"স্মৃতিকাহন" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ স্মৃতিকথা লিখতে যেয়ে খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। কোথা থেকে শুরু করব আর কোথায় গিয়ে থামব- হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম। আমার শৈশব ও বাল্যকালের কথা বলতে যেয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি বিধৃত হয়েছে। বাংলা ভাষা আন্দোলনে আমার মামা প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের নিবিড় সম্পৃক্ততা আর বাংলা ভাষা দাবির প্রশ্নে প্রথম সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠিত তমদুন মজলিসের ভূমিকা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। আমার বাবা ভাষা আন্দোলনে জড়িত হয়েছিলেন ছাত্রাবস্থায়। এক ঝাঁকড়া চুলের বিদ্রোহী যেন। বাবা আর পরিবারের কাছ থেকে এ আন্দোলনের নানা ঘটনা শুনে আমি যেন আন্দোলনের একজন দূরবর্তী সাক্ষী হয়ে উঠি। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল এদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। যা আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ- এ বইয়ের উপজীব্য বিষয়। আমার স্মৃতির একটি বড় অংশ জুড়ে আছে স্বাধীনতা যুদ্ধ। শৈশব ও বাল্যকাল নিয়ে যেমন উচ্ছ্বাসের শেষ নেই তেমনি মন খারাপেরও শেষ নেই। খুঁজে ফিরি বন-বনানি, লাল মেঠো পথ, ধানখেত, খালবিল, চোরা কাঁটা, কাশফুল, বুনাে হাঁস, বকের সারি। জ্যোৎস্না রাতের উন্মুক্ত আকাশ উঁকি দিয়ে যায়। কাকভেজা বৃষ্টির দিনগুলাে মনে পড়ে। দুরন্ত এক ছেলেবেলা। শহরে বেড়ে ওঠা ছেলে-মেয়েরা হয়ত তা কল্পনা করতে পারবে না। জন্মের আগেই পরিবারের স্বাভাবিক স্রোতে ছন্দপতন ঘটে। এসব পাশে ঠেলে আমরা চলতে শিখি। মা হয়ে ওঠেন মহীরূহ। বাবা তাঁর অপত্য স্নেহ আমাদের বিলিয়ে যান। সব প্রতিকূলতা পাশে রেখে ছেলেবেলার সুন্দর স্মৃতিগুলাে মেলে ধরি। আমাদের আনন্দময় ও নির্মল কিছু সময়। সুখ, দুঃখ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার স্মৃতিগুলাে। প্রাচুর্য নেই, বৈভব নেই কিন্তু সামান্য আর ভালাে যা কিছু পেতাম তাতে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতাম। কত ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেল আমাদের সময়ে। স্মৃতি মানে ইতিহাস। আর সাথে আছে স্মৃতি বৈকল্য। সঠিক তথ্য তুলে ধরা কষ্টসাধ্য। আবার দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারটি আছে। আমি ইতিহাসকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারছি কিনা। মানুষের প্রবণতা হলাে যেটুকু তার পক্ষে যায় তাকে বাড়িয়ে বলা। নেতিবাচক দিক যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে চায়। সত্য বলার সাহস থাকা চাই। নিজেকে খুব বেশি উন্মুক্ত করতে পারিনি হয়ত কোথাও কোথাও। তারপরও যেটুকু দেখেছি বা বলেছি তার দায় আমার ওপর বর্তাবে। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য- এসবের কেন্দ্রবিন্দু রাজধানী ঢাকা। এজন্য এসব নিয়ে আমরা ভাবি। ঢাকা আমার জন্ম শহর। ঢাকার যেমন গৌরবময় ইতিহাস আছে তেমনি আছে বেদনার। কিংবদন্তির শহর ঢাকা। ঢাকার ইতিকথা খণ্ড খণ্ড গল্প নিয়ে বােনা। এর ইতিহাসের দৃশ্যমান অনেক স্থাপনা যেমন বিলুপ্ত হয়েছে। তেমনি কিছু সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্ম, অভ্যেস আমরা ঝেড়ে ফেলেছি। আধুনিক প্রযুক্তির যেমন বহু ইতিবাচক দিক আছে তেমনি এটি আমাদের সামাজিক সম্পর্কের অনেক রূপ, গাঁথুনি বদলে দিয়েছে। আমরা নিজেদের নিয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়ছি যে, সামাজিক বন্ধনগুলাে কেমন আলগা হয়ে পড়ছে। সমস্যাসংকুল নােংরা শহর বলে ঢাকার বদনাম আছে। হােক সে যতই জঞ্জালময় এ শহরে আমি বারবার ফিরে আসি। ঢাকার পরিচিত অলিগলিগুলাে কখনাে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসে। তার সুখ-দুঃখের কথা বলে। স্বার্থহীন মানুষগুলাে আরও আপন হয়ে ওঠে। আমার আবেগের বড় একটি জায়গা জুড়ে আছে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। হঠাই বড় হয়ে উঠলাম সেসময়। দেশ নিয়ে ভাবতে শুরু করি। স্বাধীনতার অর্থ খুঁজি। বুঝেছিলাম স্বাধীনতা মানে গর্বভরে মাথা উঁচু করে বাঁচা। নিজের দেখা তাে আছেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র, পত্রপত্রিকা আর নানা বইপত্র ঘাটতে যেয়ে তরুণ মুক্তিযােদ্ধা গেরিলাদের সাহস আর ত্যাগের গল্প জেনে আমি গৌরবান্বিত হই। যারা আয়েশ-আরাম ছেড়ে বনেজঙ্গলে, জলে-কাদায় যুদ্ধ করেছে। খাবারের নিশ্চয়তা নেই, শােবার জায়গা নেই- এসব নিয়ে কোনাে অভিযােগ নেই তাদের। তাদের পিছু পিছু মৃত্যু ঘােরে সূক্ষ্মসুতােয়। শুধু স্বাধীনতার জন্য সব ত্যাগ করেছে। বদ্ধভূমিতে প্রিয়জনদের বিকৃত লাশ খুঁজে পেয়ে নির্বাক হয়ে পড়ে এ দেশের মানুষ। হয়ত এভাবে তাদের না দেখতে পেলেই ভালাে হতাে। এদেশের নারীরা যারা পাকিস্তানি সৈন্যদের বিকৃত লালসার শিকার হয়েছেন তারা তাে প্রতিদিনই মরেছেন। সেই বীরাঙ্গনাদের কথা লিখতে যেয়ে থমকে গেছি বারবার। আহা! এই আমরা, আমাদের সমাজ তাদের উচ্ছিষ্ট জ্ঞানে ছুড়ে ফেলেছিল।
দীর্ঘসময় সরকারি চাকরি করে অবসর নিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এমএসএস ও অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে মাস্টার্স করেছেন। বর্তমানে তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন। ইয়াসমিন সুলতানা শখের বসে লেখেন। বই পড়া তাঁর নেশা। দেশ ভ্রমণ জীবনের অনুষঙ্গের মতো। তাঁর প্রকাশিত বই: পাহাড় নদী জনপদ (ভ্রমণ কাহিনি), নেপোলিয়নের শেষ দিনগুলো (ফিকশন উপন্যাস), গৌরবময় ইউরোপের খণ্ডচিত্র (ভ্রমণ কাহিনি), স্মৃতিকাহন (পটভূমি ১৯৪৭-১৯৭১) এবং অ্যান বোলেন: প্রেম ও ট্র্যাজেডি (ফিকশন উপন্যাস)।