আকাশভরা সূর্য তারা আর বিশ্বভরা প্রাণের দিকে তাকালে নিজেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মনে হয়। মনে হয় এই যে চারপাশের বিস্তৃত জগত, এখানে কত কিছু দেখার আছে, কত কিছু শেখার আছে! সেই সবকিছু দেখতে দেখতে আমি দুহাতে কুড়াই জীবনের ফুল পাতা নূড়িপাথর। কুড়িয়ে বাড়িয়ে নেয়া সে মহার্ঘ্য সাজিয়ে লিখতে থাকি অক্ষরের পর অক্ষর। আমার মনে হয় যে বিপুল ঐশ্বর্য আমি রোজ পাই জীবন থেকে, তা কেবল লিখলেই বেঁচে থাকে, লিখলেই আবার নতুন করে প্রাণ পায়। আমি তাই নিজের মতো লিখে যাই। আমার চরিত্রগুলো, তাদের সংলাপ সবই সত্যিকার অর্থে চারপাশের জীবন থেকেই পাওয়া। যা কিছু আমার দেখা নয়, তা নিয়ে লিখতে পারি না। কখনো পথ চলতে চলতে উড়ে আসা কারো আলাপচারিতার অংশও আমাকে লিখতে বসায়। আমাকে লিখতে বসায় নিজের জীবনেই প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া নানাবিধ ঘটনা। এই বইয়ের গল্পগুলো সেই একান্ত চেনা জীবনেরই কালির অক্ষর, কখনো তা নিজেরও বটে। আজকালকার অস্থির সময়ে আমাদের মানবিক সম্পর্কগুলো বিচিত্র গতি পেয়েছে। মানুষের বহু বছরের চেনা সম্পর্কের নাম বদলে যাচ্ছে, আবার একেবারে নতুন নামে নতুন ছন্দে প্রাণ পাচ্ছে আরো কিছু সম্পর্কের আশ্চর্য সমীকরণ। গত কিছু দিনে কিছু প্রিয় মানুষের বদলে যাওয়া সম্পর্ক আমাকে ভাবিয়ে তুলছিল। সেগুলো উপজীব্য করেই লেখা এ বইয়ের ‘যৌথবাস’ আর ‘অন্য জানালা’ গল্প দুটো। ‘তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা’ গানটা আমার প্রিয়, মানুষের এক মনের ঘরে আসলে কতজনের বাস তা সে নিজেও থই পায় না সময় সময়- ‘নক্ষত্রবেলা’ লেখার সময় এই ভাবনাই ছিল গল্পের মূলে। পুরনো যা কিছু আছে, নিজেদের অস্তিত্বের সংকট তাদের নিত্যসঙ্গী। যেকোনো শহরেই কিছু খুব পুরনো ঐতিহ্যবাহী দোকান থাকে, বর্তমানের ঝাঁ চকচকে দোকানপাটের পাল্লা দিয়ে টিকে থাকে সেই ঐতিহ্যবাহী দোকানগুলো। একটি প্রখ্যাত মিষ্টির দোকান আর তাদের সংগ্রামের কিছুটা চাক্ষুস করার সুযোগ হয়েছিল আমার, সেই দেখা থেকে ‘তৃষ্ণাবতী সুইটস’ গল্পটা লিখেছিলাম দীর্ঘদিন সময় নিয়ে। গল্প লেখার সময় ঠিক সেই গল্পটি ছাড়া অন্য কোনোকিছু ভাবিনা আসলে কোনোদিন। যা মনে আসে, যেভাবে মনে আসে লিখে ফেলি। কোভিড-১৯ সংক্রমনের শুরুর দিকে অনেকগুলো দিন ঘরবন্দী ছিলাম। পরিবারসহ নিজেও সংক্রমিত হয়েছিলাম এক সময়। পৃথিবীর মানচিত্রজুড়ে বদলে যাওয়া সেই দিনগুলো নিয়ে লিখেছি ‘তারাদের রাত’ আর ‘গ্রহণক্ষণ’নামের গল্পদুটো। অন্যান্য গল্পের চরিত্রদেরও খুঁজলে আমার আশেপাশেই পাওয়া যাবে, শোনা যাবে তাদের কথোপকথন। গল্পগুলো উঠে এসেছে আমার চিরচেনা জীবন থেকে যে জীবন তার সবটুকু দিয়ে যাপনে লীন থাকে। সবুজ ঘাসের নরমে ডুবে যেমন কখনো কখনো বুঁদ হয়ে থাকা যায় সুদূরের হরেক রংয়ের মেঘে।