সম্পর্কের ভাল মন্দ আছে। প্রতিটি সম্পর্কের আছে নিজস্ব গল্প। এসব টুকরো টুকরো গল্প নিয়েই জীবন। সরল সম্পর্কের এলোমেলো সমীকরণ কখনও কোথাও জটিল কিংবা যৌগিক। বেলাশেষে সম্পর্কের হিসাব পাকা না হলেই গোল বাঁধে। ‘কালো জল’ সম্পর্কের মিল-অমিলের সমীকরণ। বায়ান্ন বাজার তেপান্ন গলির ঢাকার ছেলে হাসানের সঙ্গে সুলতানার সংসার। বউ বাচ্চার পাওয়া কিংবা না পাওয়ার হিসাব নিকাশ। আবার মা-হারা ডা. মাহী, তার শেকড়ের টানে ছুটে চলা। সেখানে পিতা-পুত্রের সম্পর্কের টানাপোড়েন। মাহীর নতুন চোখে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। আর মায়ার সম্পর্কে রত্না-মাহীর বাঁধা পড়া। ‘কালো জল’ উপন্যাসের শুরুটা এমন। ‘শালায়, পাইলসের জন্য চেয়ারে ঠিকমতো বসবার পারে না, আবার পোলা হইছে! পরপর তিন তিনটা মেয়ে, এখনো বংশরক্ষা হইল না। বন্ধুদের যেখানে একটা, না হয় বড়োজোর দ্ুিট বাচ্চা। আর আমার স্ত্রীরে বছর বছর পোয়াতি কইরাও মনের আশ মিটল না।’ ফেসবুকে ‘কনগ্র্যাচুলেশন’ শব্দটা লিখেই হাসান মনে মনে এইসব বিড়বিড় করছিল। অন্তর জ্বালা! কারো পৌষমাস আর কারো সর্বনাশ। ফুটফুটে সদ্যোজাত শিশুর ছবি দিয়ে লিখেছে, ‘আবার পুত্রসন্তানের জনক হলাম। রাজপুত্র ও তার মা ভালো আছে। সবাই দোয়া করবেন।’ সবাই গদগদ হয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে জুয়েলকে। ডা. মাহীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ তার দাদার বয়ানে- ‘আমার ছেলে মহিউদ্দিন চৌধুরী বীর মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তর সালের সেই কালো দিনগুলোর কথা একদিনের জন্য ভুলে যেতে পারিনি। পাকবাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে গেল চৌধুরী সাহেবের ছেলে মুক্তি। আমার ছেলেকে না পেলে পুরো গ্রাম তছনছ করে দেবে। এলাকার সবাইকে বাঁচাতে তিন জওয়ান পোলাকে ওদের হাতে তুলে দিলাম। ওই যে বসে আছে রামচন্দ্র, মোহাম্মদ আলী। তাদের ছেলে। আর ইব্রাহীমের ছেলেকে মহিউদ্দিন চৌধুরী বানিয়ে ওদের হাতে তুলে দিলাম। অত্যাচার করে ছেলেগুলোকে মেরে ফেলল। ছেলের মৃত্যুশোকে ইব্রাহীম মারা গেল। আমি সেদিন পাপ করেছি। রামচন্দ্র, মোহাম্মদ আলী, ইব্রাহীমের পরিবারের কোনো অভাব আমি রাখিনি। কিন্তু ওদের চোখের দিকে তাকাতে পারি না। একটা পাপবোধ আমাকে কুঁরেকুঁরে খায়। যুদ্ধশেষে আমার ছেলে স্বাধীন দেশে ফিরে এলো। এসব ঘটনা জানতে পারল। তার পিতা অপরাধ করেছে। ভুল করেছে। আমার একমাত্র সন্তান মহিউদ্দিন- আমাকে ছেড়ে চলে গেল। ওরা শহিদ সন্তানের পিতা। আর আমি পুত্র বেঁচে থাকতেও সন্তানহারা পিতা। এটা কী যে কষ্টের, দুর্বি-সহ যন্ত্রণার। মৃত্যুপথযাত্রী বউমাকে শেষ দেখাটা দেখতে পারিনি। আমার নাতিকে দেখিনি। ওকে আদর করতে পারিনি। জড়িয়ে ধরতে পারিনি। ওর সঙ্গে খেলতে পারিনি। ওর বন্ধু হতে পারিনি। মাহী, দাদুভাই আমার বুকে আয়।’
এম মামুন হোসেন পেশায় সাংবাদিক। পৈতিৃক ভিটে বিক্রমপুর (মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা) হলেও জন্ম ও বেড়ে উঠেছেন পুরান ঢাকায়। তাই পুরান ঢাকার প্রতিটি অলিগলিতে রয়েছে তার শেকড় পোতা। উত্তরাধিকার সূত্রেই তার আগ্রহের বিষয় ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এম মামুন হোসেন একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) ও এমবিএ করেছেন। ২০১৭ সালে ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে ‘নামকরণের ইতিকথা’ শিরোনামে পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ‘কী শিখছে শিশুরা’ শিরোনামে তিন পর্বের ধারাবাহিক শিক্ষাবিষয়ক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য পেয়েছেন ডিআরইউ-গ্রামীণফোন রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড ২০১৪। ‘বেসরকারি ৩ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ ক্যাম্পাস বিক্রি’ শিরোনামে অনুসন্ধানী শিক্ষাবিষয়ক প্রতিবেদনের জন্য ২০১১ সালে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পান। এছাড়া জেন্ডার আইডেনটিটি নিয়ে মানবিক প্রতিবেদনের জন্য ইউএনডিপি অ্যাওয়ার্ড-২০১৪, কুষ্ঠ রোগ নিয়ে সচেতনতামূলক প্রতিবেদনের জন্য ল্যাপ্রসি মিশন অ্যাওয়ার্ড-২০১৪, প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য পেয়েছেন দ্যা ফ্রেড হলোস ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড। সাংবাদিকতায় তার আগ্রহের বিষয় হচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ, মানবাধিকার, স্থানীয় সরকার ও সুশাসন। ভারত, দুবাই, তুরস্ক, ডেনমার্ক, সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। ‘নিজের শব বহন’ তার প্রথম কবিতার বই। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত এ বইটির জন্য তাকে ‘দিগন্ত ধারা সাহিত্য পুরস্কার-২০১৯’ পুরস্কার দেওয়া হয়।