কলোনি-পরবর্তী রূপান্তরের পিঠে দাঁড়িয়ে সাহিত্যে প্রথমে যে চিহ্নায়ন দরকার- কবিতায়, গদ্যে বা যেকোনও মাধ্যমেই, সেটা হবে নিজস¦ ভাষার উপলব্ধিতে পৌঁছানো। ফয়েজ আলমের কাব্য জলছাপে লেখার মধ্যে কলোনির প্রভাবে গড়া-ওঠা ভাষার রূপরেখা ভাঙবার অদম্য প্রেরণা। তাঁর কবিতায় বি-উপনিবেশায়ন হয় নিজের চেনা জগতে, কুড়িয়ে আনা নিজের স্বরে ও সুরে।[...] চিহ্নায়নের ভেতর সচেতনে রচিত হয় তাঁর কবিতার ভাষা ও শব্দ। তিনি গণমানুষের মুখের ভাষা থেকে নিয়ে একটি নতুন কাব্যভাষা তৈরির চেষ্টা করেন যার মধ্যে জমা রয়ে গেছে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আমাদের ভাব ও সাংস্কৃতিক অর্জনের চিহ্ন। [...] তাত্ত্বিক মনোভঙ্গির ধারাক্রমেই যেন তাঁর কবিতা স্বাতন্ত্রিকভাবে পুবেরই কবিতা হয়ে উঠেছে, যে পুবকে ‘আন’ (আদার) অভিধায় নিকৃষ্টতার শামিয়ানার তলে অস্পৃশ্য হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছে পশ্চিম। [...] তাঁর কবিতায় বাস্তব পরাবাস্তবের আবরণে জড়িয়ে থাকে জাতির অবচেতনের সঞ্চয়ও। [...] স¦নির্ভর হওয়ার স¦ার্থেই ভাষার নিজস¦তা চিনে নেওয়া এবং নিজ ভাষার মধ্য দিয়ে আপন জগৎ ও অতীত ঐতিহ্যের ওপর দাঁড়িয়ে নিজের কাল ও চারপাশের জগতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার একটা উত্তর-উপনিবেশী রূপরেখা আমরা ফয়েজ আলমের কবিতায় পাই।
ফয়েজ আলমের চিন্তার ধরন, রোখ ও জায়গা আমাদের প্রচলিত ধারার সাহিত্যভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা থেকে ভিন্ন। একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক, উত্তর-উপনিবেশী তাত্ত্বিকা উপনিবেশী শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখী প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশী আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁর লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাস করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল, ডিগ্রি লাভ করেন ফয়েজ আলম। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি (গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাঈদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশী মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২)।