ক্ষিতিমোহন সেন রচিত ‘ভারতীয় মধ্যযুগে সাধনার ধারা’(১৯৩০) গ্রন্থের ভূমিকা রবীন্দ্রনাথ সাগ্রহে লিখেছিলেন। তিনি ভারতের ইতিহাসের দুটি ধারার কথা বলেছেন। একটি রাষ্ট্রীয় ইতিহাস, অন্যটি সাধনার ইতিহাস। এই দ্বিতীয় ধারাটি হল ভারতবর্ষের ‘স্বকীয় সাধনা’। এই সাধনার মন্থনের ওপরে ক্ষিতিমোহন জোর দিয়েছেন। আর মন্থন-জাত অমৃতের স্বাদ স্বল্প-পরিসর গ্রন্থটিতে পাঠক অনায়াসে পেয়ে যায়। ভারতের পরম সম্পদ তার ধর্ম। নানা সম্প্রদায়, নানা শাস্ত্র, নানা আচারে ভেদ থাকে। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে ধর্মের ভিতরকার ঐক্য সব মানুষকে ধরে রাখে, মহা মিলনের ক্ষেত্রে পৌঁছে দেয়। ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা নিষ্কাশন করে ক্ষিতিমোহন আমাদের এই বিষয়টিই জানিয়েছেন। সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় আগ্রাসন, আঘাত-প্রত্যাঘাত, বিরুদ্ধ শক্তির উত্থান ইত্যাদির মধ্য দিয়েও শেষ পর্যন্ত বিবিধ ধর্মাচরণের ঐক্য-গীতিই শোনা যায়। গুরু রামানন্দ হিন্দু-মুসলমান জাতি-নির্বিশেষে ধর্মীয় ঐক্যের বাণী শোনালেন। নবযুগের সূচনা হল। শাসককুলের তাড়নায় ধর্মান্তরের ঘটনা সত্ত্বেও ধর্মীয় সাধনার মূল সুর হারিয়ে যায়নি কখনও। ‘ভারতীয় মধ্যযুগে সাধনার ধারা’ গ্রন্থটিতে ক্ষিতিমোহন নানা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কথা বলেছেন। রামানুজ, বিষ্ণুস্বামী, নিম্বার্ক, চৈতন্য, শঙ্কর দেব, সুরদাস, রাধাবল্লভী, মীরা বাঈ, তুকারাম, নামদেব, রাম দাস, তুলসী দাস প্রভৃতি সাধক সম্প্রদায় ও তাঁদের ধর্মাচরণের বিবরণ দিয়েছেন। আবার স্মৃতি শাস্ত্র, তন্ত্র, ভাগবত ধর্ম, শৈবধর্ম প্রভৃতির আলোচনাও তিনি করেছেন। ক্ষিতিমোহনের গ্রন্থটি ভারতীয় সাধককুলের জীবনী-কোষও বটে। নিমাইচন্দ্র পাল
Kshitimohan Sen ক্ষিতিমোহন সেনের জন্ম ১৮৮০, কাশীতে। কাশী কুইন্স কলেজ থেকে সংস্কৃতে এম এ । কর্মজীবন শুরু চম্বারাজ্যের শিক্ষাবিভাগে। ১৯০৮ সালে রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে ব্ৰহ্মচৰ্যাশ্রমে যোগদান, পরে বিদ্যাভবনের অধ্যক্ষ, কিছুদিন বিশ্বভারতীর অস্থায়ী উপাচাৰ্য। লোকসংগীত ও ছড়া সংগ্রহের জন্য তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্ৰমণ করেছেন। কবীর, দাদু, মধ্যযুগীয় মরমিয়া সাধক এবং বাউলদের গানের সুসংবদ্ধ সংগ্ৰহ তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব। তাঁর প্রকাশিত গ্ৰন্থঃ কবীর, ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা, ভারতের সংস্কৃতি, বাংলার সাধনা, জাতিভেদ, হিন্দু মুসলমানের যুক্তসাধনা, বলাকা কাব্য পরিক্রমা, বাংলার বাউল, চিন্ময় বঙ্গ, প্রাচীন ভারতে নারী, যুগগুরু রামমোহন। রবীন্দ্রনাথের ‘ওয়ান হান্ড্রেড পোয়েমস অফ কবীর’ গ্রন্থটি ক্ষিতিমোহনের কবীর-বচন সংগ্ৰহ অবলম্বনে রচিত (১৯১৪) বিশ্বভারতীর প্রথম “দেশিকোত্তম’ (১৯৫২)। মৃত্যু: ১২ মার্চ ১৯৬০৷৷ তার দৌহিত্র অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত (১৯৯৮) অমর্ত্য সেন হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যামন্ট ইউনিভার্সিটি অধ্যাপক। কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার পদে ছিলেন ১৯৯৮–২০০৪। তাঁর সাম্প্রতিকতম গ্রন্থগুলি হল ইন্ডিয়ান’, ‘র্যাশনালিটি অ্যান্ড ফ্রিডম” এবং ‘আইডেনটিটি অ্যান্ড ভায়ো’ডেভেলপমেন্ট অ্যাড ফ্রিডম’, ‘আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’, ‘র্যাশনালিটি অ্যান্ড ফ্রিডম’ এবং ‘আইডেনটিটি অ্যান্ড ভালোলেন্স : দি ইলিউশন অফ ডেসটিনি’। তার গ্রন্থগুলি তিরিশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।