পাঠকপ্রিয়তার দিক থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা কথাসাহিত্যের অপরাজেয় শিল্পী। সাহিত্যে প্রবেশের শতবর্ষের অধিক সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তাঁর এই পাঠকপ্রিয়তা অটুট আছে। এই জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ তাঁর নির্ভার প্রকরণ। আমাদের অতিপরিচিত প্রাত্যহিক সুখ-দুঃখের জীবনকে তিনি এমন কৌশলে পাঠকদের সামনে হাজির করেন যে পাঠক নিজের অজান্তেই সেই জীবনের সহযাত্রী হয়ে ওঠে। সরল মুগ্ধতায় এক ধরনের আবেশের মধ্য দিয়েই চলতে থাকে কাহিনি ও চরিত্রের ক্রমবিকাশের সাথে সাথে। এই ঘোর তার কাটে তখনই যখন শরৎচন্দ্র তাঁর কাহিনির সমাপ্তি টানেন। লেখক জীবনের শুরু থেকেই তিনি কৌশলটি আয়ত্ত করেছিলেন তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ-ত্যাগের মতো সহজাত প্রক্রিয়া হিসেবেই। পরিণীতা তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সমগ্র ভারত তথা বাংলায় সকল শিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই গড়ে ওঠে প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষভাবে চাকরিপ্রার্থী কেরানিবৃত্তির মানসিকতায়। এই কেরানিবৃত্তিও হয়তো সবার জোটে না। কিন্তু যাদের জোটে তাদেরও জীবন ব্রিটিশের শাসনপীড়িত এই দেশে হয়ে পড়ে অত্যন্ত দুর্বিষহ যন্ত্রণাময়। সেই যন্ত্রণাকাতর দুঃসহ কেরানিজীবনই পরিণীতার উপজীব্য। ষাট টাকা মাসিক বেতনের কন্যাদায়গ্রস্ত অসহায় ব্যাংক-কেরানি গুরুচরণের জীবনকাহিনিই চিত্রিত হয়েছে উপন্যাসটিতে। এই চিত্রায়ণ শরৎচন্দ্র ঘটিয়েছেন ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র, সমাজ ও সমকালকে ধারণ করে এমনি এক স্বভাবসিদ্ধ শিল্পনৈপুণ্যে, যা সহজেই পাঠক এবং সমালোচককে আকৃষ্ট করে।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।