রাত তখন একটা বেজে কিছু মিনিট পেরিয়ে গেছে। ক্লাস নাইনে কি টেনে পড়ি। সামনে পরীক্ষা। মা আমায় পড়তে দিয়ে পাশের রুমে টকশো দেখছে। কিন্তু আমিতো মানুষ বেশি সুবিধার না তাই ফাঁকি মেরে অংক করার বদলে সাদা কাগজে কাব্যরচনা করায় ব্যস্ত! আর সেদিন রাতে দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্যবশত ধরা খেয়ে গেলুম বেমালুম। কি ভীষণ একটা থাপ্পড় খেয়েছিলাম মামনীর! সে আমার জন্য রাত জেগে বসে আছে আর আমি কিনা কাব্যচর্চা করে এই পৃথিবী বাঁচানোর দায়ভার নিয়েছি। সেই মামনীই একদিন অনেকগুলো বছর পর ২০২০ সালের লকডাউনে একটা ঝিম ধরা সন্ধ্যায় চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “লেখালেখি নিয়ে জীবনে এত বকাঝকা শুনলি, এখন লেখেননা কেন! জানতে পারি? গঁসঁ, ুড়ঁ ংযড়ঁষফ ৎিরঃব.” গোটা একটা উপন্যাস লিখে ফেলার সাহস আমি এত সহজেই পেতাম না (কিংবা পেতাম জানিনা ) যদি না মা বলতো যে আমার লেখা উচিৎ। উচিৎ শব্দটার শোনার পর থেকে আমার কাল্পনিক নদীর বুকে ঝড় ওঠে। মনে হতে থাকে আমি কোনো অনাবিষ্কৃত জঙ্গলের মাঝে পুরোনো ধসে পরা অট্টালিকার প্রহরী। দুবেলা ভাত না জুটুক, দুপাতা ভরা ঠাসা ঠাসা শব্দই আমার শেষ তৃষ্ণার জল। কখনো একা একাই হাসতাম, অকারনে কাদতাম, আধো স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতাম অদৃশ্য হুক্কা হাতে। সেই অট্টালিকার শ্যাওলাধরা দেয়ালের গন্ধ্য আমায় জাগিয়ে রেখেছিল রাতের পর রাত হাতে কলম, চোখের সামনে কখনো সাদা কাগজ হাতে, কখনো ঝকঝকে স্ক্রীনের সমুখে। আমার বোবা মুখ দেখে সেই জঙ্গলের পাখিরা কানাঘুষো করতো, -ও কি কথা কইতে পারেনা? -পারে পারে। -তাইলে কয়না ক্যালা? -ওরে বোবা ভূতে ধরসে। এত সহজে ছুটকারা নাই। দেহস না সারাদিন কি কি ভাবে। -থাউক ও ওর মত। চলো পুচকির বাপ আমরা ওই ডুমুর গাছের ডালে বসি। -হ্যাগা চলো। তবে কই, ওর যদি এই দশার ঠিক না হয় তখন? -তুমি অতো ভাবিওনা বাপু। গতি একখান হইয়াই যাইবো। না হইলে আর কি। এহেনেই ভূত হইয়া টইটই করবো। আমিও ভাবছিলাম সত্যিই কি ভূত টুত হয়ে ঘুরঘুর করতে হবে নাকি আজীবন? ইয়া মাবুদ! আমার যদি গতি না হয়? তারপর আস্তে আস্তে নিজের মত করে হেটে হেটে চরিত্রগুলো এসেছিল সাবলীলোভাবে। কাওকে আমার ধরে বেধে আনতে হয়নি কিংবা ছিলনা কোন জোরজবরদস্তি। তারা যেন যুগ যুগ ধরেই ছিল সেই অট্টালিকায়। শুধু মানুষেরা চিনতোনা। এখন বুঝি সময় হয়েছে আত্মপ্রকাশের। এভাবেই হঠাৎ এক অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকারে সব ফুরিয়ে গেলো। বোবা ভুত পুড়ে ছাই হয়ে উরে গেল। আমার অট্টালিকার পাশে কারো বেহালার সুর কেটে গেলো! আর জন্ম নিলো ঝাঁঝি শ্যাওলা!
সাল ১৯৯৯। কার্তিক মাসের প্রথম শীতে বরিশালে জন্ম। শৈশব কেটেছে টেকনাফে নাফ নদী আর পাহাড়ের কোলঘেষে আকাশের গাঢ় নীল আর গহীন সবুজে। কখনো মা-বাবার হাত ধরে বার্মিজ মার্কেটে টু মারা গুটিগুটি পায়ে। এলন্টি লন্ডন, ঘড়ি বাজে টান্টিন, এক দুই তিন! সাইকেল, গোল্লাছুট, দেয়াল পেরিয়ে দিঘি, ধুলো মাখা উচ্ছ্বল হাসি, বাবার জোর করে গান শেখাতে নিয়ে যাওয়া, নিজে দাপাদাপি করে নাচতে চলে যাওয়া, শখের বসে আঁকতে বসা এভাবেই কেটে যায় কৈশোর টুপ করে ঢাকার দোহার ও নারায়ণগঞ্জে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে এসে ধরা পরা এই জাদুর শহরে। অট্টালিকার ফাঁকফোকর দিয়ে খুঁজে চলা শৈশব কৈশোরের আকাশ। জীবন যেদিকেই মোড় নিয়ে যাক, ছোট থাকতে বুকশেলফ থেকে যে বই টেনে বের করেছিলো, সেই বই নিয়েই এখন তার ঘর-সংসার-স্বপ্ন-না বলা হাহাকারে জমে ওঠা নীল ডায়েরি। বর্তমানে অধ্যয়নরত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ তে। পাশাপাশি জড়িত আছে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে, কাজ করেছেন বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রজেক্টে ও মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে। আর এই ঝাঁঝি শ্যাওলাই লেখক হিসেবে প্রথম আত্মপরিচয়। স্বপ্ন দেখে ঘুরে বেড়াবে আচলে কলম ঝুলিয়ে হৃদয়কে দিস্তা কাগজ বানিয়ে এই দেশ থেকে সেই দেশ, কখনো ইতালির ভেরোনিকা শহর, পরদিন সন্ধেবেলা কোন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় কিংবা কোনো শরণার্থী ক্যাম্পে আর গল্প লিখলেন তাদের নিয়ে যাদের নিয়ে কেউ ভাবে না, যাদের কেউ ভালোবাসে না।