রবীন্দ্রনাথের পাকা উপন্যাসগুলির সবই বেরিয়েছে ১৯০৩ থেকে ১৯৩৪-এর মধ্যে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলির প্রকাশকাল ১৯১৩ থেকে ১৯৩৮। শরৎচন্দ্র শুরু করার আগে রবীন্দ্রনাথের 'গোরা' পর্যন্ত বই সমাজে সুপরিচিত। কাজেই শরৎচন্দ্রের উপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থাকাটা কিছু অসম্ভব ছিল না। বিশেষ করে রবীন্দ্র-গল্পের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য এর মধ্যে ছাপা হয়ে গিয়েছে। উপন্যাস আর গল্প যতই পৃথক শিল্পবস্তু হোক, রবীন্দ্র-গল্পের, বিশেষ করে গল্পগুচ্ছর বাস্তবতা কোন উপন্যাসকারকেও অবশ্যই প্রভাবিত করতে পারে, এবং বেশ সরাসরিই সে প্রভাব কার্যকর হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। তবুও রবীন্দ্রনাথের দ্বারা শরৎচন্দ্র তেমন গভীরভাবে প্রভাবিত নন। শরৎ যখন কাঁচা ছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ধরাছোঁওয়ার বাইরে ছিলেন, আর শরৎ যখন পাকা লেখক তখন তিনি স্বতন্ত্র মেজাজের ও রুচির, তাঁর নিজের পথ নিশ্চিত হয়ে গেছে; তিনি একটা রবীন্দ্র-সমান্তরাল প্রভাব-পরিমণ্ডল তৈরি করে ফেলেছেন। প্রায় সমবয়সীরা কিংবা অল্প অনুজরাও তাঁকে আর এড়াতে পারেন না। তবুও শরৎচন্দ্রের ভিতরে রবীন্দ্র কাজ করেছেন। বাঁকা পথে হলেও সে প্রভাব এড়ানো তাঁর বা কারুর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে তার স্বরূপটা চিনে নিতে হবে বাঁধা রীতির বাইরে গিয়ে। এরকম একটা অবস্থায়, সমকালে এবং কিছুটা পরেও বাংলা উপন্যাসের জগৎটা রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্র এই দুই লেখকের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল। দুজনের মানের মধ্যে পার্থক্য যদি থাকেও এবং তার স্বরূপ যাই হোক না, ইতিহাসটা এই ভাবেই চলেছে।