জাগতিক ক্লান্তি থেকে মুক্তির এক চিলতে আকাশ কিংবা নিজেকে প্রকাশ করার সুন্দরতম মাধ্যম হলো লেখালেখি—এই কথাগুলো আজ পর্যন্ত অজস্রবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হয়ে গেছে, তবু এই ক্লিশে কথাগুলো আমার ক্ষেত্রেও জলের মতো সত্য। যে জীবন আমি যাপন করিনি অথচ তার অংশ হয়েছি গল্পের নানান চরিত্রের হাত ধরে, আর এভাবে ক্ষণিকের জন্য হলেও সেই জীবন আমার হয়েছে। লেখালেখির এই বোধই আমাকে উড়তে শিখিয়েছে অবারিত আকাশে। এ যেন বিহঙ্গমের উড়ান, যার গন্তব্য চিহ্নের খোঁজ সে নিজেও জানে না। ‘বিহঙ্গম’ গ্রন্থে মানবিক সম্পর্কের গল্প রয়েছে, রয়েছে জীবনের অনিঃশেষ সংগ্রাম আর শেকল ছেঁড়ার আখ্যান। মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের মাঝে যে সাঁকো তার গল্পও আছে। আছে দেশভাগের গল্প। এছাড়া অতিমারীর যে ক্রান্তিলগ্ন আমরা অতিক্রম করছি তার প্রেক্ষিতে রচিত ‘চিড়িয়াখানা’, ‘ফরগেট মি নট’ এবং ‘নেক্রপলিস’ গল্প তিনটিও সংকলিত হয়েছে বইটিতে। শুধু প্রাকৃতিক সংকট নয় পৃথিবীতে এ সময়ে যে নিরেট বিষাদবেলার সূচনা হয়েছে তার প্রভাবও রয়েছে এসব আখ্যানে। ‘বিহঙ্গম’-এ সংকলিত পনেরোটি গল্পে সমসাময়িক বিষয়ের পাশাপাশি একাল ওকালকে জুড়ে দেবার কিছু প্রয়াস আছে। কাঁটাতার ও প্রেমের মতো প্রাসঙ্গিক ভাবনার মেলবন্ধনে ‘কর্পূরনিবাস’ এবং ‘চন্দ্রাবতী’ গল্প দুটো রচিত হয়েছে। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করতে বসে উপলব্ধি করেছি কিছু গল্প লেখার স্মৃতিও কত সুন্দর হতে পারে। মনে পড়ে ‘রাজেন্দ্র মণ্ডলের প্রেসক্রিপশন’ গল্পটি লিখতে দীর্ঘ সময় নিয়েছিলাম। একদিন দুপুরে আমার সাথে বসে গল্পেরই একটি চরিত্র নিমাই চন্দ্র মণ্ডল তার পূর্বপুরুষের স্মৃতিচারণ করছিলেন। তার বলার ভঙ্গি এমন ছিল যে আমি গল্পের বীজটি তাৎক্ষণিকভাবেই পেয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কথকের মুখে শোনা ঘটনাপ্রবাহ থেকেই এই গল্পের সিংহভাগ লেখা হয়েছে। আর প্রাসঙ্গিকভাবে আমাকে দ্বারস্থ হতে হয়েছে ইতিহাসের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর কালে ফিরে তাকানোর সুযোগও হয়েছে তাই। একইভাবে ইতিহাসের অনুগামী হতে হতে মুক্তিযুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক সময়ের যোগসূত্র নিয়ে লিখেছি ‘নোঙর’ গল্পটি। আবার কিছু গল্প আছে কোনো প্রস্তুতির অপেক্ষা করেনি, আলটপকায় লেখা হয়ে গেছে। ‘ঝরাপাতা ও স্রোতস্বিনী’ তেমনি একটা গল্প। বৃষ্টিভেজা যশোর স্টিচ শাড়ি ঝরার পায়ের সাথে লেপ্টে আছে এই দৃশ্যটি ভাবতে ভাবতে নীলমণিলতার গালিচা তৈরি হয়েছিল আর সুগন্ধার তীরে এসে গল্পটির সমাপ্তি ঘটেছিল। পাঠক হিসেবে আমি যখন কোনো গল্প বা উপন্যাসের গভীরে প্রবেশ করি তখন অনেক পাঠকের মতো আমারও মনে হয় হয়তো এই গল্পদৃশ্যে স্বয়ং লেখক উপস্থিত ছিলেন কিংবা লেখক এই আখ্যানটি শোনাতে গিয়ে যে আবহগান সৃষ্টি করেছেন সেই স্বরলিপিতে তার নিজস্ব কিছু স্বর অনুপ্রবেশ করেছে, অবচেতনে কিংবা সচেতনভাবেও। লেখক কখনো তা স্বীকার করেন, আবার কখনো বা কিছু আড়াল তৈরি করে রাখেন। অস্বীকার করব না এই বইটিতেও কিছু গল্পে এমন কিছু দৃশ্যপট আছে যার নেপথ্যে আমার উপস্থিতি রয়েছে। কোথায় কিংবা কতখানি সেই আড়ালটুকু না-হয় আমার বেলাতেও থাকুক। লেখালেখি আমার কাছে শুধু খোলা আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের উড়ান নয়; আমার ক্লান্তিতে, দমবন্ধ ক্ষয়িষ্ণু সময়ে অম্লজানের মতো, ডুবে যেতে যেতে নাগালে আসা খড়কুটোর অবলম্বনের মতো। দিনযাপনের সমস্ত কোলাহল শেষে যখন ব্যক্তিগত হতাশা আর গ্লানি ক্রমশ মুখোশ খুলে আলগোছে আমার পিঠ ছুঁয়ে বসে, কোনো সুহৃদের মতো কাঁধে হাত রেখে কুশল জানতে চায়, তখন আমি অসীম শূন্যের বুকে নগণ্য একটি রেখা থেকে ক্ষুদ্র হতে হতে তুচ্ছ একটি বিন্দুতে পরিণত হয়ে যাই। এই যে বিন্দুতে এসে সেই কবে থেকে তিরতির করে কাঁপছি, মনে হয় এই বুঝি উড়ে গেলাম ফুৎকারে, সেই যে এক চিলতে আকাশ, এক পলকা হাওয়া, শুদ্ধতম অম্লজান আমাকে তখন প্রবলভাবে বাঁচিয়ে দিয়ে যায়। আর নিজেকেই আমি নিজে বলে চলি— ‘তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনই, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
নিবেদিতা আইচের জন্ম ২ এপ্রিল, চটগ্রামে। বাবার চাকুরীসূত্রে তার শৈশব কৈশোর কেটেছে বিভিন্ন মফস্বল শহরে। তিনি পেশায় চিকিৎসক। অবসরে লিখতে ভালবাসেন। বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ -
কিছু গল্প অবাঙমুখ (২০১৮) ও নৈর্ঋতে (২০২০) -পেন্সিল পাবলিকেশনস। বিহঙ্গম (২০২১) -চৈতন্য প্রকাশনী।