‘একাদশদিকে ফেরা’ কবি রেজা রহমানের ৫ম বই হলেও বাজারে প্রচলিত একমাত্র বই। এর আগে প্রকাশিত ৪টি বই প্রকাশনার নানা ক্রটির কারণে তিনি ঘরে কোয়ারেনটাইন করে রেখেছেন। একাদশদিকে ফেরা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরিটাস অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার বলেছেন- রেজা রহমান যে কবিতা লেখেন সেটা জানা ছিল, কিন্তু এতটা মমতা ও অভিনিবেশের সঙ্গে যে লেখেন সেটা জানলাম ‘একাদশদিকে ফেরা’র কবিতাগুলো পড়ে। দেখলাম কেমন যতেœ তিনি ১৯৬৭-এ লেখা কবিতা ২০১৭’তে পরিমার্জিত করেছেন। বোঝা গেল ভেতরের কবিটি কখনোই অবসরে যান নি। কবিতা এখন অনেক পাই, কিন্তু যথার্থ কবিতার সংখ্যা কম। রেজার রচনাগুলো যথার্থ কবিতা এবং এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য মৌলিকত্ব। মৌলিক কথাটি তাঁর কবিতার ভেতরেও আছে, এবং সমস্ত সংগ্রহটি জুড়ে রয়েছে কবির মৌলিকতার সুসংবাদ। অধিকাংশ কবিতাই প্রেমের। প্রেম বিশেষ ধরনের একটি সম্পর্ক; এবং অন্য কবিতাগুলোতেও সম্পর্কের বিষয়টি এসেছে। সম্পর্ক জিনিসটা অত্যন্ত প্রাচীন, কিন্তু রেজা রহমানের ক্ষেত্রে তা নতুন হয়ে উঠেছে। এর মূল কারণ তাঁর নিজস্বতা। আরেকটা কারণ তিনি একালের মানুষ, যে-কাল জ্ঞানে-বিজ্ঞানে অর্থনীতিতে অত্যন্ত অগ্রসর। উন্নতির এই যুগে মানবিক সম্পর্কগুলো স্থাপন ও সংরক্ষণ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে দ্ব›দ্ব ও সংশয়। মানুষ এখন অনেক অধিক আত্মকেন্দ্রিক। তবে প্রত্যেক যুগেই তো এটা সত্য যে মানুষ মাত্রেই মৌলিক; একজন আরেকজনের মতো নয়। রেজার কবিতায় বক্তার পরিচয় দিতে বৃক্ষের উল্লেখ আছে; প্রত্যেকটি বৃক্ষই স্বতন্ত্র, কিন্তু তিনি এও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে মানববৃক্ষরা আত্মসচেতনও। মর্মস্পর্শী ভাবেই বলেছেন, “চেনে না জানে না কেউ কাউকে মরণ অবধি”; কারণ “দু’জনেই মৌলিক আর দু’জনেই যে একা/ কী করে সম্ভব একে অপরের ভেতরটা দেখা।” তাই দেখা যায় “একে অপরকে বিছানাতে খোঁজে/ প্রায়শ বোঝে না যদি বোঝে ভুল বোঝে।” আর নিজের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই এই অভিজ্ঞানে তিনি পৌঁছেছেন যে মিলনকেই যদি সঠিক ভাবা হয় তবে সেটা হবে ভুল : “ইতিহাস আমি যদি বুঝে থাকি ঠিক/ বলবই চিরকাল বিচ্ছেদই মৌলিক।” কিন্তু এই সংকলনের কবিতাগুলো আরও গভীর এক দুঃসংবাদ দিচ্ছে, যেটি বিচ্ছেদের চেয়েও প্রাথমিক; সেটি হলো বিচ্ছিন্নতা। বিচ্ছেদ তো ধরে নেয় যে যোগটা ঘটেছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যুক্তই হওয়া যাচ্ছে না। আকুতি আছে, মিলন নেই। কারণ ইতিহাসের যে স্তরে আমাদের বসবাস সেখানে সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশেষ করে অর্থনীতি মানুষকে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করছে, এমনকি ব্যক্তির ভেতরও দেখা দিয়েছে আত্মবিচ্ছিন্নতা। এটি পুঁজিবাদের অভিশাপ। রেজা লিখেছেন, “এ রাষ্ট্র তোমার তুমি নার্সিসিস্ট তোমার তো নয়/ তোমারই থাকুক ঘৃণ্য আত্মপ্রেম করোনার ভয়।” করোনা একালে ব্যাধি। এই ব্যাধির প্রথম ঘোষণাটিই হচ্ছে বাঁচতে হলে অন্য সবার কাছ থেকে দূরে থাকো, মানুষকে জানো তোমার শত্রæ হিসেবে, প্রবেশ করো তুমি তোমার আদিম গুহাতে।