"প্রাচীন বাংলার ইতিহাস সমাজ ও সংস্কৃতি" বইটির প্রাককথন থেকে নেয়াঃ প্রাচীন বাংলার ইতিহাস: সমাজ ও সংস্কৃতি আমার লেখা গ্রন্থটি কয়েকটি প্রবন্ধের সংকলন। বিভিন্ন সময়ে গবেষণাধর্মী পত্রিকায় প্রকাশিত এ প্রবন্ধগুলােতে বাংলার ভূতাত্ত্বিক গঠন, ভৌগােলিক সীমানার বিবর্তন এবং আদি সমাজ ও সংস্কৃতির পরম্পরাগত চিত্র ফুটে উঠেছে। দূরবর্তী অতীত বর্তমান ইতিহাসের উপজীব্য হলেও প্রাচীন বাংলার ইতিহাস আজ অনেকটাই উপেক্ষিত। তথ্যনিষ্ঠ বর্ণনা ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বাংলার আদিপর্ব নিয়ে গ্রন্থও বিরল। বাংলার আদিপর্বের ইতিহাস যেসব কর্মে সমৃদ্ধ হয়েছে তা উল্লেখ না করলে এ আলােচনা অসমাপ্ত থেকে যায়। এক্ষেত্রে অক্ষয় কুমার মৈত্রের রচিত গৌড লেখমালা, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঙ্গালার ইতিহাস ১ম, ২য় খণ্ড, দীনেশচন্দ্র সেনের বৃহত্বঙ্গ, দীনেশচন্দ্র সরকার রচিত পাল ও সেন যুগের বংশানুচরিত বিশেষ উল্লেখযােগ্য। তবে প্রাচীন বাংলার গবেষণাধর্মী অনন্য একটি সংযােজন হলাে নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালীর ইতিহাস (আদিপর্ব) গ্রন্থটি। এ ছাড়া রমেশচন্দ্র মজুমদার রচিত History of Bengal vol-I, History of Ancient Bengal গ্রন্থসমূহ আদিপর্বের ইতিহাস পঠন-পাঠনের শূন্যতা পূরণে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া, আনিসুজ্জামান সম্পাদিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এবং আব্দুল মমিন চৌধুরী রচিত Dynastic History of Bengal গ্রন্থদ্বয় এ পর্বের ইতিহাস রচনার ধারাবাহিকতায় এগিয়ে এসেছে। এরপর দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করে History of Bangladesh Early Bengal in Regional Perspectives up to c. 1200 C E) vol. I, II গ্রন্থদ্বয় রচনার মাধ্যমে আদিপর্বের ইতিহাস বিষয়ে নতুন মাত্রা সংযােজিত হয়েছে। আব্দুল মমিন চৌধুরী ও রণবীর চক্রবর্তীর যৌথ সম্পাদনায় এশিয়াটিক সােসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত এ গ্রন্থদ্বয় বাংলার ইতিহাসের আদিপর্ব বিষয়ে তৃষ্ণার্ত পাঠকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সময়ােপযােগী সংযােজন। এরপরও প্রাচীন বাংলার ইতিহাস বিষয়ে গ্রন্থের স্বল্পতা অস্বীকার করা যায় না। পূর্ণাঙ্গ গবেষণার অভাবে আজও প্রাচীন বাংলার ভূপ্রকৃতি, সমাজ ও সংস্কৃতির বিচ্ছিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, তথ্যের স্বল্পতা ও সীমাবদ্ধতা এ পর্বের ইতিহাস রচনার অন্যতম প্রতিবন্ধকতারূপে বিবেচিত হলেও অনেক সময় উৎসের ভাষাগত দুর্বোধ্যতাই গবেষকগণের পথ চলাকে কঠিন ও অমসৃণ করে তােলে। ফলে উৎস যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে ইতিহাস রচনার ধৈৰ্য্য ও মনােবল অনেকেই হারিয়ে ফেলেন। আর একারণেই বাঙালির আদিপর্বের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী হওয়া সত্ত্বেও আজ অনেকটাই অবহেলিত। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, আদিপর্বের এ ইতিহাস কেবল রাজন্যবর্গের আখ্যান ধারায় সীমাবদ্ধ নয়। এ ইতিবৃত্তে মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতি, জীবন ও জীবিকার নানা কার্যকারণ সম্বন্ধও নিহিত রয়েছে। পর্ব-পর্বান্তরের এ স্বরূপ উদ্ঘাটন আজ সময়ের প্রয়ােজন। এ গ্রন্থে সংকলিত সবকটি প্রবন্ধ আমার মৌলিক রচনার অংশ। তথ্য সংগ্রহের জন্য ময়নামতি, পাহাড়পুর প্রত্নস্থল, স্থানীয় ও জাতীয় জাদুঘর পরিদর্শন, কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরি, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে রিপাের্ট ও ডাটা সংগ্রহ করতে হয়েছে। সংস্কৃত শ্লোকের সঠিক পাঠোদ্ধারের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক দুলাল ভৌমিক স্যারের বিশেষ সহযােগিতার কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। এ ছাড়া দ্বিতীয় পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহের জন্য জাতীয় যাদুঘর এবং পাবলিক লাইব্রেরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, এশিয়াটিক সােসাইটি ও বাংলা একাডেমি লাইব্রেরি থেকে গ্রন্থ ও পত্রিকার সাহায্য নিতে হয়েছে। সংকলিত এ গ্রন্থের প্রথমে রয়েছে বিশেষ ভৌগােলিক অঞ্চল এবং অবস্থানগত গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলার ভূমির রূপ ও ব-দ্বীপায়ন প্রক্রিয়া বিষয়ে একটি প্রবন্ধ। এতে বাংলার ভূমির গঠন ও প্রকৃতি, নদনদীর নিত্য পরিবর্তনশীল গতিপথ ও সীমানা নির্ধারণের উপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। সংযােজিত হয়েছে আদি ও আদি-মধ্যযুগের বাংলার অন্যতম জনপদ বঙ্গ’ এবং পুণ্ড ও পৌ'-বিষয়ক লেখা। একটি প্রবন্ধে ভৌগােলিক অঞ্চলরূপে চিহ্নিত ‘গঙ্গারিডাই’ ভূ-খণ্ডটি নিয়ে পণ্ডিত-গবেষকদের তর্কবিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এর অবস্থান শনাক্ত করার প্রয়াস ঘটেছে। অপর একটি রচনায় প্রশাসনিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক প্রয়ােজনে শিক্ষা ও ধর্মীয় কেন্দ্ররূপে গড়ে উঠা ভারতীয় উপমহাদেশের নগর সভ্যতার দ্বিতীয় পর্যায়ের নগর হিসেবে বাংলার আদিপর্বের নগরায়ণের সামগ্রিক কার্যকারণ সম্বন্ধ ফুটে উঠেছে। সামগ্রিক নগরায়ণের একটি বিশেষায়িত অংশরূপে সমতট অঞ্চলের নগর ‘দেবপর্বত’ নিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে আরাে একটি লেখা। এ ছাড়া সমকালীন বন্দরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক প্রভাবের চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে তাম্রলিপ্তি বন্দরের উপর রচিত প্রবন্ধে। সর্বোপরি, পােড়ামাটির শিল্পকর্মে চিত্রিত সাধারণ মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি এবং সেন যুগের ধর্ম ও সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রকাশ পেয়েছে অপর দুটি প্রবন্ধে।