বুক ফ্ল্যাপ ভয়ে গুঞ্জনের পুরো শরীর হিস্টিরিয়াগ্রস্থ রোগীর মতো কাঁপতে থাকে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে, অথচ মুখে কাপড় গোঁজা বলে একটু ঢোক গিলে যে গলার শুষ্কতা দূর করবে সে উপায়ও নেই। পুরো ব্যাপারটা যে তার সঙ্গে সত্যি সত্যি ঘটছে সেটা এখনো বিশ্বাস হতে চাইছে না গুঞ্জনের। তার মনে হচ্ছে গোটা ব্যাপারটা একটা দুঃস্বপ্ন! এখুনি হয়তো ঘুম ভেঙ্গে সে জেগে উঠে দেখবে সে বটবৃক্ষে তার নিজের প্রিয় রুমের নরম বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। মাথার কাছে তার বাবা বসা। বাবার কথা মনে হতেই গুঞ্জনের ভীষণ কান্না পায়। সে কী এভাবে একা একা অন্ধকারে দম আটকে মরে যাবে? তবে কী আর ওদের সাথে দেখা হবেনা? বাবা, শোভন ....কতকিছু বলার ছিল ওদের! গুঞ্জন চিৎকার করে ওঠে, তবে সেটা ভোঁতা একটা শব্দের মতো অন্ধকারে গুমরে মরে। মাথায় হাত বুলিয়ে হাতটা চোখের সামনে ধরতেই তাতে রক্ত দেখতে পায় শোভন। অনুভব করে ঘাড় বেয়ে রক্তের ধারা নেমে তার শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে। শোভনের খুব ক্লান্ত লাগে। ইচ্ছে হয় এখানেই কোথাও শুয়ে পড়তে। মাথার ভেতরে একশো একটা ঝিঁঝিঁ পোকা যেনো মিহি সুরে গান গাইছে। কিন্তু এই মুহুর্তে এখানে শুয়ে পড়ার মানে হচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। কে জানে লোকগুলো তাদের আরো সঙ্গী সাথী নিয়ে ফেরৎ আসে কিনা! যেভাবেই হোক তাকে কবরস্থান ত্যাগ করতে হবে। শোভন হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে সামনে এগোয়। কবরস্থানের বাইরে এসে দেখে লোকটা এখনও মাটিতে হাত পা ছড়িয়ে অদ্ভূতভাবে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে। কাছে যেতেই একটা তীব্র কটু গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দেয় শোভনের। জ্ঞান হারাবার আগে লোকটা বোধহয় ভয়ে পেশাব করে দিয়েছিল। শোভন নাক কুঁচকে দেখে লোকটা নিজের পেশাবের মাঝেই পড়ে আছে। সে বসে লোকটার গালে মৃদু চাপড় দিয়ে তার জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করে। কিন্তু লোকটা কোন সাড়া দেয় না। শোভন মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তার জড়তা কাটানোর চেষ্টা করে। সে বুঝতে পারে এই মুহুর্তে লোকটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। আবার লোকটাকে এই নির্জন রাস্তায় একা ফেলে রেখে যেতেও মন সায় দেয় না তার। সে উঠে দাঁড়ায়, তারপর লোকটার একটা হাত ধরে অন্য হাতে লাঠিতে ভর দিয়ে লোকটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আগে বাড়ে। অন্যসময় হলে শোভন অনায়াসে লোকটাকে টেনে নিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু এখন তার নিজের শরীরটাই নিজের কাছে বোঝার মতো মনে হয় ওর। মাথার ঝিমঝিমে ভোঁতা ভাবটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে। শোভন বুঝতে পারে খুব দ্রুত সাহায্য না পেলে রক্তক্ষরণেই মৃত্যু হবে ওর। শরীর চলতে চায় না, কিন্তু প্রচন্ড মানসিক শক্তির কাছে পরাস্ত হয় শরীরের চাওয়া। কলেজের পুরনো বন্ধু অধরার বিয়েতে শরিক হতে গুঞ্জনকে সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইলের পলাশডাঙ্গা গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হয় শোভন। কিন্তু সেখানে যেতেই অদ্ভুত এক রহস্যের সম্মুখীন হয়। গ্রামের আধপাগল যুবতী মেয়ে স্বর্ণার মৃত্যু রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে অদ্ভুতুড়ে সব রহস্যের জালে। স্বর্ণার মৃতদেহ হঠাৎ গায়েব হয়ে যায় কবর থেকে, তার বদলে কবর খুঁড়ে পাওয়া যায় একটি শেয়ালের মৃতদেহ। গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকজন বলাবলি করতে থাকে স্বর্ণার উপরে নাকি খারাপ জ্বিনের আছর ছিল তাই সে মরে শেয়াল হয়ে গেছে। এদিকে রহস্য উন্মোচনের নেশায় প্রতি পদে পদে বিপদের মুখোমুখি হতে হয় শোভনকে। বুঝতে পারে, এবার ভয়ঙ্কর কিছু ঠান্ডা মাথার খুনির সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছে সে। তবু মৃত স্বর্ণাকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শোভন। তুখোড় বুদ্ধি আর প্রচন্ড সাহস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সকল রহস্য উন্মোচনে।