“মুক্তিযুদ্ধের গল্প" বইটির ফ্ল্যাপ এর লেখাঃ বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সব থেকে গৌরবময় অধ্যায় হচ্ছে ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জন। আর এই গৌরবময় অধ্যায়ের মধ্যমণি ও মহানায়ক হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সুযােগ্য ও সফল নেতৃত্বে বাঙালি জনগণ জেগে উঠেছে, ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তিনি বাঙালি জনগণকে একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি একাত্তরের ২৬ শে মার্চ এদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন। ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক আপামর জনগণ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যদের বিরুদ্ধে, কুলাঙ্গার বাঙালি রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এদেশকে স্বাধীন করেছে। যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ বাঙালি আত্মাহুতি দিয়েছেন, মা-বোেনরা সম্ভ্রম হারিয়েছেন। সংক্ষেপে এই হলাে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চিত্র। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় নিয়ে অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। অনেক গ্রন্থ পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। অতি সম্প্রতি হাতে পেয়েছি আফতাব হােসেন এর লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ গ্রন্থখানি। মূলতঃ রংপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা গ্রন্থখানির। স্নেহভাজন লেখক আফতাব হােসেন একজন সাংবাদিক। সেই সাথে রংপুর অঞ্চলের শেকড়সন্ধানী ও ইতিহাস মনস্ক লেখকও। তাঁর লেখায় রংপুর অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি ফুটে উঠেছে। ‘বাদশা ও শহিদ মিনার’ শীর্ষক লেখায় ফুটে উঠেছে আঞ্চলিক ভাষায় রংপুর অঞ্চলের হারানাে অতীত সময়ের একটি বাজারের দৃশ্য। যেখানে বর্ণিত হয়েছে এলাকার বিভিন্ন গ্রামের কৃষিজীবী, ব্যবসায়ী, পাইকার, হাওয়াইকারেরা কাজ শেষে দলবেঁধে আসে মাহিগঞ্জ বাজারে। কেউ জৈব সারে ফলানাে দেশি ধান, পােলাও-কাউনের চাল, আলু, সরিষা, পাট, তামাক, সুপারি, বিষমুক্ত গাছের পাকা আম-কাঁঠাল, জাম, ডালিম, পেয়ারা, লটকো, লিচু, নেওয়া আনে বাজারে। বাড়ির পােষা গরু-ছাগলের খাঁটি দুধ, পুকুরবিলের তাজা মাছ। ভিটার আদা, হলুদ, মরিচ, রসুন, পেঁয়াজ, শাক-সজি। ফরমান-কালুর মিষ্টির দোকানে আমিত্তি, বুট-বুন্দিয়া, পানের দোকানে পান খায়'। সহজ-সরল গ্রামীণ জনগণের জীবনচিত্রকেও লেখক স্থানীয় ভাষায় কত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন বাজার যাওয়া-আসার পথে চলে কতাে গল্প। মজিবর বলে ফরমান চাচার ব্যাটা বাদশা, মুই, বক্কর ভাই, কাদের, মহুবর ইছামতি নদীত সাঁতার কাটছি, কলার ভুরাত ভাসি বেড়াইচি, কাগজের নৌকা বানেয়া ভাসে দিছি। ... নদীর তীরত ধান পাহারা দিবার সময় নাড়াবাড়িত, কদুর ডুগি, আন্ডা আলুর ডাইল দিয়া ভাত খাচি। চেংরা চেংরি মিলি বাড়ি থাকি চুপকরি চাউল, কালাই, আলু, টাপা থাকি হাঁস-মুরগি আনি নদীর ঘাটত কাশিয়া বাড়িত পিকনিক খাচি। স্কুল শেষে রাস্তাত মারবেল খেলাইচি, ভুইয়ত চেংকু-ডান্টি, দাড়িয়াবান্দা, ছি-বুড়ি, গােল্লাছুট খেলাইছি’। ‘প্রথম শহিদ শংকু’ শীর্ষক লেখাটিতে একাত্তরের উত্তাল মার্চে রংপুরের মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের নিখুত চিত্র ফুটে উঠেছে। ৩রা মার্চ কিশাের শংকু সমাজদার জীবন দিয়ে আন্দোলনের গতিকে ত্বরান্বিত করেছিলাে। ৭ই মার্চের ঢাকা রেসকোর্স ময়দানের লাখাে জনতার সমাবেশে বঙ্গবন্ধু তা দীপ্ত ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেছিলেন। ‘রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও ও মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক লেখাটিতে রংপুর অঞ্চলের মানুষের অসম সাহসীকতার ও বীরত্ব গাঁথাকে উপস্থাপন করা হয়েছে নির্মোহ, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে। সে সময়ের ছাত্র-যুব ও পৌর নেতাদের নেতৃত্ব ও ত্যাগ, বলদিপুকুর ও লােহানিপাড়ার সাঁওতাল আদিবাসীদের তীর ধনুক, বল্লম সড়কি নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের কথা জানতে পারবে এ প্রজন্মের স্বাধীনতার সুফলভােগী সন্তান-সন্ততিরা। ‘মুক্তিযােদ্ধা রূপালি সিংহ' শীর্ষক রচনাটিতে লেখক একাত্তরের নারী নির্যাতনের চিত্রটি সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বীরাঙ্গনা নারীরা আজও কীভাবে বেঁচে আছেন, সমাজ-রাষ্ট্র কীরূপ প্রতিদান দিয়েছে তা ফুটে উঠেছে লেখাটিতে। কলঙ্কের বােঝা মাথায় নিয়ে নির্মম নির্যাতনের নিষ্ঠুরতা দেহমনে, দরিদ্র সংসারে হাসি ফুটবে এই প্রতীক্ষায় বেঁচে আছেন আধমরা হয়ে’। লেখক ‘টাউন হল বধ্যভূমি ও বীরাঙ্গনা' শীর্ষক রচনাতে রংপুরের সাহিত্যসংস্কৃতি সমাবেশের পীঠস্থান টাউন হলের একটি প্রাণবন্ত ও নিখুঁত চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এভাবে ‘টাউন হলের উন্মুক্ত সাহিত্য মঞ্চ, নাচ-গান, সংস্কৃতির আবহ, বৃক্ষ শােভিত গণগ্রন্থাগারের মায়ায় সুশীতল ছায়া সংস্কৃতির ডালা মেলেছে টাউন হল জুড়ে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া তরুণ-যুবা, চাকুরে, শিল্পী সংগঠক, ভবঘুরে, লেখক-সংবাদকর্মীদের ভীড়। প্রাচীরে নানা বয়সী নারীপুরুষের আড্ডা সকাল-দুপুর'। লেখক বর্ণনা করেছেন টাউন হলসহ রঙ্গপুরের প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, যা এ প্রজন্মের সাহিত্য সংস্কৃতি পিপাসুদের জানার পরিধিকে বিস্তৃত করবে নিঃসন্দেহে। পাঠক জানতে পারবে সে সময়ের রংপুরের কয়েকজন ছাত্রনেতা, যুবনেতা, জননেতা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বীর মুক্তিযােদ্ধার স্মৃতিচারণও। গ্রন্থটি পাঠে আমার মনে হয়েছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রংপুর অঞ্চলের অবদান জানতে হলে স্নেহভাজন আফতাব হােসেনের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ গ্রন্থখানি আগামী প্রজন্মের গবেষক, ঐতিহাসিক ও অনুসন্ধিৎসু পাঠকের অনেক সহায়ক হবে।