যিকরুল্লাহ - মুমিন হৃদয়ের প্রাণ দাবি করা হয়ে থাকে যে, ২০৫০ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ানক অসুখ হবে হতাশা। হতাশার মূল কারণ আল্লাহর অবাধ্যতা। যিকরুল্লাহ থেকে মানুষ যত দূরে চলে যায়, হতাশা তাকে তত বেশি ঘিরে ধরে। আর হতাশার হুতাশনে তেল ঢালার জন্য শয়তান তো সদা প্রস্তুত আছেই। শয়তান হতাশাগ্রস্থ অন্তরে ওয়াসওয়াসা দিয়ে বান্দাকে বিভ্রান্ত এবং আল্লাহর ব্যাপারে কুধারণার পথে হাঁকিয়ে নিয়ে যায়। এ কথা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কুরআনুল মাজীদে ইরশাদ করেছেন। তিনি বলেন, وَمَنْ يَعْشُ عَنْ ذِكْرِ الرَّحْمَنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ وَإِنَّهُمْ لَيَصُدُّونَهُمْ عَنِ السَّبِيلِ وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ مُهْتَدُونَ যে ব্যক্তি রহমানের যিকির থেকে উদাসীন থাকে আমি তাঁর জন্য শয়তানকে নিয়োজিত করি। ফলে সে হয়ে যায় তার একান্ত সহচর। শয়তান মানুষকে সৎপথ থেকে বিরত রাখে। অথচ মানুষ মনে করে তারা সঠিক পথে আছে। শয়তান যিকিরবিমুখ বান্দাকে গুনাহের দিকে আহবান করে। অবাধ্য অন্তরে সে নিরবিচ্ছিন্ন ওয়াসওয়াসা দিতে থাকে। অবহেলায় পড়ে থাকা কাঠের গায়ে ঘুণপোকা ধরার মতো বান্দার অন্তরে সে জায়গা করে নেয়। এভাবে একপর্যায়ে সে বান্দাকে পুরোপুরি নিজের কবজায় নিয়ে নেয়। ফলে বান্দা হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে শয়তানের তাবেদারি করতে শুরু করে। জীবন হয়ে ওঠে অবসাদময়। অবসাদে ঘেরা জীবনে তখন আর কোনো আশা-ভরসা থাকে না। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হতাশার মতো মানসিক অস্থিরতা তাকে বিচলিত করে রাখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) হিসাব অনুযায়ী বর্তমান পৃথিবীতে হতাশাগ্রস্থ রোগীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ২৭ কোটি। তবে বাস্তবিকপক্ষে এর সংখ্যা আরো অনেক বেশী। WHO এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী আরো বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য বের হয়ে এসেছে। যেমন– ১. বৈশ্বিক অসুস্থতার কাতারে প্রথমেই রয়েছে হতাশা। ২. হতাশায় নিমজ্জিত মানুষের মধ্যে নারীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ৩. যাবতীয় ক্ষেত্রে অক্ষমতা মূলত হতাশা থেকে সৃষ্ট। ৪. যে জিনিস আত্মহত্যার দিকে সবচেয়ে বেশি প্ররোচিত করে, তা হলো হতাশা। ৫. হতাশাগ্রস্থ রোগীদের সিংহভাগের বয়স ২০-২৯ বছরের মধ্যে।(২) এই ভয়ানক ব্যাধির সমাধান একটাই। আর তা হলো আল্লাহর যিকির। যিকরুল্লাহই পারে এই ব্যাধি নিরাময় করতে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ জেনে রেখো, আল্লাহর যিকিরেই রয়েছে অন্তর প্রশান্তি। কাজেই জীবন থেকে হতাশাকে বিদায় জানাতে যিকরুল্লাহ ভিন্ন আর কোনো উপায় নেই। সেই কাঙ্ক্ষিত উপায়ের তালাশে আযান প্রকাশনীর এবারের প্রকাশনা ‘যিকরুল্লাহ : মুমিন হৃদয়ের প্রাণ।’ বইটি জগদ্বিখ্যাত ইমাম হাফিয ইবন কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ রহিমাহুল্লহ এর অনবদ্য কিতাব ‘আল-ওয়াবিলুস সাইয়্যিব’ এর অনুবাদ। দক্ষ হাতে বইটি ভাষান্তর করেছেন আব্দুল্লাহ মাহমূদ হাফিযাহুল্লাহ। এই বইটি থেকে পাঠকবর্গ যিকির সংক্রান্ত জীবনঘনিষ্ঠ বিভিন্ন বিষয়াবলী জানতে পারবেন। বিশেষকরে যিকিরের উপকারিতা, উত্তম-অনুত্তম যিকির, যিকিরের সময় শয়তানের প্রতিক্রিয়া, যিকির কীভাবে করতে হয়, কখন করতে হয়, যিকিরের দুনিয়াবি ও পারলৌকিক ফায়দা কী, যিকির কীভাবে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সাহায্য করে, যিকিরের মাধ্যমে কীভাবে অন্তর প্রশান্ত হয়—এই বিষয়গুলো পাঠক বিস্তারিত জানতে পারবে, ইন শা আল্লাহ।
আল্লামা ইবনু কাইয়্যিমিল জাওযীয়া (রহঃ) ছিলেন ইসলামী চিন্তাবিদ, ফকিহ, তাফসীরবিদ, হাদীসজ্ঞ এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের পণ্ডিত। তাঁর পূর্ণ নাম ছিল আবু আব্দুল্লাহ্ শামসুদ্দ্বীন মুহাম্মাদ বিন আবু বকর বিন আইয়্যুব আদ দিমাশকী। তিনি ৬৯১ হিজরী সালে দামেস্কে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর পিতা দীর্ঘ দিন দামেস্কের আল জাওযীয়া মাদ্রাসার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বলেই তাঁর পিতা আবু বকরকে قيم الجوزية কাইয়্যিমুল জাওযীয়াহ অর্থাৎ মাদরাসাতুল জাওযীয়ার তত্ত্বাবধায়ক বলা হয়। পরবর্তীতে তাঁর বংশের লোকেরা এই উপাধীতেই প্রসিদ্ধি লাভ করে। ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমীয়া (রহঃ)-এর স্নেহধন্য শিষ্য ছিলেন এবং শাইখের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তাঁর সাথেই ছিলেন। এমনকি জিহাদের ময়দান থেকে শুরু করে জেলখানাতেও তিনি তাঁর থেকে আলাদা হননি। তিনি ইসলামী আকীদাহ, তাওহীদ, সুন্নাহ ও বিদআত-বিরোধী বিভিন্ন বিষয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। তার মধ্যে তাওহীদ ও সুন্নাহের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, বিদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং ইবাদত-বন্দেগীতে নিষ্ঠা ছিল অন্যতম। ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:
"যাদুল মা‘আদ ফী হাদ্য়ী খাইরিল ইবাদ"
"মাদারিজুস সালিকীন"
"শিফাউল আলীল"
"তিবেব নববী" (চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর অনন্য অবদান)
তাঁর উস্তাদ বৃন্দ -
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) যে সমস্ত আলেম-উলামার কাছ থেকে তালীম ও তারবীয়াত হাসিল করেন, তাদের মধ্যে রয়েছেনঃ
শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমীয়াহ (রহঃ)।
আহমাদ বিন আব্দুদ্ দায়িম আল-মাকদেসী (রহঃ)।
তাঁর পিতা কাইয়্যিমুল জাওযীয়াহ (রহঃ)।
আহমাদ বিন আব্দুর রহমান আন্ নাবলেসী (রহঃ)।
তাঁর ছাত্রসমূহ -
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) এর হাতে যে সমস্ত মনীষী জ্ঞান আহরণে ধন্য হয়েছিলেন, তাদের তালিকা অতি বিশাল। তাদের মধ্যে রয়েছেনঃ
বুরহান উদ্দ্বীন ইবরাহীম বিন ইবনুল কাইয়্যিম।
ইমাম ইবনে রজব (রহঃ)।
হাফিয ইমাম ইবনে কাছীর (রহঃ)।
তিনি একজন নিরলস সাধক, যিনি দীর্ঘ সময় ইবাদত করতেন, বিশেষ করে তাহাজ্জুদ ও কুরআন তিলাওয়াতে মগ্ন থাকতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ইলমী ও আধ্যাত্মিক খেদমত মুসলিম উম্মাহর জন্য অমূল্য দান হয়ে রয়েছে। ইবনুল কাইয়্যিম ৭৫১ হিজরী সনে মারা যান এবং দামেস্কের বাবে সাগীর গোরস্থানে তাঁর পিতার পাশে দাফন করা হয়।