথের পাঁচালী’ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তবর্তীকালীন বিশেষ ধারার উপন্যাস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশংকা যখন মানুষের মনে। উদ্বেলতার সৃষ্টি করেছে, তখন পাশ্চাত্য মতবাদ নিষ্ঠতায় আস্থা স্থাপন করে অনেকে সংকট উত্তরণের চেষ্টা করেন। রােমাঞ্চকে কেউ কেউ বলেন বয়স্কদের রূপকথা। বাংলায় প্রকৃত উপন্যাস, যাকে মহাকাব্যের পরিবর্তিত সমাজের শিল্পিত রূপান্তরও বলা যায়- এসেছে এ রােমাঞ্চের পথ অতিক্রম করেই বিভূতিভূষণ দরিদ্র চরিত্রগুলাের সমাবেশ ঘটিয়ে কোন দুঃখগাথা তৈরি করতে চান নি, অথবা চান নি প্রলেতারিয়েতের শ্রেণি-বিপ্লব ঘটাতে। তাঁর আয়ােজন গতানুগতিক মনে হলেও লক্ষ্য ভিন্ন। তিনি যুগের অস্থিরতায় না জড়িয়ে আবহমানকালের চিরস্থায়ী, চিরসাক্ষী এবং একটি পরিপূর্ণ সত্তা নিসর্গ-প্রকৃতিকে অবলম্বন করলেন উপন্যাসে। বিভূতিভূষণের উপন্যাসে প্রকৃতি এসেছে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে আর মানুষগুলাে রূপায়িত হয়েছে সুখ-দুঃখের পরিপূর্ণতা নিয়ে। পথের পাঁচালী পুরাে পথই নিসর্গ-প্রকৃতি পরিবেষ্টিত এবং মানব-সংশ্লিষ্ট। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার অধিকাংশ উপন্যাসেই এই প্রকৃতিকে অবলম্বন করেছেন দৃঢ়ভাবে, নির্মাণ করেছেন। একটি পুরাে সত্তাকে। 'পথের পাঁচালী’ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। উপন্যাসটির প্রধান তিনটি অংশের প্রথম অংশ বল্লালী বলাই।' এ অংশের অনুচিন্তনের কেন্দ্রে হলেন ইন্দির ঠাকরুন। ইন্দির ঠাকরুন একটি বহমানতার স্বাক্ষী, কালের বহমানতা। সেকেলে ইন্দির ঠাকরুনের মুখে উপন্যাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রকৃতির শাশ্বত প্রবহমানতা- ঠাকুরঝির পুকুর, নিশ্চিন্দিপুরের ইতিহাস ইত্যাদি। ইন্দির ঠাকরুনের নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হিসেবেও এসেছে প্রকৃতি। উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশের নামকরণেই প্রকৃতির অনুষঙ্গ ‘আম-আঁটির ভেপু।' এ অংশে প্রকৃতি সবচেয়ে গভীরভাবে, বলা যায় সশরীরে হাজির হয়ে অপুকে কোলে তুলে নিয়েছে, তাকে বিকশিত করেছে ধীরে ধীরে। অপু আর প্রকৃতি হরিহর আত্মা। হয়তাে সেজন্যই নিশ্চিন্দিপুর থেকে বিদায়ের সময় প্রকৃতি সমস্ত পথ তাকে চোখে চোখে রেখেছে। ট্রেনে বসেও অপু বাইরে না তাকিয়ে পারে নি। শুধু অপু নয় এ উপন্যাসে প্রতিটি চরিত্রকে প্রকৃতি ঘিরে রেখেছে গভীর মমতায়। হরিহরের অবর্তমানে প্রকৃতি এই দারিদ্র পরিবারটির আহার সংস্থান করেছে। অপুর চরিত্রে প্রকৃতি যে প্রভাব ফেলেছিল দুর্গা চরিত্রে সে তুলনায় তার খুব একটা কম প্রভাব পড়ে নি- প্রকৃতির কোলে দুর্গাও মিশেছিল। তাই নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে চলে যাবার সময় অপুর মনে হয়েছে: ‘দিদি মারা গেলেও দু'জনের খেলা করার পথে ঘাটে বাঁশ বনে আমতলায় সে দিদিকে যেন এতদিন কাছে কাছে পাইয়াছে। শুধু চরিত্র বিন্যাস ও পরিবেশ পরিকল্পনাতেই নয়, উপন্যাসের ভাষা, বাক্য-বিন্যাস, অলঙ্কার, চিত্রধর্মিতা, চলমানতা মােটকথা গঠনশৈলীতেও প্রকৃতি নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে। বিভূতিভূষণ তাঁর উপন্যাসে ধীর লয়ে বর্ণনাত্মক ভঙ্গিতে সব কিছু বর্ণনা করেছেন, কোন কিছুই তার দৃষ্টি এড়ায় নি। বাঁশের পাতার শব্দ, বেগুন বিচি খেলা, গন্ধভেদলি পাতার গন্ধ- এসবেরই শব্দ-বর্ণ-গন্ধ তার অনুভবে এসছে। উপন্যাসটিতে ভাষার উপর যেমন কোন রুক্ষ কারুকাজ নেই, তেমনি নেই অলঙ্কারের আতিশয্য। জনপ্রিয়তার বিচারে উপন্যাসটি আজও ঈর্ষণীয় স্থানে, তবু কালপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে এটি কখনও-কোথাও আপ্ত-মূল্যায়নের গণ্ডিতে আবদ্ধ এবং সেই সূত্রে গতানুগতিক ধারার বলেও কথিত। নামকরণ, গঠনবিন্যাস, শব্দ-বর্ণ, চরিত্র রূপায়ন, প্রকৃতি, বিষয় বৈশিষ্টের বিচারে বাংলা সাহিত্যে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয় নাম; বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যার প্রায় সবটুকুই ‘পথের পাঁচালী’র অর্জন।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।