খুব বেদনার্ত অবস্থায় আমি বইয়ের মুখবন্ধ লেখা শুরু করেছি। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলে রাখি, আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ বোধটা সম্ভবত তখন হয়েছিলো যখন আমি ভেবেছিলাম, যেকোনো লেখকের প্রথম কাজ হচ্ছে- অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া। আমার কাছে অনুভূতিতে আঘাত মানে হচ্ছে- প্রিয় লেখকদের গল্প, উপন্যাস, কবিতা বা নিতান্তই প্রবন্ধ পড়ে মনের মধ্যে যে আবেগ গজায় সেটি। বাংলাদেশে অনুভূতির ব্যাপারে আইন আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে- কোনো লেখক হাতে করে স্কেল নিয়ে ঘোরেন না কে কোন লেখায় কতটুকু আঘাত পাবে। কতটুকু অনুভূতিতে আঘাত আইনের চোখে সহীহ্? আমি প্রায় নিশ্চিত আমার প্রিয় লেখক সাদাত হাসান মান্টো বা আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে যদি জিজ্ঞেস করা হতো- আপনি কেন লেখেন? ওঁরা হয়তো বলতেন- অনুভূতিতে আঘাত দিতে। পুরো ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাস আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছিলাম না। বাংলাদেশের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে একজন ফেসবুক মেসেঞ্জারে টোকা দিয়ে বললো- আপনি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে কেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম- কী হবে থেকে? সে সরল উত্তর দিলো- লিখবেন! আমি উত্তর দিলাম- বাংলাদেশে বসে আমি লিখতে ভয় পাই, আরও ভয় পাই সেই ভয় পাওয়ার কথাটা বলতে। তবে আয়রনি হলো- যেহেতু ভয় পাই সেহেতুই লিখি, ভয়সমূহ সত্য হওয়ার শঙ্কা না থাকলে লেখার আগ্রহও হয়তো পেতাম না! বাংলাদেশে যে কয়জন মানুষের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা আছে, আমি তাদের একজন। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস মানে হচ্ছে সেদিন থেকে আসন্ন আদালতে দাঁড়িয়ে থাকার দিনের জন্য প্রহর গোনা, বিজয় দিবস মানে নতমুখে আদালতে হাজিরা দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া। মানুষ লাল-সবুজ জামাকাপড় পরে বিজয় দিবসে আনন্দ করার প্রস্তুতি নেয়, আমি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকার প্রস্ততি নেই আর ভাবি- ঠিক কতগুলি দিন গেলে আমরা মত প্রকাশে ভীত হবোনা কিংবা নিশ্চিত হবো- মত প্রকাশের জন্য কখনো কাউকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবেনা? এমনকি এই লেখাটা আমি যখন লিখছি, তখনই জানলাম মত প্রকাশের স্বাধীনতা চাইতেন এমন একজন- মুশতাক আহমেদ, আটক অবস্থায় জেলেই মারা গিয়েছেন। কার্টুনিস্ট কিশোর কার্টুন আঁকার দায়ে এখনো জেলে। মুশতাক আহমেদ সেই কার্টুন ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করায় জেলে গিয়েছিলেন। আসলে এই কারণেই লেখার শুরু থেকেই আমি এতো বেশি বেদনার্ত যে আমার লেখা থামিয়ে কান্না আসছে। এমনকি কোন মন্ত্রের গুণে লিখছি, তা আমার কাছেও পরিষ্কার না! যাই হোক- এই বইয়ের নাম ‘পাপ বিষয়ক পাপেট শো’ হওয়ার কারণ কী? মূলত জীবনের পঁচিশতম বছরে এসে আমার বারবার নিজেকে পাপেট শো বা পুতুলনাচের পুতুল মনে হয়েছে নানান পরিস্থিতিতে। কোনো দানবীয় প্রক্রিয়ার কাছে, দানবীয় সিস্টেমের কাছে মানুষ কতটা অসহায় আর বাধ্যগত তা আমি টের পেয়েছি এই বছর। পাশাপাশি টের পেয়েছি অপরাধ আর পাপ এক নয়। কিন্তু আরও যে শক্তির কথা টের পেয়েছি সেটি হলো- হার না মানার স্পৃহা। আদিম মানুষের এই একটি গুণই আমাকে ক্ষেত্রবিশেষে নারকীয় বর্তমানের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। এই বইয়ের বেশ কয়েকটি গল্প পলাতক অবস্থায় লেখা, যেমন- মুচলেকা, সাক্ষী কিংবা নেতা। আবার কিছু গল্প লিখেছিলাম হাইকোর্ট থেকে জামিন পাবার পরে। ঠিক কেন লিখলাম জানিনা, কিন্তু জানি- প্রতিটি কাজেরই একটা নিজস্ব গন্তব্য থাকে। আমার গল্পগুলির গন্তব্য আমার পাঠকেরা। যদিও কারোর কথাই লেখার সময় আমি ভাবিনা, কেবল ভাবি সেইসব চরিত্রের কথা যারা আমাকে লিখতে সাহায্য করেছে- হয়ে উঠেছে আমারই গল্পের চরিত্র। দেশ আর রাষ্ট্রকে আমি কখনোই এক করে দেখিনা। কাজেই ধর্মবাদী থেকে রাষ্ট্র, এমনকি তথাকথিত প্রগতিশীলরাও যদি কখনো এইসব গল্প খারিজ করে দেয়, তবুও গল্পকার হিসেবে আমি বলতে চাই- আমি কারোর মনোরঞ্জনের জন্য এগুলো লিখিনি। বরং প্রায়ই লেখালেখি ছেড়ে আমার নিজের দেশের প্রতি ঘোষণা করতে মন চেয়েছে- প্রিয় বাংলাদেশ, আমি আর কখনো লিখবো না। কারণ আমি জানিনা কী বললে তোমার অনুভূতিতে আঘাত লাগে। কেবল জানি, আমি নিজেই সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছি যখন দেখেছি, আমাকে অভিযুক্ত করে কেস ফাইলের ওপর লেখা- জান্নাতুন নাঈম প্রীতি, ভার্সেস দ্যা স্টেট। আমি যুদ্ধ করতে চাইনি, কিন্তু আমাকে রণক্ষেত্রে দাঁড় করানোর জন্য তোমাকে কখনো ক্ষমা করবো না আমি। To all the whistleblowers, to my friends all over the world who support my thoughts, who support freedom of speech, from whom can I learn- there’s no country for writers and artists. I hope in the near future we’ll get an actual modern world where we don’t need to surrender our thoughts, suppress our expression with basic human rights to any fascist regiment. Long live the freedom of speech! জান্নাতুন নাঈম প্রীতি আমার সহযোদ্ধা মুশতাক আহমেদের মৃত্যুদিন