জাপানী ধারার কবিতা “তানকা”-প্রসঙ্গ কথন : পৃথিবীর নানা দেশে ভিন্নতর ব্যাঞ্জণাময় কাব্যধারার প্রচলন রয়েছে। নিজ দেশে ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তার পাশাপাশি কিছু কাব্যধারা/প্রকরণ ভূগোল/ভাষার দেয়াল অতিক্রম করেও ভিন্নতর দেশে/ভাষাভাষী অঞ্চলে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। কোনো কোনোটি ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। সনেট এখন বিশ্বপরিসরে প্রায় সব ভাষাতেই অনুশীলিত। আরব পারস্যের রুবাইয়াৎ এখন ব্যাপক জন-আদৃত। লিমেরিক’র চর্চা হচ্ছে প্রায় সব ভাষাতেই। এমনিভাবে বিস্তৃত হয়েছে জাপানের তানকা আর হাইকু। অনু পরিসরের ১৭ মাত্রার হাইকু ব্যাপকভাবে চর্চিত। বাংলাভাষাতেও বরেণ্য কবিবৃন্দের পাশাপাশি নবীনতর কবিদের মাঝেও হাইকু সমানভাবে আদরণীয়। একইভাবে “তানকা” নামক ছোট পরিসরের কবিতার পরিচিতি ও চর্চাও ক্রমবর্ধমান। সভ্যতা ও বিজ্ঞানের অগ্রায়নের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে পরিব্যাপ্ত হচ্ছে মানুষের মানবীয় অনুভব, আবেগজাত সৃজনকর্মও। সমকালে তাই সকল ভাষার সাম্প্রতিকতম সাহিত্য-সৃজনও দ্রুততমতায় ছড়িয়ে যাচ্ছে গোলার্ধে গোলার্ধে। সঙ্গত কারণেই সকল ভাষার সাহিত্য সৃজনের বিস্তৃততর ধারাসমূহের সাথে পরিচিতির সুযোগও অবারিত হয়ে যাচ্ছে। আগ্রহী লেখক/কবি/সৃজনকর্মীরা ভিন্নতর ভাষা/সংস্কৃতির পরিমন্ডল থেকে আহরণ করছেন পছন্দনীয় অমৃত সুধা, নিজ পরিমন্ডল পারিপার্শ্বিকের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করছেন, কখনো আদিরূপ সম্পূর্ণ অক্ষুন্ন রেখে, কখনো দেশীয় পারিপার্শিক-সংস্কৃতি-ভাষার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে। বিশ্বায়নের এই কালে অবার প্রবহমানতার ছন্দযাত্রা অপ্রতিহত, অনিবার্য। আর আত্মীকরণে, আত্মস্থকরণে নিজ ভাষার দৈন্য নয়, সমৃদ্ধিই পরিস্ফুটিত হয়। ভিন ভাষা, পরিবেশ, দেশ থেকে আগত এইসব সাহিত্য-সংস্কৃত-ভাবনা-প্রকাশ নিজ ভাষার ঋদ্ধতর বিকাশে সহায়ক হবেই, এটাই প্রত্যাশিত। আর চলমানতার স্রোতে কিঞ্চিৎ পরিমার্জনা/পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে অস্বীকার না করেও বলা যায়, উদারতায় স্বাগত জানিয়ে, নিজ আত্মস্থকরণ সক্ষমতার উপর আস্থা রাখাই সঙ্গত। জাপানী ভাষায় জাপানী কবিতাধারা : বাংলাভাষায় জাপানী ধারাসমূহে কবিতা রচনা প্রয়াস নতুন নয়। স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছেন। পরপ্রজন্মের কবিদের অনেকেই লিখেছেন। সাম্প্রতিকতম কবিদেরও অনেকেই কমবেশি অনুশীলন করছেন। বাংলাদেশে নবীনতম কবিদের মাঝেও হাইকু ও তানকা রচনায় আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। তানকা : প্রসঙ্গ কথা : কিঞ্চিৎ পরিচিত হওয়া যায় “তানকা”র সাথে। তানকা জাপানী কবিতা। অবয়বে ছোট। অল্পকথায় ব্যাপকতর, গভীরতর ভাবের প্রকাশ। তানকা’তে চরণ থাকে ৫টি। প্রতি চরণে অক্ষর বা সিলেবল বা দল সংখ্যা যথাক্রমে– ৫ ৭ ৫ ৭ ৭ তানকা কবিতায় ৫টি চরণে অক্ষর বা সিলেবল সংখ্যা সর্বমোট ৩১টি। পক্ষান্তরে হাইকু ধারার কবিতায় তিনটি চরণের বিন্যাস যথাক্রমে– ৫ ৭ ৫, সর্বমোট অক্ষর সংখ্যা ১৭টি। তানকা লেখা যেতে পারে বর্ণবিন্যাস বা ধ্বনিবিন্যাস-উভয়ভাবেই। আমাদের দেশে কেউ কেউ তানকা লিখছেন বর্ণবিন্যাসে। তবে এটি তুল্যতায় কঠিনতর। অক্ষর গণণা, তাল, ভাব মিলানো কিছুটা দুরুহই। পক্ষান্তরে অনেকেই অনুশীলন করছেন ধ্বনিবিন্যাসে। জাপানে তানকা নির্মিত হয় মূলত গীতিকাব্য হিসেবে। সেই বিচারে ধ্বনিবিন্যাসই শ্রেয়তর বিবেচিত হতে পারে। তবে কবি কিভাবে উপস্থাপন করবেন এটি তার নিজস্ব স্বাধীনতা, শৈলি বিষয়ও একান্তই নিজের। এদেশে অনেকেই বর্ণবিন্যাসে লিখছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি বর্ণবিন্যাসে প্রাধান্য দিলেও ধ্বনিবিন্যাস, বর্ণবিন্যাস কোনটিকেই নিরুৎসাহিত করায় সহমত নই। বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে জাপানের তানকা আর হাইকু। অনু পরিসরের ১৭ মাত্রার হাইকু ব্যাপকভাবে চর্চিত। বাংলাভাষাতেও বরেণ্য কবিবৃন্দের পাশাপাশি নবীনতর কবিদের মাঝেও হাইকু সমানভাবে আদরণীয়। একইভাবে “তানকা” নামক ছোট পরিসরের কবিতার পরিচিতি ও চর্চাও ক্রমবর্ধমান। তানকা’র বিষয়বসস্তু : অন্য প্রায় সব কবিতাধারার মতোই তানকা কবিতাও জীবন অন্বিষ্ট। মূল আদি জাপানী তানকা’র বিষয়বস্তু থেকে ক্রম উত্তরণে তানকা এখন অধিকতর জীবন-সম্পৃক্ত, মানব অন্বিষ্ট। যাপিত জীবনের সকল বিষয়াবলীই উপস্থাপিত হতে পারে তানকা কাঠামোয়। মানবীয় আবেগ, অনুভব, সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, আনন্দ যন্ত্রণা, আশা আশাভঙ্গ উঠে আসতে পারে তানকায়। চিত্রিত হতে পারে প্রকৃতি, ঋতু, সৌন্দর্য। উঠে আসতে পারে দ্রোহ, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, জাগ্রত চৈতন্যের স্ফূরণ। সুজীবনের প্রত্যাশা, আকাঙ্খা, স্বপ্ন, মঙ্গলময়তার দিক নির্দেশনা, পথ প্রদর্শন, নৈতিক স্খলন, অধঃপতন, এর থেকে উত্তরণের উপায় সবই চিত্রিত হতে পারে। ব্যাপকার্থে মানবীয়, জৈবনিক সু কু বিস্তীর্ণ পটভূমির সব বিষয়ই এখন তানকায় উপস্থাপন সম্ভব এবং তার প্রয়াসও চলমান। তবে জাপানী তানকায় সাধারণভাবে প্রাধান্য পায়- প্রকৃতির অবারিত সৌন্দর্য, নান্দনিক রূপ, ঋতু বৈচিত্র, জীবনের বিবিধ বিভাময়তা, মানবীয় অনুভবের গভীরতা, প্রেম, বিরহ, কারুণ্য ইত্যাকার মানবীয় বিষয়াবলীকে। সাধারণভাবে জাপানী তানকা প্রকরণে প্রথম ৫ ৭ ৫ এ বিষয়বস্তু উপস্থাপিত হয়। জাপানী ভাষায় একে বলা হয় “কামি নো কু” বা আপার ফ্রেজ(বিষয়বস্তু); শেষের ৭ ৭ কে জাপানে বলা হয় “শিমো নো কু” বা লোয়ার ফ্রেজ (সারমর্ম)। সাধারণভাবে প্রথম তিন চরণ বা লাইনে উপস্থাপিত হয় বিষয়বস্তু আর শেষ দুই চরণ বা লাইনে প্রকাশিত হয় মূল বক্তব্য/ধারণা/ সারমর্ম/ উপসংহার। বিগত কয়েক বছরে আমি প্রচুর সংখ্যক তানকা রচনা করেছি। আমি “তানকা” র শিরোনাম ব্যবহার করেছি। “স্বনির্বাচিত তানকা” গ্রন্থটি পাঠক প্রিয়তা পাবে এই প্রত্যাশা রইলো। ড. সাঈফ ফাতেউর রহমান