মানুষ রহস্যময়তা পছন্দ করে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই সে সেটা বুঝতে পারে না। জীবনভর সে তার প্রিয়তম মানুষটিকেও পুরােপুরি বুঝে ফেলতে চায়, কিন্তু পুরােপুরি বােঝা হয়ে গেলে তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সে আসলে অবচেতনে সবসময়ই অনুদঘাটিত কিছু রহস্য উদঘাটন করতে চায়। যতক্ষণ অবধি সেই রহস্য থাকে, ততক্ষণ অবধি একটা প্রবল আগ্রহ, আকর্ষণ কাজ করে । রহস্য শেষ হয়ে গেলে আকর্ষণ ফুরিয়ে যায়। অথচ জীবনজুড়েই সে ভাবে, সে রহস্য পছন্দ করে না। মানুষের ভেতরে এই দ্বান্দ্বিক সত্ত্বাটা আছে। মানুষ ভাবে, সে ভয় পেতেও পছন্দ করে না, নৃশংসতা পছন্দ করে না। কথা সত্য না। সে অতি আগ্রহ নিয়ে গা হিম হয়ে আসা হরর সিনেমা দেখে, ভূতের বই পড়ে, সিরিয়াল কিলারের ভায়ােলেন্ট মুভি দেখে, সাহিত্য পড়ে। এ কারণেই শিল্প-সাহিত্যে বৈচিত্র্যময় নানান ঘরানার সৃষ্টি হয়েছে। রহস্যোপন্যাস সাহিত্যের সেরকমই একটি সমৃদ্ধ শাখা। এই শাখাটির প্রতি আমার আগ্রহ একদম শৈশবেই। তবে তা শুধুই পড়ার জন্য, লেখার জন্য নয়। কারণ, এই ঘরানাটিকে আমার খুবই কঠিন এবং একই সাথে গাণিতিক ক্যালকুলেটিভ’ মনে হয়। ফলে এতােদিনে কখনােই রহস্যোপন্যাস লেখার কথা আমি ভাবিনি। তাহলে এই উপন্যাসটি কেন লিখেছি? এই উপন্যাস লেখার কারণটা মজার। বহুবছর আগে এক দৈনিক পত্রিকায় হঠাৎ করেই একটি খুনের ঘটনা পড়েছিলাম। ঘটনাটি খুবই সাধারণ। পুলিশ লাশসহ খুনিকে গ্রেপ্তারও করেছে। কিন্তু তারপরও একটা রহস্য রয়ে গেছে। সেই রহস্যের কোনাে কুল কিনারা করতে পারছে না পুলিশ। বিষয়টা আমার মাথায় গেঁথে গেলাে। কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারছি না। অবচেতনেই ঘুরেফিরে বারবার মাথায় চলে আসতে লাগলাে সেই ঘটনা। এই করতে করতেই আচমকা একদিন একটা গল্পও চলে এলাে মাথায়। সেই গল্প লিখেও ফেললাম। লিখতে গিয়ে হঠাৎই আবিষ্কার করলাম, গল্পের প্রধান চরিত্রটিকে আমি বিশেষ পছন্দ করে ফেলেছি। এই চরিত্রটি নিয়ে আমি ধারাবাহিকভাবে আরাে লিখতে চাই। প্রতিটি বইতে সে একেকটি রহস্যের সমাধান করবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, রহস্য গল্প লেখা কঠিন। এই কঠিন কাজটি আমি নিয়মিত করতে পারবাে কিনা, সেটি নিয়ে খানিক সংশয়ও আছে। সেই সংশয় নিয়েই আমার প্রথম রহস্যোপন্যাস ছদ্মবেশ। ‘ছদ্মবেশ’ শেষ অবধি রহস্যোপন্যাস হয়ে উঠতে পেরেছে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত পাঠকের।
"শেষ অধ্যায় নেই" ভূমিকা থেকে লেখা: একটি ধারাবাহিক চরিত্র নির্মাণের ইচ্ছে থেকেই মূলত রেজা সিরিজের শুরু। তবে সেই শুরুটা ছিল দারুণ সংশয়পূর্ণ। এর মূল কারণ আমার অভ্যস্ত পরিসর বা ‘কম্ফোর্ট জোন’ থেকে বেরিয়ে এসে রহস্যোপন্যাস লেখার চেষ্টা। যাকে আমি বরাবরই দুঃসাহসী চেষ্টা বলে স্বীকার করেছি। ফলে এই সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘ছদ্মবেশ’ লিখেছিলাম একদমই পরীক্ষামূলক হিসেবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেই পরীক্ষায় পাঠক সম্ভবত আমাকে পাস মার্কস দিয়ে দিয়েছেন। কারণ প্রথম উপন্যাসের পর দিন যত গড়িয়েছে, ততই এর পরবর্তী উপন্যাসের দাবি উচ্চকিত হয়েছে। বিষয়টি একই সঙ্গে আনন্দ ও শঙ্কার। কারণ প্রথম বইটি নিয়ে কারােই কোনাে প্রত্যাশা ছিল না, কিন্তু দ্বিতীয় বইটি নিয়ে তা তৈরি হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, এই প্রত্যাশা পূরণের ভাবনা নিয়ে আমি লিখতে পারি না। কারণ লেখক হিসেবে আমি স্বতঃস্ফূর্ত। আমার ইচ্ছের অধীন। সেই ইচ্ছে শেষ অবধি আমাকে দিয়ে শুধু আমার গল্পটিই লিখিয়ে নেয়। সেই গল্প কখনাে কখনাে অন্য সবার গল্পও হয়ে ওঠে, কখনাে কখনাে হয় না। শেষ অধ্যায় নেই আমার তেমনই একটি গল্প। তবে লেখক হিসেবে লােভ হয়, আমার এই গল্পটিও অন্য সবার গল্প হয়ে উঠবে। - সাদাত হােসাইন
স্নাতকোত্তর, নৃবিজ্ঞান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সাদাত হোসাইন নিজেকে বলেন গল্পের মানুষ। তাঁর কাছে চারপাশের জীবন ও জগত, মন ও মানুষ সকলই গল্প। তিনি মনে করেন, সিনেমা থেকে পেইন্টিং, আলোকচিত্র থেকে ভাস্কর্য, গান থেকে কবিতা- উপন্যাস-নাটক, সৃজনশীল এই প্রতিটি মাধ্যমই মূলত গল্প বলে। গল্প বলার সেই আগ্রহ থেকেই একের পর এক লিখেছেন- আরশিনগর, অন্দরমহল, মানবজনম, নিঃসঙ্গ নক্ষত্র, নির্বাসন, ছদ্মবেশ, মেঘেদের দিন ও অর্ধবৃত্তের মতো তুমুল জনপ্রিয় উপন্যাস। ‘কাজল চোখের মেয়ে’, তোমাকে দেখার অসুখ'সহ দারুণ সব পাঠকপ্রিয় কবিতার বই। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বোধ, দ্য শুজ, প্রযত্নের পাশাপাশি' নির্মাণ করেছেন 'গহীনের গান' এর মতো ব্যতিক্রমধর্মী পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও। জিতেছেন জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকার পুরস্কার, এসবিএসপি-আরপি ফাউন্ডেশন সাহিত্য পুরস্কার, পশ্চমিবঙ্গের চোখ সাহত্যি পুরস্কার, শুভজন সাহিত্য সম্মাননা ও এক্সিম ব্যাংক- অন্যদিন হুমায়ূন আহমদে সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯। তাঁর জন্ম ১৯৮৪ সালের ২১ মে, মাদারীপুর জেলার, কালকিনি থানার কয়ারিয়া গ্রামে।