"আত্মঘাতী বাঙালী" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ আমি বাঙালী জীবনের শ্রান্তি ও অবসাদ ১৯২২-২৩ সন হইতে অনুভব করিতে আরম্ভ করি। ১৯৩৬-৩৭ সনে এবিষয়ে কয়েকটি প্রবন্ধও লিখি। সেই পুরাতন রচনা হইতে অনেক কথা এই বই-এ উদ্ধত করিব। কিন্তু ১৯৩৭ সনের পর্বে যাহা শুধু অনুভূতিসাপেক্ষ ছিল, সেই বৎসরে তাহা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা-সাপেক্ষ হইল। সেই বৎসরে ১৯৩৫ সনের ভারতশাসনের নতুন আইন প্রবর্তিত হইল। উহা যে হিন্দু বাঙালীর মৃত্যুদন্ড তাহার প্রকৃত ধারণা আজ পর্যন্তও হয় নাই। আমার নতুন ইংরেজী বই-এ এই ব্যাপারটার আলােচনা করিয়াছি। তখন হইতে বাঙালী জীবনের ক্ষয় বাড়িয়া চলিল। অবশেষে ১৯৪৭ সনে চরমে পৌঁছিল। সেই মত্যুশয্যার বিবরণই এই বই-এ দিব। তবু, এই জাতীয় মৃত্যুই কি বাঙালীর পক্ষে শেষ কথা? ব্যক্তিবিশেষের পুনর্জন্ম হয়, তাহা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু জাতির বেলায় হইতেও পারে। বাঙালীর জাতীয় পুনর্জন্ম অতীতে দুইবার হইয়াছে। উহার উল্লেখ ও আলােচনা পরে করিব। ভবিষ্যতে আর একবার হইতে পারে এই আশা করিয়াই বইখানা লিখিলাম। যদিও বা হয়, সে পুনর্জন্ম আমি দেখিব না। কিন্তু আমার দেখা-না-দেখার কোনাে অর্থ আছে কি? কাল নিরবধি। আমার জীবনের সঙ্গেই বাঙালীর জাতীয় জীবন শেষ হইয়া যাইবে না। বাঙালীর ইতিহাস থাকিবে, বাঙালী আবার যদি উন্নত নাও হয়, তাহা হইলেও তাহার সৃষ্ট যে কীর্তি তাহার ঐতিহাসিক সার্থকতা থাকিবে। সেই ইতিহাসে আমার নাম থাকিবে এই ভরসা আমি রাখি। সেই ভরসাতেই ৯১ বছরে পড়িয়াও বইখানা লিখিবার আগ্রহ ও শক্তি দুইই পাইলাম। এরপর শুধু একটা কথা বলিতে বাকী। এই বই-এ যাহা লিখিয়াছি, তাহা বানানাে ছোঁদো কথা নয়। ইহাতে সত্যকার ইতিহাসের উপর কোন দার্শনিক তত্ত্বও চাপাই নাই। ইহাতে যাহা আছে তাহা সত্যকার ঘটনা ; সত্যকার চিন্তা ও কর্ম এবং সত্যকার ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার বর্ণনা। অবশ্য আজিকার দিনে বাঙালীর মনে হইতে পারে যে, এই কাহিনীতে কাল্পনিক কথা আছে, কল্পনার রং ও সুর চাপানাে হইয়াছে। আসলে এই আপত্তিটাই কাল্পনিক হইবে। সকল যুগে ব্যক্তি বিশেষের বা জাতি বিশেষের মনের ঘর এক পদয়ি বাঁধা থাকে না। উহা জাতীয় জীবনের প্রাণের জোয়ার ও প্রাণের ভাঁটার সঙ্গে চড়ায় ওঠে ও খাদে নামে। তাই খাদ একমাত্র সত্য, চড়া মিথ্যা মনে করা ভুল হইবে। আজ বাঙালী জীবনে যে জিনিষটা প্রকৃতপক্ষেই ভয়াবহ সেটা এই ও মত্যুযন্ত্রণারও অনুভূতি নাই; আছে হয় পাষাণ হইয়া মুখ বুজিয়া সহ্য করা, অথবা সংজ্ঞাহীন হইয়া প্রাণ মাত্র রাখা; আরেকটা ব্যাপারও আছে—জাতির মত্যুশয্যার চারিদিকে ধনগর্বে উল্লসিত বাঙালী প্রেত ও প্রেতিনীর নৃত্য।
Nirodchandra Chowdhury (জন্ম: ২৩ নভেম্বর, ১৮৯৭ - মৃত্যু: ১ আগস্ট, ১৯৯৯) একজন খ্যাতনামা দীর্ঘজীবী বাঙালি মননশীল লেখক ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ। স্কলার এক্সট্রাঅর্ডিনারী শীর্ষক ম্যাক্স মুলারের জীবনী লিখে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে নীরদচন্দ্র চৌধুরী ভারত সরকার প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মাননা হিসেবে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি তাঁর ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ও তীর্যক প্রকাশভঙ্গীর জন্য বিশেষভাবে আলোচিত ছিলেন।