মফস্সল শহরে থাকার সুবাদে, শৈশবেই পরিচিত হয়েছিলাম পথ-কবিতার সঙ্গে। সুর করে একজন কাহিনি বলে যাচ্ছেন আর তাঁকে ঘিরে রেখে শুনছেন অনেকে। সেই অনেকের দলে অনেকবার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তারপর পড়াশোনার প্রয়োজনে ঢাকায় আসা। দু-তিনবার দেখা হয়েছে ঢাকায়ও, সেই চেনা পুস্তিকা কিন্তু তা বিক্রি হচ্ছে অন্যভাবে—বাসের ভেতর, তাড়াহুড়ায় কিছু চটকদার মন্তব্যের মাধ্যমে। তারপর দীর্ঘ বিরতি। শিক্ষকতা পেশায় এসে পড়তে, পড়াতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম—শৈশবে শোনা সেই কবিতার ঠাঁই হয়নি বাংলাদেশের কবিতা-চত্বরে। কেন? নির্মম এই প্রশ্নের উত্তর আরো বেশি নির্মম ও মর্মন্তুদ। ঔপনিবেশিক শিল্পদর্শন আর ক্ষমতায়নের রাজনীতি এসব কবি ও কবিতাকে নিক্ষেপ করেছে বহুদূরে, উপেক্ষিত প্রান্তে। এই বর্জন ও উপেক্ষার অবহেলা নিয়ে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে পথ-কবিতা—যা বাংলার মধ্যযুগের কাব্যাদর্শকে নানা বিবর্তনের ভেতর দিয়ে জিইয়ে রেখেছিল, গ্রাম-গঞ্জের ‘নিরক্ষর’ মানুষের সাহিত্য-ভোগের উপাদান ছিল। ফলে, হারিয়ে যেতে বসা আমাদের নিজস্ব এই কাব্যপ্রকরণটির সংগ্রহ ও জনসমক্ষে তুলে আনার প্রয়োজন অনুভব করি। সেই পরিকল্পনা থেকেই এই গবেষণার উদ্যোগ। আমার গবেষণা-প্রস্তাবটি অনুমোদন করা এবং এর প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ প্রকাশ করছি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। অজ্ঞাতনামা শ্রদ্ধেয় দুজন রিভিউয়্যার এই গবেষণাকর্মের গুরুত্ব সম্পর্কে যে উৎসাহী মতামত ও সুবিজ্ঞ পরামর্শ দিয়েছেন, তা আমার গবেষণায় প্রেরণা সঞ্চার করেছে। শ্রদ্ধেয় রিভিউয়্যারদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। পথ-কবিতা সংগ্রহ করতে গিয়ে সম্মুখীন হই এক হতাশাজনক পরিস্থিতির। আমার গবেষণা-সহযোগীকে নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরেছি এই কবিতার সন্ধানে, কিন্তু আশানুরূপ সংগ্রহ মেলেনি। প্রাতিষ্ঠানিক লাইব্রেরিগুলোরও একই অবস্থা। এমনকি বংলা একাডেমির ফোকলোর সংগ্রহশালায়ও পথ-কবিতার সংগ্রহ নেই বললেই চলে। এরপর, এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত সারা দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র ও লাইব্রেরিগুলোর ঠিকানায় (প্রায় দুইশো) চিঠি পাঠাই। ১০/১২টি স্থান থেকে ফোনে সাড়া পেলাম, কিন্তু কোনো পথ-কবিতা মিলল না। এরকম নৈরাশ্যকর অবস্থায় হঠাৎ একদিন ফোনে পেয়ে যাই কবি জালাল খান ইউসুফীকে। তাঁর বাবাও পথ-কবিতার স্বনামধন্য কবি—ইউসুফ খান। অত্যন্ত উৎসাহ ও আন্তরিকতার সঙ্গে জালাল খান ইউসুফী তাঁর ও তাঁর বাবার সংগ্রহ উজাড় করে দিলেন আমাকে। তিনশোর অধিক পথ-কবিতা আমি তাঁর মাধ্যমে পাই। বলা বাহুল্য, জালাল খান ইউসুফীর সহযোগিতা ব্যতীত এই গবেষণা কখনোই আলোর মুখ দেখতে পেত না। তাঁর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ও অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। পথ-কবিতা সংগ্রহে আরো যাঁদের সহযোগিতা পেয়েছি, তারা হলেন—পুথিশিল্পী কাব্য কামরুল, কবি ইলিয়াস ফকির, কবি রাসেল মাহমুদ, সৃজনী রেলওয়ে বুক স্টলের মালিক বরুণদা ও আলোকচিত্রী মঈন খুরশীদ। এঁদের সবার প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। গবেষণা-কর্মটি সম্পন্ন করতে গিয়ে নানাভাবে বঞ্চিত করেছি আমার তিন বছরে কন্যা শ্রেয়সী অতন্দ্রিলা ও স্ত্রী খাদিজা পারভীন পপিকে। তাদের এই ত্যাগ-স্বীকার ও সহযোগিতার জন্য জানাই অফুরন্ত ভালবাসা।