কবি ও প্রাবন্ধিক করমরুদ্দিন আহমদের একটা বিশেষ পরিচয় ইতোমধ্যে পাঠক সমাজের সাথে গড়ে উঠেছে। কারণ, ইতোপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে তার তিনটি চিন্তাসমৃদ্ধ প্রবন্ধগ্রন্থ আধুনিক কবিতা: প্রাসঙ্গিক বিবেচনা, আলমাহমুদ: কবি কথাশিল্পী, এবং ‘চট্টগ্রামের কবি সাহিত্যিক’। বর্তমান গ্রন্থ ‘অসাম্প্রদায়িকতার শ্রেষ্ঠ কবি ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ তার চতুর্থ প্রবন্ধ গ্রন্থ। ৪১টি প্রবন্ধ এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আশা করা যায় তার বর্তমান প্রবন্ধ চিন্তার উৎকর্ষ প্রকাশ করবে। কমরুদ্দিন আহমদ পেশায় একজন কলেজ শিক্ষক। চট্টগ্রামের বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রাধানের দায়িত্বে কর্মরত আছেন। পেশাগত কারণেও আলোচনা সমালোচনা ও প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রতি তার একটি বিশেষ আগ্রহ- দীর্ঘদিন থেকে প্রত্যক্ষ করা গেছে। তার আগ্রহের ফসল প্রবন্ধগুলির সার্থকতা বিচারের ভার পাঠকের কাছে এবং গুনমান বিদগ্ধদের হাতে ছেড়ে দেয়াই উত্তম। আমরা জানি প্রবন্ধ হচ্ছে বোধ ও মনন এবং বিবেচনা ও জ্ঞানের সংবাদবাহী গদ্যশিল্প। সাধারণ বিবেচনা থেকেই প্রবন্ধ সম্পর্কে একথা বলা। মূলত প্রবন্ধের বিষয়-আশয় ও পরিধি আজকের যুগে অনেক বিস্তৃতি নিয়েছে। তবে রচয়িতার ক্ষমতা ও চিন্তনগুনে প্রবন্ধ সাহিত্য মর্যাদা পেয়ে যায়। এর প্রমাণ বাংলা সাহিত্যেই আছে প্রচুর। মানতেই হবে- আলোচনা সাহিত্যকে সাহিত্যে উত্তীর্ণ করণের জন্য লেখকের শ্রমনিষ্ঠা ও প্রজ্ঞা প্রয়োজন। অর্থাৎ বিষয়টি সাধনার। কমরুদ্দিন আহমদের গদ্যভঙ্গির মধ্যে একটা সহজবোধ্য-সরল প্রকাশবোধ আছে। সহজবোধ্যতা ও সরল প্রকাশ ভঙ্গিকে গুণ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। আর যদি মতামত ও ধারণা নির্মাণের কথা বিবেচনা করি তা পাঠকের রুচি ও চেতনাই- নির্ধারণ করবে শ্রেয় বা অশ্রেয়। পাঠক কমরুদ্দিন আহমদের সকল মতামত- বোধ ও চেতনার সাথে একমত হবেন এমন নয়। তবে তার প্রবন্ধসমূহ তার চিন্তা ও চেতনামূলকে পাঠকের সামনে তুলে ধরবে এ বিশ্বাস রাখা যায়। ‘অসাম্প্রদায়িকতার শ্রেষ্ঠ কবি ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ গ্রন্থ বিভিন্ন সাহিত্য ব্যক্তিত্বের সাহিত্য আলোচনা ও চট্টগ্রামের ভাষা ও লোকজ সংস্কৃতি বিষয়ে ৪১টি প্রবন্ধের একটি সংকলন। তবে গ্রন্থের নামকরণ থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে লোক -অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ এবং চেতনাবোধের কবিকেই তিনি গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন বেশি। ফলে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য-কাব্য- সমাজচিন্তাকে নিয়েই স্থান পেয়েছে পাঁচটি প্রবন্ধ: নজরুল- অসাম্প্রদায়িকতার শ্রেষ্ঠ কবি, বাংলা সাহিত্যে নজরুল, নজরুল আমাদের সুযোগ্য প্রতিনিধি। নজরুলের প্রেম চেতনায় ইন্দ্রিয়ানুভূতির শিহরণ এবং নজরুলের ছড়ায় শিশুতোষ ব্যঞ্জণার দ্যুতি। অসাম্প্রদায়িক বোধ মানে মানবজাগরণবোধ এবং সর্বাংশে মনুষ্যত্ববোধ। অর্থাৎ মানুষই- মানুষের সহ্য বিবেচনাবোধ- আর বিশিষ্ট আচরণবোধ মানব তথা মানুষ বিচারের মাপকাঠি। অসাম্প্রদায়িক চেতনা মানবচিন্তার ইহলোকিক শুভবোধেরই চেতনা। লেখক কবি নজরুলের আসাম্প্রদায়িক চেতনা, রচনা এবং সংগ্রাম, জীবনবোধের বিশিষ্টতার উপরই গুরুত্ববহ আলোকপাত করেছেন। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ মুক্তবুদ্ধি ও গণতান্ত্রিক চেতনাবোধেরই শর্ত-পূর্বশর্ত। বাংলা সাহিত্যে লোকজ সহজিয়া চেতনাবোধ যা অসম্প্রদায়িক চেতনাবোধের ঐতিহ্য ও বিকাশ- তার বিস্তরণ সমূদয় দীর্ঘকালের। বাংলা ভাষা ও বাঙালি জীবনের লৌকিক সহজিয়া ও মহত্তম ধারাতেই তা বিকশিত হয়েছে। চ-ীদাসে আমরা কী দেখি? দেখি-চ-ীদাস মানুষকে, মানব সমাজকে ডেকে বলেছেন: ‘শোন হে মানুষ ভাই/সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ কবি আলেকজান্ডার পোপকে যদি স্মরণে আনি তা হলে শুনতে পাই-তিনি বলছেন : ‘The proper study of mandkind is man’। আমরা জানি বাংলা সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক মানবচেতনাবোধের অসামান্য ও অতুলনীয় উদ্বোধন ও উৎসারণ বিকশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলামের কাব্য-সাহিত্য প্রতিভা ও সমাজচিন্তার মধ্য দিয়ে। কবি-দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ মানুষের মধ্যে মানবাত্মা তথা সকল মানুষের মানুষকে দেখতে পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ সকল ভেদবুদ্ধি ও দুর্বুদ্ধির তিলকপরা তথাকথিত মানুষের উর্দ্ধে এক চিরকালীন অসাম্প্রদায়িক মনুষ্যত্ববোধের মানুষের জয়গান গেয়েছেন। সাহিত্য ও জীবন দর্শনে মানবিক মানুষই ছিলো তার আরাধ্য। আর নজরুল-যাকে আমরা বিদ্রোহী কবি বলি- তিনি জাতপাত কুসংস্কার অন্যায় ও ধর্মাগ্ধতার বিরুদ্ধে, দেশি-বিদেশি সকল জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে দ্রোহের কাব্য সৃষ্টি-উচ্চারণ-অবৃত্তি করেছেন। স্বাধীনতার জন্য সাম্যের জন্য মানুষের জন্য অসাম্প্রদায়িক জীবন সংস্কৃতির জন্য-হিন্দু ও মুসলমানের গভীরতম হৃদয় সম্প্রীতির জন্য, সংগ্রাম করেছেন-কাব্যের রাজনৈতিক চেতনার জন্য জেল খেটেছেন। তার উন্নত শির বিদ্রোহী চেতনাবোধের জন্য তার গ্রন্থসমূহ সরকার নিষিদ্ধ করেছে। সেই সংগ্রামী মনুষ্যত্ববোধ বিদ্রোহী মহৎ কবি ব্যক্তিত্ববোধ নজরুলের কণ্ঠে শুনি: ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।/ মানুষেরে ঘৃণা করি/ ও, কারা/ কোরান বেদ বাইবেল চুম্বিছে সারি সারি।’ এবং আরও বলেছেন: ‘মূর্খরা সব শোনো মানুষ এনেছে গ্রন্থ, আনেনি মানুষ কোনো; নজরুলের এই মানবিক অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধকেই কমরুদ্দিন আহমদ তার ‘নজরুল অসাম্প্রদায়িকতার শ্রেষ্ঠ’ কবিতে আলোচনায় এনেছেন। পাশাপাশি এনেছেন নজরুল কাব্যে প্রেম চেতনাবোধ ও নজরুলের সাহিত্য নিয়ে ভিন্ন প্রবন্ধ। মনে হয় একটা সম্পূর্ণ নজরুলকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। এ প্রসঙ্গকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। কমরুদ্দিন ৪১টি প্রবন্ধ নিয়ে কথন রচনা এই মুখপাতের লক্ষ্য নয়। প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে লেখকের দৃষ্টিপাত কোথায় কাদের উপর পড়েছে বিশিষ্টতায় তার একটি কথা চিত্র তুলে ধরা। আধুনিক কবিদের নিয়েও কমরুদ্দিন অনুসন্ধিৎসু হয়েছেন। আমাদের শুদ্ধতম কবি রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে- ‘কবি জীবনানন্দ দাশ’ এবং ‘কবিদের কবি জীবনানন্দ দাশ’ শীর্ষক দুটি প্রবন্ধে কমরুদ্দিনের চিন্তার অভিনিবেশ আছে। কবি সুবীন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে লিখিত প্রবন্ধ তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে জীবনের মৌল সত্য অনুসন্ধানের কবি হিসাবে। বিষয়টি পাঠকের দৃষ্টি অকর্ষণ করতে পারে। আমরা দেখেছি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘অর্কেস্ট্রা’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় বলেছিলেন- স্বপ্নচারী পথিকের মতো অনুপ্রাণিত কবিকেও তিনি ভয় পান। তিনি বিশ্বাস করতেন এবং সাহসের আস্থা নিয়ে বলেছিলেন- স্বপ্ন ও অনুপ্রেরণার জোরে কাব্য রচনা অসম্ভব। গ্রন্থটিতে বিশিষ্টতায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের নাগরিক বোধের পথিকৃৎ, কবি শামসুর রাহমান। তাঁকে নিয়ে প্রবন্ধ ‘শামসুর রাহমানের নাগরিকতা।’ বাংলাদেশের যে কয়জন কবি শব্দবোধ- চেতনা ও দৃশ্যকে নাগরিক কোলাহল থেকে তুলে এনে কবিতায় স্থাপন করেছেন- নিজস্ব কবি চারিত্র্যে শামসুর রাহমান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সময়ের আলোড়ন শামসুর রাহমানের কবিতায় বিশেষভাবে বিধৃত হয়েছে। শামসুর রাহমানের সাথে আছেন নাগরিক সত্তার বিশিষ্টবোধের সচেতন কবি শহীদ কাদরী। বলা যেতে পারে-শহীদ কাদেরীকে বলা যেতে পারে ক্লেদ ধোঁয়াশা জঞ্জাল বোধের পচন আর চড়–ইভাতিকে অনায়াস শিল্প সম্মতিতে প্রকাশ করেছেন কবিতায়। মূলত চেতনার সামগ্রিক বোধেই শহীদ কাদরী নাগরিক কবি- সুধীন্দ্রানাথের ভাবনাকে যিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন। ‘সোনালি কাবিনখ্যাত কবি আল মাহমুদের কবিসত্তা নিয়ে ‘আল মাহমুদ কবি ও কথাশিল্পী’ নামক একটি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ থাকা সত্ত্বেও কমরুদ্দিন তার সনেট নিয়ে একটি উৎসাহী আলোচনা যুক্ত করেছেন বর্তমান গ্রন্থে। গ্রন্থিত হয়েছে বিশিষ্ট কবি ময়ুখ চৌধুরীকে নিয়ে কাব্যালোচনা। সাথে আছেন আহমদ ছফা ও ঔপন্যাসিক হরিশংকর জলদাস। ‘চট্টগ্রামে লোকজ সংস্কৃতির রূপান্তর’ ও চট্টগ্রামী ভাষা সহ অন্যান্য প্রবন্ধগুলির লেখক কমরুদ্দিন আহমদকে অবশ্যই পাঠক প্রিয়তা দেবে প্রবন্ধ সাহিত্যে-সমালোচনা সাহিত্যে তাঁর সৃষ্টিসমূহ নন্দিত হোক- শ্রমনিষ্ঠ অধ্যাবসায় তাকে উত্তরোত্তর গুনমান করে তুলুক এ কামনা করছি। মননশীলতায় তাঁর স্থায়ী আসন গড়ে উঠুক প্রবন্ধ সাহিত্যে। চট্টগ্রামের ‘অক্ষরবৃত্ত প্রকাশন’ কমরুদ্দিন আহমদের ২৮০ পৃষ্ঠার বড় আকারের প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘অসাম্প্রদায়িকতার শ্রেষ্ঠকবি ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ যতেœর সাথে প্রকাশ করেছে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করছি। ফাউজুল কবির কবি ও প্রাবন্ধিক ফেব্রুয়ারি’ ২০২০
কমরুদ্দিন আহমদ কবি ও নিরন্তর পর্যেষক। জন্ম: ৩১ মার্চ ১৯৬৫ প্রকৃতির নন্দনআলয় বাঁশখালী উপজেলার পুকুরিয়া ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। প্র-পিতামহ জমিদার শেখ আশরফ আলী, পিতামহ মাস্টার ছালেহ আহমদ, পিতা মাস্টার শামছুদ্দিন আহমদ। পিতাই তাঁর প্রথম শিক্ষাগুরু। তিনি ১৯৮৭ খৃস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলাসাহিত্যে অনার্সসহ এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নেন পারিবারিক ঐতিহ্য-সূত্রে। ১৯৯২ খৃ. হতে বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজে অদ্যাবধি অধ্যাপনা করছেন। শিক্ষকতার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০১৯ খৃ. বাঁশখালী উপজেলার শ্রেষ্ঠ কলেজ শিক্ষক সম্মাননা অর্জন করেন। ১৯৯৫ খৃ. থেকে দৈনিক পূর্বকোণ ও আজাদী পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে প্রবন্ধ লিখে প্রাবন্ধিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বর্তমানে দেশসেরা সাহিত্যের কাগজ কালি ও কলমসহ জাতীয়, স্থানীয় পত্রিকার সাহিত্যসাময়িকী এবং দেশের সাহিত্য-ম্যাগাজিনগুলোতে নিরন্তর • ২য় ফ্ল্যাপে দেখুন