পদ্মাপারের মানুষ আমি। ছোটবেলা থেকেই পদ্মাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। একেবারে প্রথম যখন পদ্মার ভাঙন দেখি, তখন আমি খুবই ছোট ছিলাম। তখন রামকৃষ্ণপুর স্কুল ভাঙছে। পাশেই রামকৃষ্ণপুর হাসপাতাল ছিল। হাসপাতালও ভেঙে যায় যায় অবস্থা! সেই সময়ে হাসপাতালের সাথেই আমার খালার বাড়ি ছিল। মূলত আমার দাদির এক আত্মীয়র বাড়ি যাওয়ার পথেই সেই খালার বাড়িতে যাওয়া। আমাদের মানিকনগর থেকে রামকৃষ্ণপুর হাসপাতালের দূরত্ব ছিল দুই-তিন মাইল। অল্প বয়সে এতখানি রাস্তা হেঁটে যাওয়া আমার জন্য খুব কষ্টের ছিল। কিছুদূর পরপরই বসে যেতাম। আমার বিরক্তিতেই আমার দাদি খালার বাড়ি যেতে বাধ্য হয়। বিশ্রামও হলো খালার বাড়ি বেড়ানো হলো। তখন রামকৃষ্ণপুর ভাঙা বাজারের ঘর বা দোকানগুলো খালাদের বাড়ির সামনে এলোমেলোভাবে রেখেই দোকানদারি করছে। নদী ভাঙার ভয়াবহতা নিজের চোখে দেখলাম। দেখলাম মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ। তার পর তো সব ইতিহাস। হরিরামপুর, শিবালয় থানাই বেশি ভাঙনের শিকার। তার মধ্যে সুতালড়ী, বয়ড়া, কাঞ্চনপুর, গোপীনাথপুর ক্ষতিগ্রস্ত বেশি। রামকৃষ্ণপুর এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত যে এই ইউনিয়নের অস্তিত্ব নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পথে। এই নদী ভাঙার প্রভাব সরাসরি এই এলাকার মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে। অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, এমনকি শিক্ষার দিক থেকেও এর ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যায়। এই সব নদী-নদীর পাল তোলা নৌকা দেখে বড় হয়েছি। নদী ভাঙার সাথে দেখেছি বহু মানুষের উত্থান-পতন। দেখেছি অনেক সুখী ও সচ্ছল মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত নদীর কাছে পরাজয়। দেখেছি নদী ভাঙার সাথে সাথে এই সব মানুষের স্বপ্নটাও কীভাবে ভেঙে যায়। অনেক ভালো মানুষের অর্থনৈতিক পরাজয় কীভাবে হয়। দেখেছি তাদের দুঃখ হাহাকার। তাই আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে এই পদ্মাপারের মানুষের দুঃখের জীবনকাহিনি সমগ্র দেশের মানুষের নজরে আনা দরকার। যাতে সমাজের বিবেকবান মানুষ এবং ক্ষমতার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের নজরে আসে। এটা আমার জন্মস্থান, এই সব সহজ-সরল মানুষের সাথেই কেটেছে আমার ছেলেবেলা, কিশোরবেলা। যদিও জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে প্রবাসে থাকি। তবুও ছেলেবেলার সেই স্মৃতি আমাকে আজও পিছু টানে। সেই সব কথা মনে হলে আমি এখনো কাদামাটির গন্ধ পাই। হাজার কয়েক মাইল দূরে থেকেও সেই সব মানুষের কোলাহল শুনতে পাই। চোখের সামনে ভেসে ওঠে গ্রামীণ মেঠোপথ, গোধূলিবেলায় গরুর পাল নিয়ে কৃষকের ঘরে ফেরার দৃশ্য। ডাঙ্গুলি খেলার কথা। আরো কত রকমের ছেলেবেলার সেই দুরন্তপনা। তাই এই লেখার মাধ্যমে এলাকাকে ছোট করা বা কারো জীবনকে ছোট করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বরং নদীতে ভাঙার বাস্তব নির্মম এক কঠিন সত্য কাহিনি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা। এর সবই আমার নিজের ব্যক্তিগত অনুভ‚তিমাত্র। তাই লেখায় কোথাও ভুল হলে বা কারো মনে ব্যথা পেলে ক্ষমা করে দেবেন। - আব্দুল গফফার