নারী এক অসাধারণ সৃষ্টি, যেমন সুখের তেমন বিষেরও। পুরুষ সর্বগ্রাসী কুমির। নারীর শরীর, শরীরের মাংসের তোরণ ভোজনে ভীষণ পটু। যখন একক নারীমাংসে ক্লান্তি, বহুনারীতে আগ্রহ কিংবা আসক্তি জন্মে, তখন আসে নিজেদের মাৎসায়নে বানানো দগ্ধ হেরেমে, প্রচলিত বাংলায় পতিতালয়, পতিতাপল্লি, বেশ্যালয় আর উন্নয়নের ভাষায় যৌনপল্লি। যৌনপল্লি বাংলাদেশে কতোগুলো? এবং সেই সব যৌনপল্লিতে যেসব নারীরা আসেন, আসতে বাধ্য হন, যাপন করেন বিষাক্ত জীবনপ্রণালী, তাদের প্রতিদিনের রক্তমাংস বিক্রির খবর নিয়ে অসামান্য পুস্তক, গুহান্তরাল রচনা করেছেন শাহাজাদী বেগম। শাহাজাদী বেগম লেখক নন কিন্তু কর্মক্ষেত্রের প্রয়োগ বাস্তবতায় তিনি যৌনকর্মীদের জীবন খুব কাছ থেকে দেখেছেন, দেখেছেন শরীরশিল্পীদের আর্তি ও আর্তনাদের দিনরাতের তিক্তলিপি, প্রতিলিপি। ফলে প্রতিক্রিয়ার যে চেতনতরঙ্গ তৈরি হয়েছে, সেই অভিঘাতে বুনন করেছেন গুহান্তরাল। ঘাটে ঘাটে গিয়েছেন, আলাপ করেছেন, স্থানীয় মহাজন, প্রশাসনের নির্লিপ্ত কুশিলবদের কাণ্ডজ্ঞান মেপেছেন এবং অর্জিত গরল অনায়াস মানবিক শব্দে সাজিয়েছেন। গুহান্তরাল প্রচলিত ফরমেটের উপন্যাস আখ্যান নয়, এটা সমীক্ষা উপন্যাস। সমীক্ষা বা গবেষণার পাস্তুরিত বোধে যৌনকর্মীদের আনন্দ বেদনার জর্জরিত অভিজ্ঞতা এবং ভেতরের ভেদ ও অভেদ আবিষ্কার করেছেন নিজস্ব প্রণোদনায়। ফলে, গুহার ভেতরের অন্ধকার, থকথকে পাশবিক রক্তাক্ত দেহের পাঁচালী উঠে এসেছে অবিকল চিত্রকল্পে। গুহান্তরাল বইটি খুলে দেয় পুরুষ শাসিত সমাজের নিকৃষ্ট মুখোশগুলো। দিনের মঞ্চের আলোয় যে মুখগুলো ক্ষমতার ঢালে চড়ে সমাজে দাপিয়ে বেড়ায়, অন্ধকারের সেই মুখগুলো কতোটা হিংস্র আর রক্তপিপাসু, তারও গাথা রচনা করেছেন শাহাজাদী বেগম, গুহান্তরাল উপন্যাসে। পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থান পতিত পুরুষেরা সচেতনে ভোগ করে। তিলে তিলে যন্ত্রণার বেদীমূলে যে যৌনপল্লি গড়ে ওঠে, মূলত সেই যৌনপল্লি পৃথিবীর মৌলিক আশ্রম। গুহান্তরাল সেই আশ্রমের অভিন্ন মানচিত্র!