আমাদের বাংলা লোকসংস্কৃতি সব সময়ে একটি বিরুদ্ধ স্রোতের মুখোমুখি, আজও ব্যতিক্রম নয়। বাউলসাধকরা আক্রান্ত হয়েছেন তাঁদের ভাবনা, বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। তথাকথিত মোল্লাতন্ত্র ও তার আস্ফালনের বিপরীতে একতারাকে সঙ্গী করে তাঁরা বিভোর থেকেছেন- সংগীতের ধারায়। মানবতাবাদকে উচ্চস্থান দেওয়া এই পির ফকির বাউলরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে মহিরুহ। এর কৃত্রিম কোনও সীমান্ত নেই। শ্রীচৈতন্য চিন্তনবাহিত বৈষ্ণবীয় অসাম্প্রদায়িকতাও এঁদের মাঝে লালিত। বিপরীতে রয়েছে মৌলবাদের অসহিষ্ণু উত্থান। পঙ্খিরাজ কারও জীবনবৃত্তান্ত নয়, মূলত অনেক বাস্তবতার প্রেক্ষিত, নানাসংকট, সংশ্লিষ্ট জগৎভাবনাকে উপজীব্য করে লেখা আলেখ্যমাত্র। একটি কাহিনির ডালপালা অবশ্যই বৃক্ষসম অবস্থান থেকে উৎকীর্ণ হতে হতে এক সময়ে দাঁড়ায় কারও না-কারও দোরগোড়ায়। এ-কাহিনির অঞ্চল সমগ্র সুনামগঞ্জ জেলা। যে এলাকাটির মানুষ, ছয় মাস কাজ আর ছয় মাস প্রেম করে, গানে মত্ত থাকে-সেই উন্মাতাল ভাটি এলাকার লোকাচার বিধৃত। উঠে এসেছে জীববৈচিত্র্য, প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম, গ্রামীণ নানা প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই, গ্রাম্য অপ-রাজনীতির ঘেরাটোপ, শক্তির প্রতিযোগিতা-প্রভাব বিস্তারের সূক্ষ্ম জাল ছিন্ন করার কথাও। তবে কাহিনির সবকিছু একটি বিন্দুতে স্থির-যেটি আমাদের লোকসাধকদের লড়াই। সে লড়াইয়ের আগুন থামে না। কাহিনিতে, অনেক সময় আমাদের চোখে ভাসে চরিত্রের সাময়িক পিছু হটা, কিন্তু এই পিছু হটা বিপুল বেগে সামনে যাওয়ার মন্ত্র জোগায়। শাহ ছইফুল্লা বাউল এমনি একটি চরিত্র, যে লড়াই করছে একাধারে গ্রাম্য অপসংস্কৃতি, গোষ্ঠীশক্তি এবং মৌলবাদের বিরুদ্ধে। যে লড়াইয়ের বিস্তৃতি ঘটেছে সুনামগঞ্জ থেকে বিলেতপর্যন্ত। কাহিনিতে রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধকালের অগ্নি উত্থিত ঘটনাসমূহ, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ বর্ণনা। আছে, মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে আমাদের সমাজে অমোঘ প্রেরণা ও মুক্তির মন্ত্র হয়েছিল-সেদিনগুলোর কথা। যেদিনগুলোর মাঝে আমাদের সার্বিক মুক্তির লড়াই বলে চিহ্নিত করার বিশ্বাস ছিল প্রোথিত। ‘পঙ্খিরাজ’ সেই অর্থে মুক্তিযুদ্ধেরও আংশিক দলিল।