১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল সদস্য সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত করে। এ অভ্যুত্থানের ফলে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমÐি ৩২-এর বাসভবনে হত্যা করে। এ র্নিমম ও পৈচাশিক হত্যাকাণ্ডেরর স্বীকার হন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজি কামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাব ইন্সপেক্টর ছিদ্দিকুর রহমান, পেট্রোল ডিউটির সৈনিক সামছুল হক ও রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল। দেশের বাইরে থাকায় সেদিন প্রাণে বেঁচে যান জাতির পিতার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। সে বছরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির রিসিপসনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম ধানমণ্ডি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদ অঘোষিতভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদে ছিলেন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ খুনিদের রক্ষায় ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। এরপর ১৯৭৯ সালে যাকে আইনে পরিণত করেন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’ বাতিল করে হত্যাকাণ্ডটির বিচারের পথ সুগম করে। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে প্রথমবারের মতো সামরিক ক্ষমতার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ঘটে। হত্যাকাÐটি বাংলাদেশের আদর্শিক পটপরিবর্তন বলে বিবেচিত। বর্তমানে ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের ‘জাতীয় শোক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এ ঐতিহাসিক ও হৃদয়বিদায়ক ঘটনাকে নানাভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে লেখা হচ্ছে বই। কেউ কেউ খুনিদের আড়াল করতেও তাদের স্বপক্ষে লিখছেন ও নানা যুক্তি তর্কের অবতারণা ঘটাচ্ছেন। বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক ডিআইজি কাজী জয়নুল আবেদীন বীরপ্রতীক এমন প্রেক্ষাপটে তার অভিজ্ঞতার আলোকে লিখেছেন- ‘জাতির পিতা হত্যাকাণ্ড, কার কী ভূমিকা ছিল : পূর্বাপর ইতিহাস’ শিরোনামের বইটি। ৪৩২ পৃষ্ঠার বইটির শুরুতে রয়েছে একটি তথ্যসমৃদ্ধ উপক্রমণিকা এবং শেষে রয়েছে নির্দেশনামূলক একটি উপসংহার। এছাড়াও অন্যান্য তথ্যবহুল প্রবন্ধগুলোর শিরোনামগুলো হল: শেখ মুজিব যেভাবে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা হলেন, ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক, মুক্ত স্বদেশ, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, পাকিস্তানি দালালদের বিচার, বামপন্থীদের ভূমিকা, স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগের ভূমিকা, সেনা অফিসারদের ভূমিকা, পাকিস্তানপ্রীতি, বেসামরিক প্রশাসনের ভূমিকা, মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণযুদ্ধ, রক্ষীবাহিনী গঠন, বাকশাল গঠনের প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐ, ক্ষমতার পালাবদল, জিয়া যেভাবে মেজর থেকে প্রেসিডেন্ট হলেন, ‘তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’, জেনারেল এইচ এম এরশাদের ক্ষমতা দখল, শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চুক্তি, বাংলাদেশের সমুদ্র জয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বিডিআর বিদ্রোহের বিচার। বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মানে বঙ্গবন্ধু এ কথা আজ সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত। নানা ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচারের মধ্য দিয়ে যে ইতিহাস রচিত হচ্ছে তার বিরুদ্ধে সমুচিত জবাব এই বইটি।
কাজী জয়নুল আবেদীন বীরপ্রতীক নোয়াখালী জেলার সেনবাগ থানার অন্তর্গত দেবীসিংপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি বনানী ডিওএইচএসের ৩২/২ জারাসা-এর স্থায়ী বাসিন্দা। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি বীরপ্রতীক খেতাবে ভ‚ষিত হন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিসিএস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরিকালীন তিনি আইএমএস অফিসারদের জন্য নির্ধারিত ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিএমডিসিতে (বিআইএম) এক বছর এবং একই বিষয়ে পূর্ব জার্মানিতে ‘একাডেমি ফর সোশ্যালিস্ট ম্যানেজমেন্ট’ থেকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি আইএমএস অফিসার হিসেবে বিভিন্ন সেক্টর করপোরেশন ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ১৯৮২ সালে সরকার আইএমএস ক্যাডার বিলুপ্ত করে ক্যাডার অফিসারদের বিভিন্ন চাকরিতে আত্তীকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন তিনি পুলিশ বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি সারদা পুলিশ একাডেমিতে সহকারী পুলিশ সুপারদের জন্য নির্ধারিত এক বছর আইন ও অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পুলিশ বিভাগে চাকরি করাকালীন তিনি মালয়েশিয়াতে সিনিয়র কমান্ড কোর্স ও দেশে পুলিশ স্টাফ কলেজের উচ্চতর ব্যবস্থাপনা ও মানবাধিকার বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি ডিআইজি হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। লেখক মুক্তিসংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছেন এবং বিভিন্ন পর্যায়ে তার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।‘মুক্তিযুদ্ধের কথা’ শিরোনামে তিনি একটি নিবন্ধ রচনা করেছেন। যা মোহাম্মদ সাদাত আলী সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধ ৭১-বাঙালির নতুন ইতিহাস’ বইয়ে সংকলিত হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে তার অনেক নিবন্ধ বিভিন্ন সাময়িক ও দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।