"ছেলেবেলার মুক্তিযুদ্ধ" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ উনিশশ একাত্তর। ফাগুনের আগুনঝরা দিনগুলােতে মিটিং, মিছিল, গানে মুখরিত সারা দেশ। প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে বাঙালি। বিগত সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পরও পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিদের নতুন সরকার গঠন করতে দিচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে ঘােষণা করেছেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' তাঁর আহবানে দেশব্যাপী শুরু হয়েছে পূর্ণ অসহযােগ, ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তােলার প্রস্তুতি। কিশােরগঞ্জ শহরে একই উত্তেজনা। দুরন্ত কিশাের সত্য। বাবা স্থানীয় গুরুদয়াল কলেজের অধ্যাপক, ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষাগুরু আর রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু। দিন রাত ভক্ত ছাত্রদের সাথে সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর গভীর আলােচনা। বাড়িতে এসব শুনে সত্য বুঝতে পারে পাকিস্তানিরা যে-কোনাে দিন আক্রমণ করতে পারে। দেশকে মুক্ত করার জন্য ওদের বিরুদ্ধে সবাইকে যুদ্ধ করতে হবে। তাই সে মুক্তিযুদ্ধ করতে বানিয়েছে এক 'লাঠি-বন্দুক’! সত্যের আর খেলাধুলা বা পড়ালেখায় মন নেই। ক্লাস ফোরের নতুন বইয়ের চাইতে মিছিলের স্লোগান তাকে বেশি টানে। মছিল এলে সে এক দৌড়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে যায়, সবার সাথে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেয়, ‘জালাে জ্বালাে, আগুন জ্বালাে, ইয়াহিয়ার গদিতে, আগুন জ্বালাে একসাথে’, ‘জয় বাংলা'। চারদিকে এক অন্য রকম অনুভূতি, অন্য রকম উত্তেজনা! খবর এলাে ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে পাকবাহিনী ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। শত শত বাঙালি হত্যা করেছে। মানুষ প্রাণভয়ে ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছে ঘটনার আকস্মিকতা ও নৃশংসতায়। সবাই আতঙ্কিত। নতুন প্রত্যয়ে কিশােরগঞ্জের মহল্লায় মহল্লায় চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। প্রতিটি বাড়িতে ট্রেঞ্চ কাটা হয়। দরােজা-জানালায় লাগানাে হয় কালাে কাগজ। বিমান আক্রমণের সাইরেন ও ব্ল্যাকআউটের অনুশীলন চলে। ২৯ মার্চ গাজীপুর থেকে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আসে কিশােরগঞ্জে। ক্যাম্প বানায় আজিমুদ্দীন হাইস্কুলের মাঠে। এক বিকেলে হঠাৎ বেজে ওঠে সাইরেন, পর মুহর্তে কিশােরগঞ্জের আকাশ বিদীর্ণ করে খুব নীচু দিয়ে উড়ে যায় দুটি পাকিস্তানি ফাইটার প্লেন। সাথে সাথে কানফাটা শব্দে ফায়ারিং করে ইস্ট বেঙ্গলের বিমানবিধ্বংসী কামান। পরদিন থেকে দলে দলে মানুষ শহর ছেড়ে পালাচ্ছে গ্রামে। সত্যরাও ট্রাকে, নৌকায় চড়ে তাদের গ্রাম নরসিংদী জেলার সররাবাদে চলে যাচ্ছে। সত্যের হাতে তার লাঠি-বন্দুক, সেটাতে বাঁধা বাংলাদেশের নতুন লাল-সবুজ পতাকা। যে-কোনাে সময় পাকবাহিনী আক্রমণ করতে পারে। যুদ্ধ করতে হবে ওদের বিরুদ্ধে।