আমরা যারা কবিতা পড়ি, কেন পড়ি? এর উত্তর পাঠক ভেদে বিভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। তবে কবিতা পড়া যে একটা নেশা তা সবাই একবাক্যে মেনে নেবে, কেননা কবিতা নিজেকে ভুলিয়ে দেয়। কবি তার শব্দের জালে বন্দি করে পাঠককে এক অলৌকিক জগতে নিয়ে যান। সেখানে হাসি কান্না, দুঃখ বেদনা, প্রেম বিরহ আর মুগ্ধতায় মোহাচ্ছন্ন করে দেন কবি। তেমন কবি এ সময়ে কয়জন? বদিউল আলম সময়ের একজন শক্তিমান কবি। তার শব্দ, বাক্য, উপমা, চিত্রকল্প কবিতার পাঠককে বিমোহিত করে। এক ধরনের শক্তির যোগান দেয় যা প্রাণের তৃষ্ণা মিটায়। বইমেলা ২০২১শে কবি পাঠকদের দরবারে হাজির হয়েছিলেন ‘শিশিরের ঠোঁটে বেদনার নীল’ নিয়ে। বইটির অন্য কবিতা পাঠের পূর্বেই বইটির নামই যেনো একটি কবিতা পাঠের তৃপ্তি দেয়। কল্পনার জায়গা করে দেয়। শিশির তার আবার ঠোঁট, তার আবার বেদনা, সেই বেদনার রং নীল! কি দারুণ অদ্ভুত অনুভূতির নাম এই কাব্যগ্রন্থটির। ‘আমার জমিনে এক যুগের যন্ত্রণা ক্লান্তিহীন অবসাদ অতৃপ্তির বিড়ম্বনা। আমি বিরান মাঠে মধ্যরাতে নিরাশ্রয়ী মানব দিকহীন অন্ধকারে নিমজ্জিত অচলা অর্ণব। ’ (অন্ধ জোনাকির মানচিত্র নেই, পৃষ্ঠা ২৫) ‘অচলা অর্ণব’ কি বিস্ময়কর ব্যঞ্জনা। কবি যেনো একজন বিজ্ঞানীর মতো নিজেকে আবিষ্কার করেছেন। আর সেই সাথে পাঠককেও সম্মুখীন করেছেন এক বিস্ময়ে। বর্তমানে অনেক ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা, যোজন বিয়োজন চলছে কবিতা নিয়ে। আধুনিকতার গণ্ডি পেরিয়ে উত্তর আধুনিকতার দৌড়ে কবিতা কি পরাজিত হয়ে যাচ্ছে? একজন কবি কি তত্ব, ফর্ম কিংবা বিনির্মাণ করতে গিয়ে তার কবিতাকে বিকলাঙ্গ করে দেবেন? আমরা শুধু কবিতা চাই, যে কবিতা আমাদের পিপাসা মেটাবে। আমাদের আবেগ, আত্মউন্মোচন করবেন। কবি বদিউর আলম তার কাব্যগ্রন্থের আয়োজনে পাঠককে প্রধান্য বেশি দিয়েছেন। সবার জন্য কবিতা নয়, তবু তিনি সবার জন্য কবিতা লেখার প্রচেষ্টা করেছেন এ গ্রন্থে। ‘আমি নিঃশব্দ আড়াল চাই সভ্য শহরের শব্দের নির্যাতন থেকে দূরে বন্দিত্ব চাই কালো গুহার গভীরে আঁকাবাঁকা অন্ধকার গ্রাস করে ঢেকে দেই নিজের শরীর, একাকার আলোহীন। ’ (নৈঃশব্দ্যের আড়াল চাই, পৃষ্ঠা ৩৯) সম সাময়িক নানা বিষয়কে নিয়ে কবি কবিতা লিখেছেন। ৮০ পৃষ্ঠার বইটিতে ৭১ টি কবিতা সূচিবদ্ধ হয়েছে। এ কোন শহর করোনার লাশঘর, বেদনার ভাষা ঠক ঠক ঠক ঠক, ভিঞ্চি উঠে এসো কবিতাগুলো খুবই মনোমুগ্ধকর। প্রেম, প্রকৃতি, নারী, স্বদেশ, নদী, মাটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে কবির কবিতায়।
বদিউল আলম। কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। তিনি ১৯৫৬ সালের ৫ মে, চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলায় খাজুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মরহুম হাজী সেকান্দর আলী মিয়া। মা মোসাম্মৎ ফাতেমা বেগম। কবি বদিউল আলম চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় হতে স্নাতক (সম্মান) ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৮২ সালের বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে যোগদান করেন। মাঠপর্যায়ে কর্মরত থাকাকালে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন। সরকারের যুগ্মসচিব পদ থেকে তিনি অবসরে এসে সাহিত্যাঙ্গণে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। নিসর্গপ্রেম, বিরহ, বেদনা, বাস্তবতা, সামাজিক, মনস্তাত্তি¡ক ও মানবিক বিষয়গুলো কবির কবিতায় নান্দনিক এবং সাবলীলভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি একই সঙ্গে কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ জুলুভাই (২০১৯) ও উপন্যাস- ফারু (২০১৯) শাহেদ (২০২০) শেষ উপহার (২০২০) কবরী (২০১২১) দেশে ও বিদেশে বাঙালি পাঠকদের ভূঁয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং আলোচিত ও সমাদৃত হয়েছে। তাঁর কাব্যগ্রন্থ- বলাকার দেশে (২০১৮), কে তুমি তন্দ্রাহরণী (২০১৮), সূর্যাস্তের সাথেই যাব (২০১৯), গোলাপ ছুঁয়েছি নিমগ্ন আবেগে (২০১৯) কবি মহলে ও কবিতাপ্রেমিদের মধ্যে ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছে। ‘শিশিরের ঠোঁটে বেদনার নীল’ তাঁর পঞ্চম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থে তাঁকে পাওয়া যাবে আরও পরিণত ও কাব্যদৃষ্টি সম্পন্ন একজন পরিপূর্ণ কবি রূপে।