"গুহা" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা গল্প-উপন্যাসের মধ্যে গুহা অন্যতম প্রধান একটি রচনা। সিরাজুল ইসলাম স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের একজন উল্লেখযােগ্য লেখক। লেখকের ভাষা-চিন্তা-মনন পূর্ণমাত্রায় নাগরিক, প্রায় অর্ধশতাব্দী সাহিত্যচর্চার ফসল গুহা পড়তে পড়তে মনে হয়, এখন এই পরিণত বয়সে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক ধরনের লুকোনাে বিদ্যুৎ। গুহাকে শুধু মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলে দাগিয়ে দিলে অবিচার করা হবে, সময়টা ১৯৭১; কিন্তু গল্পটা ঢাকা শহরের প্রান্তিক মানুষের। উপন্যাসের মূল চরিত্র মশিউল এবং তার বাবার নাম ফকির চান, পেশায় কাঠমিস্ত্রি। পড়াশােনায় ভালাে বলে সে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযােগ পায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পাকিস্তানি মিলিটারির নৃশংস হত্যাকাণ্ড, অত্যাচার, আতঙ্ক, মিলিটারি জিপ থেকে রাস্তার দুধারে গুলি করতে করতে যাওয়া, লাশের পাহাড়-সবই এ উপন্যাসে আছে। তবে কোনাে কিছুই উচ্চকিত নয়, ধমনির ভেতর দিয়ে রক্ত চলাচলের মতাে নিঃশব্দ। ফকির চানের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডও বর্ণিত হয়েছে অসম্ভব এক নির্লিপ্ত ভাষায়। আর আছে মানুষের আবহমান স্বপ্ন-মিনিকে নিয়ে মশিউলের অসম্ভব এক স্বপ্ন। এ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ আছে, কিন্তু স্পষ্ট কোনাে রণক্ষেত্র নেই। এ যেন মানুষের স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের চিরন্তন এক কাহিনি, মুক্তিযুদ্ধের আড়ালে অন্য এক অন্তহীন মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান এবং অন্তিমে অনিবার্য এক মৃত্যু, ১৯৭১-এর ত্রিশ লাখ মৃত্যুর এক মৃত্যু।
সিরাজুল ইসলাম জন্ম ১৪ জুন ১৯৫১ সালে নারিন্দা, ঢাকায়। ষাটের ঢাকা এবং উৎকণ্ঠিত এক জায়মান সমাজবীক্ষা এই লেখকের ধমনিতে হয়তাে নিজের অজান্তেই জন্ম দিয়েছিল ভিন্ন এক শিল্পচেতনা, যা তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলাে বহন করে চলেছে! লেখালেখিসহ সামাজিক বিভিন্ন পরীক্ষাপ্রবণ সময়ে সিরাজুল ইসলাম উপন্যাস লেখেন প্রথাবদ্ধ নিয়মে, কথাসাহিত্যের ঐতিহ্য মেনে। কিন্তু নিয়ম মানাও যে নতুন নিয়ম গড়ার আঁতুড়ঘর হতে পারে, সিরাজুল ইসলামের লেখা তা পাঠককে অতি মৃদুকণ্ঠে নিয়ত জানিয়ে দেয়! পলাতকা, অশেষ, সিংহাসন, সােনার আলােয়, পাথরগুলাে, ছত্রাক, কুশীলব, হৃদয়, প্রিয়তম, টাপুর টুপুর লেখকের প্রকাশিত অন্যান্য উপন্যাস। সিরাজুল ইসলামের প্রায় সব গল্প বা উপন্যাসের বেশিরভাগ উপাদান শহরজীবনের বেদনাক্রান্ত জটিল; কিন্তু অতি সূক্ষ্ম মানবিক ক্ষরণের কথা। সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রায়ই শিল্পমূর্তি ধারণ করে সেই অন্তর্গত দ্বন্দ্বদীর্ণ ও রক্তিম ক্ষরণগুলাে! প্রায় প্রতিটি লেখাই নিজের অভিজ্ঞতা-সংহত; কিন্তু মধ্যবিত্ত মূল্যবােধ দ্বারা জারিত, কখনাে কখনাে একটু বিস্ফোরণের আভায় জড়ানােও। মধ্যবিত্ত বাঙালির গণ্ডির ভেতর ও বাইরের ক্ষীণ সীমারেখায় দাঁড়িয়ে মানব-মানবীর মনােজগতের অজানা প্রদেশের নিত্য খোঁড়াখুঁড়ি সিরাজের বিরামহীন এক প্রয়াস! পরিবেশের কুৎসিত বীভৎসতা বা ইতরতার মধ্যেও সিরাজের অন্বেষণ ও অন্বিষ্ট মানবিক হৃদয়ের ছবি আঁকা! সিরাজের গল্প বা উপন্যাস ভাবালুতাবর্জিত; কিন্তু ভাবনা উদ্রেককারী । মানবের অদম্য প্রাণশক্তির জয়ই সকল বেদনা বা সংগ্রামের মধ্যে বিভিন্ন শব্দের জাদুতে আঁকেন তিনি।