পৌষ মাস চলছে। বাইরে ভীষণ শীত। রাত বেশ গভীর। পুবাইলের অদূরে ঝলমলিয়া গ্রাম। মতি মিয়ার চায়ের দোকানে একলাছ সাহেব বসে আছেন। উনি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার। দোকানে অন্য কোনো ক্রেতা নেই। এ সময় লাল ফ... See more
TK. 375 TK. 323 You Save TK. 52 (14%)
* স্টক আউট হওয়ার আগেই অর্ডার করুন
কমিয়ে দেখুন
বাংলাদেশে এই প্রথম "অনলাইন বাণিজ্য মেলা" ১ লক্ষাধিক পণ্যে ৭৫% পর্যন্ত ছাড়! সাথে BOGO, 100+ Bundle, ফ্রি শিপিং সহ আকর্ষনীয় সব অফার!
বাংলাদেশে এই প্রথম "অনলাইন বাণিজ্য মেলা" ১ লক্ষাধিক পণ্যে ৭৫% পর্যন্ত ছাড়! সাথে BOGO, 100+ Bundle, ফ্রি শিপিং সহ আকর্ষনীয় সব অফার!
পৌষ মাস চলছে। বাইরে ভীষণ শীত। রাত বেশ গভীর। পুবাইলের অদূরে ঝলমলিয়া গ্রাম। মতি মিয়ার চায়ের দোকানে একলাছ সাহেব বসে আছেন। উনি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার। দোকানে অন্য কোনো ক্রেতা নেই। এ সময় লাল ফ্রক পরা রহস্যময় একটি ছোট্ট বালিকার আবির্ভাব ঘটে। সেই সঙ্গে কিছু নীল ফড়িং। লাল ফ্রক পরা রহস্যময় ছোট্ট বালিকাটি জানায় তার নাম নাফিলা। তার বাবার নাম একলাছ। একলাছ সাহেব ঘাবড়ে যান। হারিকেনের আলোয় ছোট্ট বালিকাটিকে দেখতে থাকেন। মতি মিয়া, একলাছ সাহেবকে সতর্ক করে দেন, এ মেয়েটি অলৌকিক, রহস্যময় কোনো কিছু। এর আগেও এই মেয়েটি অন্য কোনো এক ভদ্রলোকের সঙ্গে এই দোকানে, এমনই রাতের আঁধারে কথা বলেছিল। ঐ ভদ্রলোককেও লাল ফ্রক পরা এ রহস্যময় বালিকাটি একইভাবে, ভদ্রলোকের নিজের কন্যার নামে, নিজের নাম বলেছিল! পরদিন ওই ভদ্রলোকের নিজের কন্যাটি পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যায়। একলাছ সাহেব ভয় পেয়ে যান। অজানা আতঙ্কে ভোগেন। উনার একমাত্র মেয়ের নাম নাফিলা। এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। নাফিলাকে উনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। এলাকার মেধাবী ছেলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাবেরের সঙ্গে নাফিলার প্রেমের সম্পর্ক চলছে। মাখন, নাফিলার সঙ্গে সাবেরের এই সম্পর্ককে মেনে নিতে পারছে না। মাখন নিজেও নাফিলাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। নাফিলার ওপর ক্ষোভ ও অভিমান নিয়ে সাবের বিদেশ পাড়ি জমায়। গৃহশিক্ষক বেলাল মাস্টারও নাফিলাকে ভালোবাসতে শুরু করে। নাফিলা এখন কী করবে? গল্পটি নাটকীয়ভাবে এগুতে থাকে। সাবের ও নাফিলার ভাগ্যে কী আছে? নাফিলা কি বেঁচে থাকবে? শেষ মুহূর্তে আবারও একটি নীল ফড়িং ও ছোট্ট সেই রহস্যময় বালিকার আবির্ভাব ঘটে। এখন কী হবে? সবকিছুর ব্যাখ্যা হয় না- ব্যাখ্যা খুঁজতে নেই!
আব্দুল্লাহ শুভ্র। পুরো নাম মোঃ আব্দুল্লাহ আল ইয়াছিন শুভ্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। তার লেখা প্রথম উপন্যাস শেষ ট্রেন। শেষ ট্রেন উপন্যাসটি উপন্যাস প্রেমীদের ব্যাপক প্রশংসা ও পাঠপ্রিয়তা পায়। তার লেখা নীলফড়িং উপন্যাসটি অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১ এ পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা উপন্যাস গুলোর মধ্যে একটি। তারপর একে একে তিনি লিখেন- মাখনের দেশলাই, তৎপুরুষ উপন্যাস। এ দুটো উপন্যাস পাঠক মহলে সমাদৃত হয়। পাঠকদের অনুরোধে ২০২৪ এর বইমেলায় লিখেছেন কালপিয়াসী জ্যোৎস্না। উপন্যাস লেখার পাশাপাশি কবিতা লেখায় ও তিনি সমান দক্ষ। তার প্রকাশিত প্রথম কবিতা রাজ মঞ্জুরী অর্চনা। দৈনিক প্রথম আলো ২০০৮ সালের ১২ই সেপ্টেম্বরের সাহিত্য পাতায় তা প্রকাশিত হয়। এছাড়াও নিয়মিতভাবে তিনি যুগান্তর পত্রিকায় কবিতা লেখেন। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলো- ফাগুন রঙা শব্দ, চলে এসো এক কাপড়ে, কস্মিনকালেও তুমি প্রেমী ছিলে না এবং এখনো প্রমিথিউস। আব্দুল্লাহ শুভ্রের ভিতর বাস করে এক দেশপ্রেমী আর রোমাঞ্চ প্রিয় ভালবাসার সত্তা। সঙ্গে দার্শনিক মনন। এজন্য তার রচনা হয়ে ওঠে সাজুয্য উপমায় সাবলীল স্রোতধারা।
"জীবনের বাস্তব উপন্যাস তৈরি হতে শুরু করে বিশ্বাসের নাভিশ্বাস থেকেই। আমি লিখে চলছি... অপূর্ণতার কেশরে নক্ষত্রের আয়ুর কণাগুলো খসে খসে পড়ে। আমার ভ্রু বিন্দুতে তারার ঝাঁক মুখর হয়ে ওঠে! অপূর্ণতাগুলো কলমের চোখে চোখ রেখে কথা বলে! এখন যেমন বলছে... পূর্ণতার বিষোদগারে অপূর্ণতাই যেন মহাবিশ্বের প্রতি আমার এক সাগর ভালোবাসা।"
বলছিলাম লেখক আব্দুল্লাহ শুভ্র রচিত উপন্যাস 'নীল ফড়িং' বইটিতে স্থান পাওয়া একটি কবিতার কিছু অংশ। তবে গদ্য ছন্দে লেখা এই কবিতাটি মূলত স্থান পেয়েছিল প্রিয়তমা নাফিলার উদ্দেশ্যে লেখা সাবেরের শেষ চিঠিতে। অব্যক্ত কিছু কথা, জমে থাকা অভিমান, তিল তিল করে বোনা সুখস্বপ্ন, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে জন্ম নেয়া দুরাশা আর মনের গহীনে থাকা নিখাদ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই পত্রের মাধ্যমে। কে এই সাবের? কেই বা নাফিলা?
★ ফ্ল্যাপের কথা: পৌষ মাস চলছে। বাইরে ভীষণ শীত। রাত বেশ গভীর। পুবাইলের অদূরে ঝলমলিয়া গ্রাম। মতি মিয়ার চায়ের দোকানে একলাছ সাহেব বসে আছেন। উনি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার। দোকানে অন্য কোনো ক্রেতা নেই। এ সময় লাল ফ্রক পরা রহস্যময় একটি ছোট্ট বালিকার আবির্ভাব ঘটে। সেই সঙ্গে কিছু নীল ফড়িং। লাল ফ্রক পরা রহস্যময় ছোট্ট বালিকাটি জানায় তার নাম নাফিলা। তার বাবার নাম একলাছ। একলাছ সাহেব ঘাবড়ে যান। হারিকেনের আলোয় ছোট্ট বালিকাটিকে দেখতে থাকেন। মতি মিয়া, একলাছ সাহেবকে সতর্ক করে দেন, এ মেয়েটি অলৌকিক, রহস্যময় কোনো কিছু। এর আগেও এই মেয়েটি অন্য কোনো এক ভদ্রলোকের সঙ্গে এই দোকানে, এমনই রাতের আঁধারে কথা বলেছিল। ঐ ভদ্রলোককেও লাল ফ্রক পরা এ রহস্যময় বালিকাটি একইভাবে, ভদ্রলোকের নিজের কন্যার নামে, নিজের নাম বলেছিল! পরদিন ওই ভদ্রলোকের নিজের কন্যাটি পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যায়। একলাছ সাহেব ভয় পেয়ে যান। অজানা আতঙ্কে ভোগেন। উনার একমাত্র মেয়ের নাম নাফিলা। এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। নাফিলাকে উনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। এলাকার মেধাবী ছেলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাবেরের সঙ্গে নাফিলার প্রেমের সম্পর্ক চলছে। মাখন, নাফিলার সঙ্গে সাবেরের এই সম্পর্ককে মেনে নিতে পারছে না। মাখন নিজেও নাফিলাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। নাফিলার ওপর ক্ষোভ ও অভিমান নিয়ে সাবের বিদেশ পাড়ি জমায়। গৃহশিক্ষক বেলাল মাস্টারও নাফিলাকে ভালোবাসতে শুরু করে। নাফিলা এখন কী করবে? গল্পটি নাটকীয়ভাবে এগুতে থাকে। সাবের ও নাফিলার ভাগ্যে কী আছে? নাফিলা কি বেঁচে থাকবে? শেষ মুহূর্তে আবারও একটি নীল ফড়িং ও ছোট্ট সেই রহস্যময় বালিকার আবির্ভাব ঘটে। এখন কী হবে? সবকিছুর ব্যাখ্যা হয় না- ব্যাখ্যা খুঁজতে নেই!
★ পাঠপ্রতিক্রিয়া: বলা হয়ে থাকে, জীবন নাটকের চেয়েও বেশি নাটকীয়। আর গল্প উপন্যাস সেই নাটকের একগুচ্ছ অংশ মাত্র, যেখানে ভালোলাগা-ভালোবাসা, আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা, আশা-দুরাশা, স্নেহ-মমতা, আবেগ-বিবেক, মানবিকতা আর মানুষের কথা বলা হয়। আমাদের এই সমাজে বিচিত্র সব মানুষের বসবাস। কিছু মানুষ আমাদের সুখে সুখী হয়, বিপদের দিনে নিঃস্বার্থভাবে পাশে দাঁড়ায়। আবার কিছু মানুষ থাকে বন্ধুর বেশে শত্রুর ভূমিকায়। এই মানুষগুলোর জন্য চলার পথ হয় বন্ধুর ন্যায়, জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ, দুর্গম আর কণ্টকাকীর্ণ। এরা পদে পদে আঘাত করে, ষড়যন্ত্র করে সুখস্বপ্নগুলো গুঁড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে। 'নীল ফড়িং' উপন্যাসটিতেও দেখে মেলে এমন বেশকিছু চরিত্রের। তার মধ্যে চারিত্রিক দোষে দুষ্ট গৃহশিক্ষক বেলাল ও প্রভাবশালী চেয়ারম্যানের বখে যাওয়া সন্তান মাখন অন্যতম। এছাড়া আছে তোতা মিয়া, চেয়ারম্যান— মানুষ হিসেবে এরা প্রত্যেকেই স্বার্থলোভী। পুরো উপন্যাস জুড়ে লর্ড বায়রনের বহুল প্রচলিত উক্তির কিছুটা আবহ বেশ ভালোভাবে অনুভূত হয়েছে চরিত্রদের মাধ্যমে যে, "প্রেম মানুষকে শান্তি দেয় কিন্তু স্বস্তি দেয় না।"
★ উপন্যাসের ইতিবাচক ও বাস্তবভিত্তিক দিকগুলো: 'নীল ফড়িং' উপন্যাসটি বেশ অনেকটাই ত্রুটিপূর্ণ। অসামঞ্জস্যপূর্ণ কথোপকথন, চরিত্রায়ন, দৃশ্যায়ন ও অজস্র প্লট হোল থাকা সত্ত্বেও কিছু বিষয় আমার ভালো লেগেছে। লেখক গল্পের ভাঁজে ভাঁজে চরিত্রদের মধ্য দিয়ে তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
• এই যেমন একলাছ সাহেব ও নাফিলার সম্পর্কের গভীরতা, চিরাচরিত বাবা মেয়ের মধ্যকার বন্ধন আর ভালোবাসার নির্দশন যেন। মেয়েকে ঘিরে বাবার দুঃশ্চিন্তা। বাড়ি ফিরেই সবার আগে মেয়েকে ডাকাডাকি করা, সময়ে অসময়ে মেয়ের মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেয়া। অন্যদিকে বাবার জন্যও নাফিলার ভালোবাসা কম নয়, বাবা ঠিকঠাক খেয়েছে কিনা, ঘুমিয়েছে কিনা, শরীর কেমন আছে, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে রুমে গিয়ে দেখে আসা বাবা কী করছে— এই যে ছোট ছোট ব্যাপারগুলো, বাবার খেয়াল রাখা, যত্ন নেয়া এগুলো সত্যিই খুব সুন্দর কিছু অনুভূতির জন্ম দেয়।
• উপন্যাসের অন্যতম প্রধান দুটি চরিত্র সাবের ও নাফিলার সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সেকেলে প্রেমের আবহ, বেকুল হয়ে ল্যান্ডলাইনে কল আসার অপেক্ষা করা, কখনো কখনো লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করা, কখনো বা চিঠি লিখে ভাব বিনিময় করা— এই সুন্দর মুহুর্তগুলো ফুটে উঠেছে। সাবের ও নাফিলার সম্পর্ক কিন্তু খুব বেশিদিনের না। অল্প কিছুদিনের ফোনালাপ, সেই কুয়াশামাখা ভোরে তাদের প্রথম দেখা হওয়া, একে অপরকে ঘিরে জন্ম নেয়া মুগ্ধতা আর অন্তরে প্রণয়ের সুর গাঁথা। তাই হয়তো বলা হয়ে থাকে, "ভালোবাসার জন্য কালের প্রয়োজন নেই, একটি মুহুর্তই যথেষ্ট।" একে অপরকে ঘিরে তাদের একাকী মনের ভাবনাচিন্তা থেকে সাবের আর নাফিলার মনঃস্তত্ব বেশ জীবন্ত হয়ে ওঠে উপন্যাসটিতে। সাবের ও নাফিলার মুগ্ধতা, ক্ষণিকের ফোনালাপ ঘিরে সারাদিনের ভাবনা, নাফিলার কিশোরীসুলভ লজ্জা পাওয়া, মান অভিমান প্রেম যেন ভিন্ন সুর, নতুন রঙ যুক্ত করে মনের আকাশে। সুফী জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমির ভাষ্যে সাবের নাফিলার মনের অবস্থা অনেকটা এমন, "যে হৃদয় ভরপুর প্রেমের আগুনে তার প্রত্যেক কথাই হৃদয়ে ঝড় তোলে।"
• উপন্যাসটিতে অসুস্থ বাবাকে ঘিরে সন্তানের দুশ্চিন্তা, উদগ্রীব হয়ে থাকা, ছোটাছুটি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার বাস্তব দৃশ্য পরিলক্ষিত হয় সাবের চরিত্রটির মধ্য দিয়ে। এভাবেই তো সন্তানদের উচিত বাবা মায়ের প্রতি সব দায়িত্ব পালনে নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করা। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে তো?
• গল্পের এক পর্যায়ে একটি আদর্শ চরিত্রের দেখা পাওয়া যায় এই উপন্যাসটিতে। তিনি হচ্ছেন সাবেরের স্টুডেন্টের বাবা মোনায়েম সাহেব। চরম বিপদের দিনে তিনি নিঃস্বার্থভাবে সাবেরের পাশে না দাঁড়ালে সাবের হয়তো অকুল পাথারে পড়ে যেত। সচরাচর যেসব স্টুডেন্ট কিছু টাকা রোজগারের আশায় টিউশন করিয়ে থাকে, তাদের অভিজ্ঞতা বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে থাকে। ইতিবাচকের তুলনায় নেতিবাচক অভিজ্ঞতাই বেশি। কোনো কোনো স্টুডেন্টের পরিবার প্রকৃত মূল্যায়ন বা সম্মান প্রদর্শন করে না, আবার কেউ কেউ মাসশেষে বেতন ঠিকঠাক পরিশোধ করে না। দেখা যায় মাসের পর মাস পেরিয়ে যায়, নিজেদের বিলাসিতা বা অন্যান্য খরচ চালিয়ে গেলেও বাসার টিউটরের বেতনের কথা তারা বেমালুম ভুলে যায়। সেখানে একজন বাসায় পড়ানোর টিউটরকে প্রায় তিন মাসের বেতন অগ্রিম পরিশোধ করার ঘটনা বিরল। আমি অন্তত কখনো দেখিনি। এর মধ্য দিয়ে ভদ্রলোকের সুন্দর একটা মনের পরিচয় পাওয়া যায়, সাবেরের প্রতি ওনার স্নেহের আদ্রতা অনুভব করা যায়।
• সাবেরের অধ্যাবসায় আর একনিষ্ঠতাও পাঠকদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। বাবার মৃত্যুর পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত পরিস্থিতি থেকে নিজেকে সামলে নেয়া, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থেকে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া— এমন অধ্যাবসায়ী যুবকের উদাহরণ কিন্তু কম নেই আমাদের সমাজে।
• শ্যালিকা জেবুন্নেছার প্রতি একলাছ সাহেবের স্নেহসুলভ ব্যবহার, তিনি যেন জেবুন্নেছাকে নিজের কন্যাসমমতূল্য মনে করেন।
• লক্ষ্মী ভাবি চরিত্রটি খানিকটা ত্রুটিপূর্ণ হলেও স্বল্পদিনের সাক্ষাতে সাবেরকে বিশ্বাস করা, তার বাবার চিকিৎসার জন্য টাকা ধার দেয়া, এ ধরণের ঘটনা খুব কমই দেখা যায়।
★ শিক্ষণীয়: • সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কে বা কাদের সাথে মিশছে, কোনো ভুল পথে জড়িয়ে যাচ্ছে কিনা... এসব ব্যাপারে প্রতিটি বাবা মায়েরই সচেতন থাকা উচিত। হোক সে প্রাক কৈশোর কিংবা কৈশোরে পদার্পনকারী সন্তান। কেননা এ বয়সটায় ঠিক ভুল বোঝার মতো বুঝ ব্যবস্থা সবার হয় না। অভিজ্ঞতার অভাবে মানুষ চিনতে ভুল করে আর যথাযথ দিকনির্দেশনার অভাবে অনেকেই ভুল পথে পা বাড়ায়। অপরিকল্পিত ভবিষ্যতহীন সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। আবেগের নিয়ন্ত্রণ রাখতে জানে না তারা। জানে না সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা। পরিপক্কতার অভাবে আবেগের বশবর্তী হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আর তার মাশুল দিতে হয় তাকে ও তার পরিবারকে। তাছাড়া যেই সমাজে, যেই পরিবেশে আমরা পরিবার নিয়ে বসবাস করছি, তা কতটুকু নিরাপদ? সন্তানের জন্য যথাযথ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কি দিতে পারি আমরা— এই বিষয়গুলোও লক্ষ্য রাখা উচিত প্রতিটি পরিবারের। কেননা দিনশেষে একটা ভুল সিদ্ধান্ত কিংবা অসাবধানতার ফলাফলস্বরূপ যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। আর এতে করে বিপর্যস্ত হবে কেবল ঐ পরিবারটিই।
• কৈশোরে করা ভুলের ঘটনা আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়। কেউ কেউ সেই ভুল থেকে ফিরে আসতে পারে, সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে জীবনে এগিয়ে যায়। কেউ বা পেছনের সারিতেই পড়ে থাকে। হতাশা আর বিষণ্নতার আঁধারে ক্রমেই তলিয়ে যায়। সাবের আর নাফিলার সম্পর্কটি আমার কাছে অপরিপক্ক মনে হয়েছে। যতই বলা হোক, নাফিলার প্রবল ব্যক্তিত্ববোধ, ভীষণ বুদ্ধিমতি, বিচক্ষণ, বেলাল স্যারের ভাষ্যমতে, 'এমন ব্যক্তিত্ব ৪০ বছরের প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলাদের মাঝেও কখনো কখনো অনুপস্থিত থাকে'। কিন্তু এইসবই অতিকথন মনে হয়েছে। নাফিলার আচরণ, ব্যবহার, চিন্তাভাবনা অন্তত আমার কাছে তার বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিক মনে হয়েছে। কিশোরী নাফিলা প্রথম দেখাতেই সাবেরের প্রতি মুগ্ধ হয়েছে, প্রেমে পড়েছে। এক্ষেত্রে একলাছ সাহেব ও তার স্ত্রী তাহেরুন্নেছার ভূমিকা আমার কাছে জোরালো মনে হয়নি। এমন না যে অনেক সন্তান তাদের। একটা মাত্র মেয়ে, সে বয়স হওয়ার আগেই আবেগের বশবর্তী হয়ে একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে, হোক সাবের যত ভালো মানুষ। সবকিছুরই একটা সঠিক সময় থাকে। মেয়ে নাফিলার জন্য একজন প্রাপ্তবয়স্ক গৃহশিক্ষক রেখেছেন, কিন্তু আদৌ মানুষ হিসেবে কেমন, তার চরিত্র কেমন, মেয়ে তার কাছে কতটুকু নিরাপদ, পড়াশোনার অগ্রগতি আদৌ হচ্ছে কি! এসব তেম কোনো খোঁজ খবর রাখতে দেখা যায়নি কাউকে। ফলাফল স্বরূপ নাফিলার এসএসসিতে অকৃতকার্য হওয়া। একলাছ সাহেব রিটায়ার্ড ব্যাংকার মানে তিনি যথেষ্ট শিক্ষিত, তার ভাবনা চিন্তাও বিচক্ষণ মনে হয়েছে। একাল সেকাল ব্যাপার নয়, সন্তানকে ঘিরে এসব সতর্কতা সবসময়ই থাকা উচিত বাবামায়ের। অপরিপক্ক সম্পর্কর জের ধরে নাফিলার মানসিক বিপর্যস্তাও চোখে পড়ার মতো।
• সাবেরের দিক থেকেও ভুল ছিল। কাউকে পছন্দ করা অন্যায় নয়। কিন্তু কখনোই মাত্রাতিরিক্ত হোঅয়া উচিত নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নিজেকে 'ব্যক্তিত্ববান' ভাবা ছেলেটি চাইলেই কিছুদিন অপেক্ষা করতে পরাতো, এটুকু বোঝার বয়স তার হয়েছে যে নাফিলা আর তার মনঃস্তত্ব এক নয়। মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় কিছুটা বেশি ম্যাচিউরড হয় এই তত্ত্ব ধরে আবেগে ভেসে যাওয়া, আবার সেই কদিনের আবেগ থেকে জন্ম নেয়া ভালোবাসা অবিশ্বাসের সুর অবাস্তব কিছু নয়। সাবের নিজে হয়তো বাস্তববাদী হয়ে সবকিছু পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নাফিলা তো সেই পেছনেই পড়ে রয়েছিল। পড়াশোনার ক্ষতি, মানসিকভাবে ভেঙে পড়া আর এর বিরূপ প্রভাব মেয়েটির পরিবারেও পড়েছিল।
• বাবা মায়ের সব সিদ্ধান্ত সবসময় সন্তানের জন্য সঠিক হয় না। তারাও মানুষ, ভুল করতেই পারেন। তবে সন্তানের জীনবের যেকোনো সিদ্ধান্তে বিচক্ষণ হওয়া জরুরি। এই যেমন নাফিলার বিয়ে প্রসঙ্গে তার বাবার সিদ্ধান্ত একেবারেই মেনে নেয়ার মতো না। মেয়েকে এতো ভালোবাসে, সেই মেয়ে নিশ্চয়ই পানিতে পড়ে যায়নি, আর নাইবা ভালো ছেলের অভাব আছে দুনিয়ায়। মাখনের সাথে নাফিলার বিয়ে প্রসঙ্গে নাফিলার বাবা-মা দুজনের ভূমিকাই অগ্রহযোগ্য। যেখানে পাত্র মাখনের মতো কেউ। তবে একটা বিষয় অগ্রহণযোগ্য হলেও এই দৃশ্য অবাস্তব নয়। আমাদের সমাজে অহরহ দেখা যায় সামাজিক অবস্থান জোড়ালো করার লক্ষ্যে কিংবা নিজেদের ভবিষ্যৎ স্থিতিশুল করার লক্ষ্যে কিংবা লোভে পড়ে অনেক পরিবারই সন্তানদের বিয়ের ব্যাপারে বিবেক বিবেচনাবোধ সব বিসর্জন দিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, জোর করে নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেয় সন্তাধের কাঁধে। ফলাফল স্বরূপ তাদের জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়।
• প্রতিটি সম্পর্কের কিছু শোভন অশোভন ব্যাপার থাকে সীমাবদ্ধতা থাকে। একলাছ সাহেব স্নেহ করেন, মানে এই নয় জেবুন্নেছা প্রাপ্তবয়স্ক একজন মহিলা হয়ে উল্টোপাল্টা কাজ করতে পারেন। তার ঠাট্টা তামাশা কিছুটা মাত্রাতিরিক্ত ও অযৌক্তিক মনে হয়েছে। গ্রাম্যেগঞ্জে শ্যালিকা দুলাভাইয়ের মাঝে সম্পর্কগুলো কিছুটা মজার হয়ে থাকে। কিন্তু বয়সের তারতম্য অনুসারে সবারই উচিত সম্পর্কের সম্মান আর সীমাবদ্ধতা বজায় রাখা।
• বেলাল স্যার ও মাখন চরিত্রদুটি অবশ্যই ভালো লাগার মতো কোনো চরিত্র নয়। তবে নাফিলার প্রতি বেলাল স্যারের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি বা মনোভাব উপলব্ধি করার পরও নাফিলার মৌনতা। এরকারণ অবশ্য হতে পারে সেই সময়কার সমাজব্যবস্থা। মেয়েরা এত প্রতিবাদী বা স্পষ্টবাদী ছিল না। এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয় ভাবতো। কিন্তু এখন যুগ পাল্টেছে। তাই আপত্তিকর যেকোনো আচরণের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার থাকা উচিত।
• গৃহশিক্ষক ছাত্রীকে পছন্দ করার ঘটনা নতুন কিছু নয়। ধরলাম বয়সের ব্যবধানও আগেরদিনে অত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ভালোলাগাটাই মূখ্য। তাহলে সেই ভালোলাগার মানুষটির ক্রন্দনরত দুখী মুহূর্তে কী করে 'বাসর রাত' এর কথা মাথায় আসতে পারে? হয়তো বেলালের কুরুচিপূর্ণ মানসিকতা তুলে ধরাই এখানে লেখকের উদ্দেশ্য ছিল। এ ধরণের মানুষের সংখ্যা সমাজে কম নয়।
★ যা কিছু ভালো লাগেনি— • একটি গল্প বা উপন্যাস স্বার্থক পেছনে অনেকগুলো বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্লট, ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট, ট্র্যাজেডি, টার্নিং পয়েন্ট বা টুইস্ট, স্টোরি টেলিং, এন্ডিং ইত্যাদি। একজন লেখকের জন্য জরুরি নয় সবগুলো বিষয়ে একসাথে আলোকপাত করা। কিন্তু পুরো উপন্যাসটিই যদি অপরিচ্ছন্ন চিন্তাভাবনার ভিত্তিতে রচিত হয়, তা পাঠকের জন্য হতাশার। মূল গল্প যাই হোক না, সাদামাটা একটা গল্পও দারুণ লিখনশৈলীর কৌশলী প্রয়োগে নান্দনিক ও আবেদময় হয়ে ওঠে। লেখক তার সৃষ্টির বেলায় সম্পূর্ণ স্বাধীন, তবে এটাও মাথায় রাখতে পাঠক লেখকের বার্তাটি ঠিকঠাক ধরতে পারছে কিনা, লেখকের উদ্দেশ্য গল্প পাঠকের মনে ঠিক কতটুকু দাগ কেটে যাচ্ছে। লিখনশৈলীর গুণে উপমা আর রূপকের যথাযথ ব্যবহার রচনায় একঘেয়েমি ভাব দূর করে, বাক্যে গভীরতা আনে। লেখক কী বলতে চেয়েছেন তা যদি পাঠক বুঝতেই না পারেন তবে তা লেখকের জন্যও হয়তো হতাশাজনক।
• এই উপন্যাসটির নানাবিধ ত্রুটি বিচ্যুতির কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে লেখক হয়তো তাড়াহুড়ো করেছেন। এতগুলো চরিত্রদের মাথায় নিয়ে একটা উপন্যাস রচনা অবশ্যই সহজ কিছু নয়। একেকটা বই তার লেখকের কাছে সন্তানতূল্য। তার যত্ন নিয়ে সময় নিয়ে কিছুটা স্টাডি করে গোছালো ভাবে করা হলে এই ভুল ত্রুটি এড়ানো সম্ভব। সবকিছুর আগে প্রয়োজন পরিচ্ছন্ন এবং স্পষ্ট চিন্তাভাবনা। যেমন উপন্যাসটির জনরা নিয়ে পাঠক বেশ দ্বিধান্বিত বোধ করবে। একটি উপন্যাস ভৌতিক, সামাজিক নাকি মনঃস্তাত্বিক, তার উপর নির্ভর করবে কেমন হবে তার পাঠকশ্রেণী। আবার এটাও জরুরি নয় উপন্যাসটি কেবল একটি জনরার উপর ভিত্তি করেই রচিত হবে। হতেই পারে এটি মিশ্র জনরার। ভৌতিক গল্পে এসে মিশেছে সামাজিক অবস্থান, রীতিনীতি, মানবিক গুণাবলী, মনঃস্তত্ব, প্রেম ভালোবাসার মতো মানবিক সম্পর্কগুলো। কিন্তু সবকিছুর পেছনেই থাকা উচিত স্পষ্ট কারণ, ব্যাখ্যা ও পরিণতি। এমন অনেক লেখক আছেন যারা গল্পের প্রতিটি ডিটেইলস ব্যাখ্যা করতে পছন্দ করেন। আবার অনেকেই গল্পের একটা অংশ পাঠকের চিন্তাভাবনা উপর ছেড়ে দেন। এটা অবশ্যই লেখকের নিজস্বতা, স্বকীয়তা। কিন্তু প্যাটার্ন যেমনি হোক না কেন, গল্প বলার ধরণ সাবলীল এবং সহজবোধ্য হলে সহজপাঠ্য হয়।
'নীল ফড়িং' উপন্যাসটিতে লেখক সহজ গদ্যে গল্প বলে গিয়েছেন, চরিত্রদের কথোপকথন উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু খাপছাড়া বর্ণনার ধরণে স্বভাবতই পাঠকমনে বিরক্তির জন্ম হয়েছে। গল্পের বার্তাগুলো অনুধাবন করতে বেগ পেতে হয়েছে। এছাড়া সমাপ্তিও অনেক বেশি নাটকীয় মনে হয়েছে। হয়তো বা লেখক তাড়াহুড়ো করে ফেলেছেন।আশা করছি লেখক হয়তো এই আলোচনাগুলো পজিটিভলি নেবেন। আমি চেষ্টা করেছি লেখক ও পাঠক উভয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করার।
যাই হোক, দীর্ঘ এই পাঠপ্রতিক্রিয়ায় ইতি টানছি এক গুচ্ছ পঙক্তিমালার হাত ধরে— "জীবনের বিবিধ অধ্যায়গুলো, অপ্রিয় অনুভূতিগুলো, নাম ঠিকানাবিহীন করে হৃদয়ের ভাগাড়েই ফেলে রেখেছি! ঘুমের ঘোরে এমনি করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছি! একাকী যখন উড়তে শিখে গেছি, পুরোটা নীল আকাশ শুধুই আমার।"
বই: নীল ফড়িং লেখক: আব্দুল্লাহ শুভ্র জনরা: সামাজিক-রোমান্টিক উপন্যাস প্রকাশনী: কবি প্রকাশনী প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ মুদ্রিত মূল্য: ৩৭৫৳ আলোকচিত্রী ও পাঠপ্রতিক্রিয়ায়: শৈলী বইটি পাওয়া যাবে rokomari.com এ...
Read More
Was this review helpful to you?
By nurul abser,
09 Jun 2024
Verified Purchase
“ভালোবাসা হচ্ছে একধরনের মায়া যেখানে পুরুষ এক নারীকে অন্য নারী থেকে আলাদা করে দেখে আর নারী এক পুরুষকে অন্য পুরুষ থেকে আলাদা করে দেখে।”
উপরের কথাটা বলছিলো আমেরিকান সাংবাদিক লুইস ম্যাকেন।নীল ফড়িং বইটা পড়ে এই কথাটার গভীরতা একটুকু হলেও বোঝা যায়।প্রেম শব্দটি দুটি বর্ণের হলেও অনেকের কাছে তা সাগরের জলরাশির বিশাল কিংবা গভীর কোনো অনূভুতি। অনেকের প্রেম অবিনশ্বর, সজ্ঞাহীন। প্রেম মানুষকে আলাদা শক্তি দেয়, যার কারণে শত বাধাবিপত্তি পেরিয়েও সে প্রেম নামক অনুভূতিটি পেতে চায়। ভালোবাসা মানুষকে সুখের সাথে সাথে দুঃখও দেয়,সেই সময়ের আগে যেন প্রেমে পড়া মানুষটি অনেক বেশি বুঝদার হয়ে যায়। ভালোবাসার মধ্যেই জয়-ব্যার্থতা দুটোই বিদ্যমান।অনেকের ভাগ্যে হয়তো ঝড়ো হাওয়ার মতো ভালোবাসা এসে সব তছনছ করে দেয়। বইটার নাম নীল ফড়িং হলেও গল্পের মাঝখানে কিঞ্চিৎ নীল ফড়িং এর দেখা মিলে। ফলে বইটার নাম নীল ফড়িং রাখার কারণটা ব্যাখ্যাহীন।
★উপন্যাস সংক্ষেপ: এখলাছ সাহেবের একমাত্র কন্যা নাফিলা ১০ম শ্রেণিতে পড়ে। মেয়েকে নিয়ে এখলাছ সাহেবের আহ্লাদের শেষ নেই, সেই সাথে কিছুটা দুশ্চিন্তাও থাকে। কারণ মেয়েকে তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। একদিন রাতের বেলা এখলাছ সাহেবের সামনে হাজির হয় লাল রঙের ফ্রক পরা নাফিলা নামের রহস্যময় এক মেয়ে। মেয়েটার দেখা পাওয়ার পর এখলাছ সাহেবের জীবন পাল্টে যায়। তার একমাত্র মেয়ের টিউশন টিচার বেলাল সাহেবের নজর যায় তার ছাত্রীর দিকে, অন্যদিকে সাবের আর মাখনও নাফিলাকে জয় করতে মরিয়া। অন্যদিকে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া নাফিলার জীবন চারপাশে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলো যেন নাটকীয় করে তুলেছে। শেষ পর্যন্ত কি ঘটেছিল নাফিলার জীবনে? সাবের-নাফিলার ভালোবাসার পরিণতিই বা কি হয়েছিল? নীল ফড়িং আর রহস্যময় বালিকার সত্যটা কি?
পাঠ প্রতিক্রিয়া : ★লেখক ৯০ দশকের উঠতি যুবক-যুবতীর প্রেম কাহিনী বলার চেষ্টা করলেও প্রথম দিকে রহস্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন। বইয়ের দুই তৃতীয়াংশই ছিলো নাফিলা আর সাবেরের ভালোবাসার গল্প। প্রথম প্রেম কতোটা তীব্র হয় সেটার উৎকৃষ্ট উদাহরণ নাফিলা, যা বইয়ের মূল অংশ এবং শেষ পর্যন্ত উপস্থিত। সৃষ্টির অনাদিকাল থেকেই প্রেমের যে ধারা বয়ে আসছে নাফিলার কাছেই সেটি ধরা দেয়। মন আর মস্তিষ্কের মাঝেই সাবের নামক প্রেমকে অনুভব করে নাফিলা। পাঠক বইটা পুরোপুরি গ্রামীণ সামাজিক উপন্যাস হিসেবে পড়তে বসলে বড় একটা ধাক্কা খাবে। লেখক মূলত একটা প্রেম কাহিনির মধ্যে নানা ষড়যন্ত্র সাথে নিম্নবিত্ত মানুষের কষ্ঠ এবং ক্ষমতার দাপট দেখানো একদল মানুষের গল্প বলেছেন। একটা পরিবারে স্কুল পড়ুয়া মেয়ে থাকলে মা-বাবার কতোটা দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় তাও দেখতে পাওয়া যায়।
★তবে গল্পের একটা ভালো অংশগুলো মধ্যে ছিলো লেখক বিপদে সবসময় আল্লাহ কে স্বরণ করার বিষয়টি বেশ ভালোভাবে উপস্থাপন করেছে। এখলাছ সাহেবের চরিত্রে একজন আদর্শ বাবার গল্প ফুটিয়ে তুলা হয়েছে অনেকটা।যে সন্তানের চিন্তিত এবং নিরুপায়। অন্যদিকে সাবেরের মধ্যে একজন নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানের অসহায়ত্ব তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে তার পরিবারের বিপদে সবসময় ছুটে চলা এক যুবক। তার দৃষ্টিতে ভালোবাসা এক পবিত্র বন্ধন। সাবের বিশুদ্ধ পানির মতো, তার জীবনের হিসেব নিকেশ,দূরদর্শিতা এবং সংযমের প্রাণবন্ত এক প্ল্যাটফর্ম। সাবেরের কাছে নাফিলাই একমাত্র নারী যে তার সহজ সরল জীবনে তোলপাড় করা ঢেউয়ের মতো। সাবের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়েও নাফিলার কথা মাথা থেকে তাড়াতে পারে নি। প্রেমের যে সাইড ইফেক্ট নামক বস্তু আছে এটা সাবের মানসিকভাবে ভোগায়। তারপরেও সাবের ভালোবাসার মায়া থেকে বের হয় নি। তাই হয়তো কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন “প্রেম হচ্ছে জলন্ত সিগারেট যার সংযোগ অগ্নি শেষ পরিণত ছাই” ব্যক্তিভেদে চিন্তা ভাবনা কতোটা ভিন্ন হয় সেটা বেলাল সাহেব আর মাখনের মধ্যে দেখা যায়। তারা আমাদেরই প্রতিবেশী যারা নিজের মস্তিষ্কের ভেতর কুচিন্তা পুষে রাখে।
★★লেখকের উপন্যাসের বিষয়বস্তু অন্যভাবে চিন্তা করলে এসব ঘটনা আমাদের চারদিকে সবসময় ঘটে। প্রেমঘটিত কারণে পরিবারকে উত্যাক্ত করা। বাপের বিগড়ে যাওয়া সন্তান, আরও নানা কর্মকাণ্ড। স্টোরি টেলিংটা আরেকটু ভালো হলে এবং ধারাবাহিকতা থাকলে উপন্যাসটা আরেকটু ভালো লাগতো। কয়েকটি বিষয় লেখক চাইলে আরেকটু ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে পারতো। লক্ষ্মী ভাবি চরিত্রটার কোন নির্দিষ্ট স্থিরতা ছিলোনা এই নেগেটিভ তো অন্য জায়গা পজিটিভ।সবচেয়ে বড় অদ্ভুত লেগেছে সাবেরকে এক দেখায় তার প্রতি নাফিলার মতো মেয়ের আসক্তি। লেখক নীল ফড়িং আর রহস্যময় মেয়েটার ব্যাখ্যা পরে কোথাও উল্লেখ করে নি। আর শেষদিকে একটু নাটকীয় টুইস্ট। সব মিলিয়ে বলব যারা উঠতি বয়সী প্রেমের গল্প সাথে সামাজিক গল্প পড়তে চান তারা বইটি পড়তে পারেন।
বইয়ের প্রোডাকশন: কবি প্রকাশনীর বই নিয়ে আগেই ধারণা ছিলো। ওদের বাঁধাই,পেজ সবকিছু দারুণ লাগে। নীল ফড়িংও একই কাজ করেছে তারা। বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে সবকিছু সুন্দর।
নীল ফড়িং বইটি নিয়ে কিছু বলব এমন কোন ভাষা আমার নেই। শুধু বলতে পারি- লেখন তার লিখনি আমার হৃদয়ের গভীরে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছেন। বইটি শুরুর কয়েকপাতা পড়ার পর শেষ করার নেশা ধরে যায়। আর পড়া শেষে দেখি আমি আমার আবেগ ধরে রাখতে পারছিনা। সত্যিই কান্না পেয়েছে.........
Read More
Was this review helpful to you?
By san****com,
10 Jun 2024
Verified Purchase
#রকমারি_নীল_ফড়িং_বুক_রিভিউ_প্রতিযোগিতা
⚈ হালকা স্পয়লার যুক্ত রিভিউ ⚊ ❛নীল ফড়িং❜
প্যারাসাইকোলজি আসলে কি? প্রায় সময়ই আমরা এই শব্দটা শুনতে পাই, কিন্তু এই শব্দটা সঠিক ব্যাখ্যা কি? কখনো কি আপনার মনে এই প্রশ্ন জেগেছে? প্যারাসাইকোলজি বুঝতে হলে পূর্বে আমাদের প্যারানরমাল এর সাথে পরিচিত হতে হবে, তারপর আসতে হবে প্যারাসাইকোলজিতে।
প্যারানরমাল বলতে আমরা তাকেই বুঝি যা কিনা আমাদের স্বাভাবিক বা নর্মাল যুক্তিগ্রাহ্য অভিজ্ঞতা বা বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। অর্থাৎ সোজা কথায় বলতে গেলে নানারকম ভূতুড়ে বা অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা, এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল জিনিসপত্রকেই প্যারানমাল বলা হয়। আর এই প্যারানর্মাল বিষয়বস্তুর মানুষের মনস্তাস্তিক ব্যাখ্যা কে প্যারানর্মাল সাইকোলজি (Paranormal Psychology) কিংবা প্যারাসাইকোলজি বলে। আর একটু সহজ করে বললে সাইকোলজির ব্যাখ্যাতীত অংশটা প্যারাসাইকৌলজি।
ভুত কে আমরা কয়জন ই বা দেখেছি? হয়ত এক হাজারের এক জন ও নয়। কিন্তু আমরা ভুতের ভয়ে থেকেছি কিন্ত সবাই। কারন আমাদের মনে জোর করে ভুতের ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তাতে আমাদের মনজগতে বাস্তবে ভুতের অস্তিত্ব আছে কি নেই সেই বিতর্কে যায় না। অন্ধকার ঘরে ইদুরের খুট খাট আওয়াজ শুনে আমরা ভুতের কাজ বলে এক কথায় মন কে বিলিভ করিয়ে ফেলি। আর তাই আমাদের মন জগতে প্যারাসাইকোলজি এর গুরুত্বপুর্ন প্রভাব লক্ষ করা যায়।
প্যারা সাইকোলজির বিষয়বস্তু হলো টেলিপ্যাথি থেকে শুরু করে ভবিষ্যতের জীনিস গুলো দেখতে পাওয়া, বিশেষ ক্ষমতার বলে মানুষের মনকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাসহ নানান আধিভৌতিক বিষয়।
—————
প্যারানরমাল বই হিসেবে উপরোক্ত বিষয়গুলো ধাপে ধাপে প্রকাশ করার কথা ছিলো ❝নীল ফড়িং❞ বইটার। অথচ সামান্য সময়ের জন্য একটা রহস্যের কুয়াশা সৃষ্টি হলেও খানিক পরেই মিলিয়ে যায় সেইটা। নাফিলা নামের ছোট মেয়েটা ভয়ের জাল যেভাবে গুটিয়ে আনা শুরু করেছিলো তা হঠাৎই হারিয়ে যায়।
তবে ❛নীল ফড়িং❜ উপন্যাসে কিছু মনস্তাত্ত্বিক বিষয়বস্তু ওঠে এসেছে। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জগতের কিছু বিষয় বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে এই উপন্যাসে। মনোজগতের উপর ভিত্তি করে এই বইকে দুটো অংশে বিভক্ত করা যায়। প্রথমত প্রাপ্ত বয়স্কদের সাইকোলজি, দ্বিতীয়ত ছোট বাচ্চাদের সাইকোলজি। কিন্তু সে চেষ্টায় লেখক কতটা সফল তা নিয়ে আমি সন্দিহান।
➤ আখ্যানঃ পৌষ মাস চলছে। বাইরে ভীষণ শীত। রাত বেশ গভীর। পুবাইলের অদূরে ঝলমলিয়া গ্রাম। মতি মিয়ার চায়ের দোকানে একলাছ সাহেব বসে আছেন। উনি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার। দোকানে অন্য কোনো ক্রেতা নেই। এ সময় লাল ফ্রক পরা রহস্যময় একটি ছোট্ট বালিকার আবির্ভাব ঘটে। সেই সঙ্গে কিছু নীল ফড়িং। লাল ফ্রক পরা রহস্যময় ছোট্ট বালিকাটি জানায় তার নাম নাফিলা। তার বাবার নাম একলাছ। একলাছ সাহেব ঘাবড়ে যান। হারিকেনের আলোয় ছোট্ট বালিকাটিকে দেখতে থাকেন। মতি মিয়া, একলাছ সাহেবকে সতর্ক করে দেন, এ মেয়েটি অলৌকিক, রহস্যময় কোনো কিছু। এর আগেও এই মেয়েটি অন্য কোনো এক ভদ্রলোকের সঙ্গে এই দোকানে, এমনই রাতের আঁধারে কথা বলেছিল। ঐ ভদ্রলোককেও লাল ফ্রক পরা এ রহস্যময় বালিকাটি একইভাবে, ভদ্রলোকের নিজের কন্যার নামে, নিজের নাম বলেছিল! পরদিন ওই ভদ্রলোকের নিজের কন্যাটি পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যায়। একলাছ সাহেব ভয় পেয়ে যান। অজানা আতঙ্কে ভোগেন। উনার একমাত্র মেয়ের নাম নাফিলা। এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। নাফিলাকে উনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। এলাকার মেধাবী ছেলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাবেরের সঙ্গে নাফিলার প্রেমের সম্পর্ক চলছে। মাখন, নাফিলার সঙ্গে সাবেরের এই সম্পর্ককে মেনে নিতে পারছে না। মাখন নিজেও নাফিলাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। নাফিলার ওপর ক্ষোভ ও অভিমান নিয়ে সাবের বিদেশ পাড়ি জমায়। গৃহশিক্ষক বেলাল মাস্টারও নাফিলাকে ভালোবাসতে শুরু করে। নাফিলা এখন কী করবে? গল্পটি নাটকীয়ভাবে এগুতে থাকে। সাবের ও নাফিলার ভাগ্যে কী আছে? নাফিলা কি বেঁচে থাকবে? শেষ মুহূর্তে আবারও একটি নীল ফড়িং ও ছোট্ট সেই রহস্যময় বালিকার আবির্ভাব ঘটে। এখন কী হবে? সবকিছুর ব্যাখ্যা হয় না- ব্যাখ্যা খুঁজতে নেই!
➤ পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ ❛নীল ফড়িং❜ বইটা হাতে পাবার পূর্বে ফেসবুকসহ সুপরিচিত অনেকের মুখেই শুনেছি বইটা আধিভৌতিক কিংবা প্যারাসাইকোলজিক্যাল জনরার। রকমারিসহ বিভিন্ন পেইজ ঘেটে, বইয়ের ফ্ল্যাপ দেখেও সে বিষয়ে অনেকটা নিশ্চিত হয়ে বইটা সংগ্রহ করেছিলাম। শুরুর কয়েক পৃষ্ঠা পড়েও বেশ সন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু যতই সামনে আগাচ্ছিলাম ততই যেন একটা ঝোড়ো হাওয়া এসে আমার কাধে ধাক্কা দিতে লাগলো। টেলিপ্যাথি, সাইকোনাইসিস, রহস্যের ঘ্রাণ, ভয়ের খুটখুট শব্দ বদলে গিয়ে চতুষ্কোণ প্রেমের ঢেউ এসে গাঁয়ে লাগলো। মাঝরাতে ভয়ের শিহরণ অনুভব করার জন্য ভৌতিক বই শুরু করলাম অথচ বইয়ের শেষ পাতায় গিয়ে অনুভব করলাম এক প্রেম আখ্যানের ঢেউয়ে দুলছিলাম এতক্ষণ। বেশ কিছু মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার ছিলো বটে তবে মোটেও তা আধিভৌতিক না। আমার প্রত্যাশার পারদ চূর্ণ হলেও যারা সমকালীন লেখা পছন্দ করে তাদের জন্য বইটা অবশ্যই সুখপাঠ্য হবে।
➤ পর্যালোচনাঃ কথিত আছে ❝বাঙালী জীবনে নূতন ভালবাসার প্রবর্তনকর্তা বঙ্কিমচন্দ্র❞ কিংবা ❝বঙ্কিমচন্দ্রের প্রেমের উপন্যাস পড়ে বাঙ্গালীরা নতুনভাবে প্রেম আবিষ্কার করেছে।❞ তবে বাঙ্গালী কীভাবে প্রেম শিখেছে তা আমার কহতব্য বিষয় না হলেও ❛নীল ফড়িং❜ বইটি দাঁড়িয়ে আছে একটি চতুষ্কোণ প্রেম উপাখ্যানের উপর। তাই এই বইটার খুটিনাটি বিষয়গুলো নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
● প্রেমঃ প্রেম বলতে পৃথিবীতে বিচরণকারী নরনারীর একের প্রতি অন্যের রহস্যাতীত আকর্ষণবোধ এবং এর অপূরণজনিত কারণে জন্ম নেয়া অসুস্থতাকে বোঝায়। বিশ্বের প্রতিটি প্রেমকাহিনি অভিন্ন। প্রেমিক হৃদয়মাত্র মথিত ব্যাখ্যাতীত বেদনায়। প্রেমের প্রাপ্তি ধারণ করা দুষ্কর। আগুনের আকর্ষণে ছুটে গিয়ে আগুনে আত্মাহুতি দেয়ার নামও তো প্রেম। যুগে যুগে মানুষের মন প্রেমে পড়েছে। না পাওয়ার যন্ত্রণায় কাতর হয়েছে বারবার। কিন্তু নিজেকে সে রুদ্ধ করে রাখতে পারেনি। আত্মা যার সন্ধান লাভ করে অসীমের, নিজেকে রুদ্ধ রাখা তার পক্ষে কীভাবে সম্ভব। স্বাধীন মানব তো চিরকাল সিন্ধুপ্রেমিক। ❝নীল ফড়িং❞ এমনই এক প্রেমগাঁথা। প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, মিলন, বিরহ, ভাঙ্গন, গড়ন, ভালোবাসা সবকিছুর সংমিশ্রণের এক সৃষ্টি। ❛নীল ফড়িং❜ উপন্যাসের প্রতিপাদ্য বিষয় যৌবনের প্রেমের আবেগ। নাফিলার প্রতি সাবেরের ভালোবাসা ফুটে উঠেছে প্রথম থেকেই। তবে সময়ের ব্যবধানে এই ভালবাসার মাঝেই চির ধরেছে। বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের দুলুনিতে দুলেছে বারংবার। কিন্তু সাবেরের প্রতি নাফিলার ভালোবাসা ঈর্ষনীয়। প্রতিটা ছেলেই তার জীবনে এমন একজনকে কল্পনা করে।
● ভাগ্য এবং সুযোগঃ ❛নীল ফড়িং❜ উপন্যাসের নিয়তির ভূমিকা নিয়ে পাঠকমহল ঘড়ির দোলকের মতো দুলতে পারে। নায়ক-নায়িকার যে পরিণতি, তা কি ভাগ্যের পরিহাস না ঘটনার ফলশ্রুতি! ভাগ্যতত্ত্বে বিশ্বাসী পাঠক সাবের-নাফিলার পরিণতিকে অশুভগ্রহদুষ্ট বলে অভিহিত করতে পারেন। পক্ষান্তরে অনেক যুক্তিবাদী পাঠক মনে করতে পারেন বইটি যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য ঘটনাপ্রবাহর উপরে দাঁড়িয়ে। উদাহরণস্বরূপ, সাবের নাফিলাকে যথেষ্ট সময় না দেয়ার কারণে তাদের সম্পর্কের মাঝে ফাটল ধরে এবং লক্ষি বৌদির বাজে কথা-ই মূলত সম্পর্ক ভাঙ্গনের মূল হেতু। অপরদিকে ভাগ্য বিশ্বাসী পাঠকগণ বলতেই পারেন জন্ম, মৃত্যু বিয়ে ভাগ্য দেবতার হাতে। সাবের কিংবা নাফিলার হুট করে একে অপরের প্রতি হঠাৎই অবিশ্বাস। এটা শনিরদৃষ্টি বৈ অন্য কিছু না।
● দ্বৈতবাদ(আলো এবং আঁধার)ঃ ❛নীল ফড়িং❜ উপন্যাসটি কোনো একটি বিশেষ ভাবের ধারক নয়, ভাববৈচিত্র্যের সমাহার। ঠিক যেন মানবচরিত্রের বহুমুখীতা, শুভাশুভের দ্বন্দ্ব যেন এই বইয়ের উপজীব্য। শুভ এবং অশুভকেই এখানে আলো এবং আঁধারের উৎস ধরা যায়। নাফিলা চরিত্র আলোর বাহক। অপরদিকে সাবের চরিত্রটা সময়ের ব্যবধানে আলো থেকে আঁধারে নিমজ্জিত হয়েছে। মাখন চরিত্রটা সরাসরি আঁধারের বাহক। রাহুর ন্যায় মাখন গ্রাস করতে চেয়েছে নাফিলাকে। আর লক্ষি হলো কেতুর আলো এবং আঁধার প্রকৃতপক্ষে ভালবাসা এবং ঘৃণা, তারুণ্য এবং পরিপক্কতা-এদেরই দ্যোতক। সর্বোপরি এটাই বলা যায় সাবের নাফিলার ভালোবাসা আলোর প্রতীক পক্ষান্তরে মাখনের হিংসা, বেলাল, লক্ষী, জাহেদের উপস্থিতি এ উপন্যাসের আঁধারের প্রতীক।
● সূত্রপাতঃ পৌষ মাস চলছে। বাইরে ভীষণ শীত। রাত বেশ গভীর। পুবাইলের অদূরে ঝলমলিয়া গ্রাম। মতি মিয়ার চায়ের দোকানে একলাছ সাহেব বসে আছেন। উনি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার। দোকানে অন্য কোনো ক্রেতা নেই। এ সময় লাল ফ্রক পরা রহস্যময় একটি ছোট্ট বালিকার আবির্ভাব ঘটে। সেই সঙ্গে কিছু নীল ফড়িং। লাল ফ্রক পরা রহস্যময় ছোট্ট বালিকাটি জানায় তার নাম নাফিলা। তার বাবার নাম একলাছ। একলাছ সাহেব ঘাবড়ে যান। হারিকেনের আলোয় ছোট্ট বালিকাটিকে দেখতে থাকেন। মতি মিয়া, একলাছ সাহেবকে সতর্ক করে দেন, এ মেয়েটি অলৌকিক, রহস্যময় কোনো কিছু। এর আগেও এই মেয়েটি অন্য কোনো এক ভদ্রলোকের সঙ্গে এই দোকানে, এমনই রাতের আঁধারে কথা বলেছিল। ঐ ভদ্রলোককেও লাল ফ্রক পরা এ রহস্যময় বালিকাটি একইভাবে, ভদ্রলোকের নিজের কন্যার নামে, নিজের নাম বলেছিল! পরদিন ওই ভদ্রলোকের নিজের কন্যাটি পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যায়। একলাছ সাহেব ভয় পেয়ে যান। অজানা আতঙ্কে ভোগেন।
—
উপন্যাসের শুরুটা চমৎকার। আগ্রহ জাগানোর মতো। কেমন ভৌতিক একটা পরিবেশ। কুয়াশায় ঢাকা রহস্যময় একটা জগৎ মনে হচ্ছিলো পরে কী হবে এ নিয়ে বেশ আগ্রহী ছিলাম। পাঠককে গল্পে আটকে রাখার মতো একটা সূত্রপাত।
● গল্প বুনটঃ নাটকীয় সংঘাত, অপ্রত্যাশিত ভাবে গল্পের মোড় পরিবর্তন ❛নীল ফড়িং❜ উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য যা প্রশংসার দাবিদার। সাবের-নাফিলার বিচ্ছেদের পূর্ব পর্যন্ত ❛নীল ফড়িং❜ ছিল একটি লঘু প্রণয় কাহিনী। তার পরেই বইটি গুরুগম্ভীর রূপ ধারণ করে। বিচ্ছেদের পর মাখনের মৃত্যু পাঠক মনে আবার আশা জাগে মিলনান্তক পরিণতির। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ অভাবিত ভাবে ভিন্ন খাতে বয়ে যায়। আশা পরিণত হয় হতাশায়।
● লিখনশৈলীঃ কোনো বই ভালোভাবে উপস্থাপন করার জন্য লেখক তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে বলেই আমার ধারণা। সে হিসেবে আব্দুল্লাহ শুভ্রকেও ব্যাতিক্রম মনে হয়নি। তবে তার উপস্থাপনা নিয়ে আরও কাজ করা উচিত। লেখার মাঝে কোনো নতুনত্ব পাইনি। মনগড়া অনেক বিষয় যেন চরিত্রের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এই বিষয়গুলো একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিকও বটে। পুরো লেখার কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যও খুঁজে পাইনি। প্রতিটা সংলাপই অতি সাধারণ মনে হয়েছে। কোথাও হুকড হবার ব্যবস্থা ছিলো বলে আমার মনে হয়নি।
● বর্ণনাশৈলীঃ বলা হয়ে থাকে, ❝থ্রিলারের প্রাণ টুইস্টে এবং সামাজিকের প্রাণ বর্ণনায়❞ খুব সাধারণ একটা কাহিনীও পাঠকমনে দাগ কেটে যায় চমৎকার বর্ণনায় আবার অনেক অসাধারণ কাহিনীও পাঠকমনে বিরক্তির উদ্রেক সৃষ্টি করে অবান্তর বর্ণনার দরুন। ❛নীল ফড়িং❜ - বইটা পড়ার সময় দ্বিতীয় অনুভূতিটা বেশি হয়েছে। কিছু কিছু স্থানে প্রয়োজনের অধিক অবান্তর বর্ণনা দিয়ে ভরিয়ে তোলা হয়েছে। অথচ যেখানে বর্ণনার প্রয়োজন ছিলো সেখানে বর্ণনা অনুপস্থিত। তবে গ্রামীণ পরিবেশের কিছু বর্ণনা বেশ ভালো লেগেছে। মাঝে মাঝে জীবন্ত মনে হচ্ছিলো লেখাগুলো। তবে হঠাৎই আবার খাপছাড়া ভাবটাও চলে এসেছে। লেখক চাইলেই এই বইটাকে আরও ছোট করতে পারতেন।
● চরিত্রায়নঃ ❝নীল ফড়িং❞ বইয়ে অনেক চরিত্র থাকলেও আলোচনা করার মতো চরিত্র হাতেগোনা কয়েকটা। নাফিলা, সাবের, মাখন, একলাছ সাহেব, লক্ষি বৌদিকে আলোচনা করা যায় বলে আমার মনে হয়েছে:
নাফিলাঃ বইয়ের কেন্দ্রীয় এবং প্রধান চরিত্র নাফিলা। শুরুতেই লেখক মশাই নাফিলাকে বেশ ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন চরিত্র হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে আগিয়েছে তাতে নাফিলাকে খুবই দূর্বল ব্যাক্তিত্বের মানুষ মনে হয়েছে। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষ হয়েও নাফিলা কীভাবে মাত্র এক দেখায় সাবেরের প্রেমে পড়েছে তার কোনো সৎ ব্যাখ্যা লেখক দিতে পারেননি। লেখকের কথা আমার বারবার সাংঘর্ষিক মনে হয়েছে।
সাবেরঃ সাবের চরিত্রটাকে লেখক সবচেয়ে বাজে ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক সাহেব। যে সময়ের ঘটনা উপস্থাপন করেছে লেখক সেসময়ে প্রেমিক তার প্রেমিকার বাড়িতে যাওয়াতো দূরের কথা বাইরেও যখন কথা বলত তখন দশ হাত দূরত্বে থেকে কথা বলত। অথচ সাবের নামের চরিত্রটা সাজ সকালে নাফিলার বাসায় উপস্থিত। অথচ সে ঢাবির একজন স্টুডেন্ট। সময় এবং কাজের মাঝে কেমন সাংঘর্ষিক উপস্থাপনা।
মাখনঃ বইয়ের সবচেয়ে নেগেটিভ যে চরিত্রটি রয়েছে সেটি হচ্ছে মাখনের চরিত্র। পুরো বই জুড়ে মাখনের বিস্তার ছিলো। এমনকি তার কারণেই সাবের, নাফিলার জীবনে এত ভোগান্তি। বেশ নাটুকে মনে হলেও, একটা নেগেটিভ চরিত্রের মধ্যে যা যা উপকরণ লাগে সবকিছুই ঢেলে দিয়েছেন লেখক মাখনের মধ্যে। অবশেষে নিজেকে নিজে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে মাখন চরিত্রের অবসান ঘটে।
একলাছ সাহেবঃ একলাছ সাহেব সাহেব বেশ দূর্বল চিত্তের মানুষ। তার কাছে নিজের মেয়ের চেয়ে সম্মান বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এতে তার মেয়েকে বলির পাঠা বানাতে হলেও তাতে সমস্যা নেই।
লক্ষী বৌদি: রাগ, জেদ এসব যে একটা মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহারণ এই চরিত্র। নাফিলা আর সাবেরের আলাদা হয়ে যাওয়ার আরও একটি বড় কারণ এই লক্ষী বৌদি। যদিও পরবর্তীতে তার কারণেই দুজন আবার এক হতে পারে।
বেলাল মাস্টারঃ এই চরিত্রটা বেশ ঘোলাটে। কখনো তার মধ্যে ভালো মানুষ বিরাজ করে আবার কখনো কখনো সেই ভিলেন হয়ে যায়। অসম বয়সে এসে ছাত্রী নাফিলার প্রেমে পড়ে সবকিছু জানা সত্ত্বেও হাতপা গুটিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় এনাকে। আবার উনিই শেষ মুহুর্তে ফোন দিয়ে সাবেরকে দেশে ফেরার কথা বলে।
● অবসানঃ নীল ফড়িং বইটার নাটকীয় একটা সমাপ্তি দেখানো হয়েছে। যেমনটা দেখা যায় বাংলা সিনেমাতে। মিলনান্তক একটা সমাপ্তি দেখানো হলেও আমার পাঠকমন মোটেও তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। গল্পের শুরুটা ভালো ভাবে হলেও শেষটা হতাশাজনক। সবচেয়ে বেশি বিরক্তির উদ্রেক করেছে ছোট্ট নাফিলার শেষ মুহুর্তে পুনরায় আবির্ভাব। কারণ লেখক শুরুটা প্যারানয়েড ওয়েতে শুরু করলেও পুরো বইয়ে সেইটা ধরে রাখেননি। আবার শেষ মুহুর্তে সেই বিষয়টি নিয়ে আসা কতটা যৌক্তিক তা আমি জানি না।
➣ খুচরা আলাপঃ সমকালীন বই থেকে আমি সাধারণত কোনো না কোনো মেসেজ খুঁজি। বইটা আমাদের কী শিক্ষা দিচ্ছে কিংবা বই থেকে আমি কী শিক্ষা পাচ্ছি তা নিয়ে ভাবায়। এ জন্য বেশ বেছে বেছে সমকালীন বই সংগ্রহ করা হয়। আর নিতান্ত বিনোদন এর জন্য বই পড়ার হলে থ্রিলার খুঁজি। তবে এই বইটাতে লেখক ঠিক কী মেসেজ দিতে চেয়েছে তা আমি ধরতে পারিনি। সে হিসেবে আমি আমার অপারগতা স্বীকার করে নিচ্ছি।
বইয়ের সংলাপে দূর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে বারংবার। মনে হয়েছে বাংলা সিনেমার সেই গৎবাঁধা সংলাপ তুলে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে বইয়ের মাঝে। অথচ আধুনিক সাহিত্যে এই সংলাপগুলোর প্রচলন উঠে গেছে বহু আগেই। যেকোনো সাধারণ পাঠকের বিরক্তির উদ্রেক হতে পারে সংলাপের কারণে।
বইয়ে বেশ কিছু মেডিক্যাল টার্ম আছে, এখান থেকে বেশ কিছু ইনফরমেশন পাওয়া গেলেও মনে হয়েছে বইয়ের সাথে জোর করে রিলেট করা হয়েছে এই টার্মগুলো।
জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয়। তবে এই বইয়ে যতটা নাটকীয় ভাবে সব উপস্থাপন করা হয়েছে তা বাস্তবতাকেও ছাড়িয়ে যাবে। এত এত কোইনসিডেন্স এক সাথে ঘটা কত টুকু সম্ভব তা ভাবার বিষয়। তাছাড়া কিছু কিছু বিষয়ের কোনো ব্যাখ্যাই ছিলো না। মনগড়া ভাবে তুলে দেয়া হয়েছে। আমি মনে করি লেখকের তার লেখার প্রতি আরও বেশি যত্নবান হওয়া উচিত।
➣ প্রচ্ছদ, অলংকরণ, নামলিপিঃ ❝first impression is the best impression❞
❝নীল ফড়িং❞ বইয়ের প্রচ্ছদ প্রথম দেখাতে ভালো লাগার মতো কোনো প্রচ্ছদ না। যেন কোনমতে দুচারটা ছবি একত্রিত করে প্রচ্ছদ বানিয়ে ফেলা হয়েছে। গ্রাফিক্স এর যোগে এমন সাদামাটা প্রচ্ছদ দেখা- যায় না। নামলিপিটাও আমার সাদামাটা মনে হয়েছে। নামলিপিতে সময় দিলে আরও ভালো কিছু করা সম্ভব হতো। অলংকরণ চোখে পরার মতো না। বইয়ের শোভা বর্ধনের জন্য অলংরণের প্রয়োজনীয়তা ছিলো ব্যাপক।
➣ সম্পাদনা এবং বানানঃ বইয়ের সম্পাদনা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে। ভালো কোনো সম্পাদক দিয়ে সম্পাদনা করালে হয়তো বইটার চেহারা পুরো পালটে যেত৷ অযাচিত যে সংলাপ ছিলো সেগুলো চাইলেই পরিবর্তন করে পাঠককে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে দিতে পারত। সংলাপ সাধারণত উদ্ধৃতি চিহ্ন এর ভিতর আবদ্ধ রাখা হয় যাতে পাঠক সহজেই সেটা ধরতে পারে। কিন্তু এই বইয়ে তা নেই। বর্ণনা আর সংলাপ একই মনে হয়েছে অনেক স্থানে। তাই একটু পরপরই বিরক্তির উদ্রেক হয়েছে। বানানেও বেশ কিছু ভুল চোখে পড়েছে।
➣ মলাট, বাঁধাই, পৃষ্ঠা, প্রোডাকশনঃ কবি প্রকাশনীর সকল বইয়ে ই প্রোডাকশন বেস্ট দেয়া হয়৷ পাঠক সব বইয়ের কন্সেপ্টে স্বস্থি না পেলেও প্রোডাকশনে সন্তুষ্ট। বিশেষ করে বাঁধাই ছিলো চমৎকার। অনায়েসে এই বই বেশ কয়েকবার পড়তে পারবে বাঁধাইয়ের কোনো সমস্যা হবে না। আর মলাট ছিলো পুরাই মাখন। পৃষ্ঠাও যথেষ্ট ভালো সম্ভবত আশি জিএসএম পেপার ব্যবহার করা হয়েছে। লাইন গ্যাপ এবং ফন্ট স্পেস বইটাকে পড়তে আরো আরাম দেয়। নীল ফড়িং এর কন্সেপ্ট নিয়ে আমার অভিযোগ থাকলেও নইয়ের প্রোডাকশন নিয়ে আমি সন্তুষ্ট।
টানা গরমে কোনোকিছুতে মন বসছিল না। তারপর এক মেঘলা বিকেলে যখন ঠাণ্ডা বাতাস ছাড়ল, অমনি এককাপ চা নিয়ে বসে পড়লাম। সঙ্গী হলো “নীল ফড়িং”। এরপর শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি, প্রচণ্ড ঝড়। আমি ফ্ল্যাপের লেখাটি পড়লাম। খানিক রহস্য, খানিক অতিপ্রাকৃত ঘটনার বিবরণ আকৃষ্ট করল বেশ। বইটি পড়া শুরু করলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর ঝড় থামল, বৃষ্টি কমলো, কাপের গরম চা-ও ঠাণ্ডা হয়ে গেল। কিন্তু আমার পড়া শেষ হলো না। বইয়ের যে কলেবর এবং আমার পড়ার যে গতি, তাতে বইটা দুই থেকে তিনদিনে শেষ হবার কথা। অথচ সময় লাগলো মোট ৮ দিন! কী ছিল বইয়ে, কেমন ছিল পাঠ অভিজ্ঞতা, বিস্তারিত জানানোর চেষ্টা করব।
কাহিনি সম্পর্কে সংক্ষেপে বলা যাক। ১৯৯৯ সালের প্রেক্ষাপট। ডিসেম্বরের এক শীতের রাত। ঢাকার অদূরে ঝলমলিয়া গ্রামের একটি চায়ের দোকান থেকে গল্পের শুরু। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার একলাছ সাহেব স্থানীয় চায়ের দোকানকার মতি মিয়ার সঙ্গে খোশগল্পে মশগুল। এমন সময় লাল ফ্রক পরা এক রহস্যময় ছোট্ট বালিকা উপস্থিত হয়, সেইসাথে কিছু নীল ফড়িং। বালিকা তার পরিচয়ে যে বর্ণনা দিল, তাতে একলাছ সাহেব ঘাবড়ে যান। কেননা সেই হিসাবে বালিকাটি তারই কন্যা হবার কথা।
অদ্ভুত এই ঘটনায় মতি মিয়া সতর্কবাণী শোনান, ইতোমধ্যে এমন ঘটনা আরও কয়েকবার ঘটেছে। আর যাদের সঙ্গে এমনটা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের জীবনেই বড় দুর্ঘটনা নেমে এসেছে। অলৌকিক ও রহস্যময় এ বিষয়টিতে ভয় পেয়ে যান একলাছ সাহেব। অজানা আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেন।
কাহিনি এগিয়ে গেলে আমরা দেখতে পারি, স্ত্রী তাহেরুন্নেছা এবং এসএসসি পরীক্ষার্থী একমাত্র মেয়ে নাফিলাকে নিয়ে ধর্মভীরু মানুষ একলাছ সাহেবের সুখের সংসার। তার পরিবারের আরও একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শ্যালিকা জেবুন্নেছা। এলাকার মেধাবী ছেলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাবেরের সঙ্গে নাফিলার একসময় প্রণয়ঘটিত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এখান থেকে গল্পের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের শুরু। সাবেরের বন্ধু, স্থানীয় চেয়ারম্যানের একমাত্র পুত্র মাখন এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারে না। নাফিলাকে নিজের করে নিতে সে বদ্ধপরিকর। এজন্য সে যেকোনো পর্যায়ে যেতে রাজি।
অপরদিকে গৃহশিক্ষক বেলাল মাস্টারও নাফিলাকে ভালোবাসতে শুরু করে। সাবের, নাফিলা, মাখন ও বেলালের চাওয়া-পাওয়া, প্রেম-ভালোবাসার পৃথক টানাপোড়েনের গল্পে এগিয়ে যায় উপন্যাস। ক্ষেত্রবিশেষে এবং কাহিনির প্রয়োজনে একাধিক চরিত্রের সন্নিবেশ দেখা যায়। এদের মধ্যে প্রবাসী ব্যক্তির স্ত্রী লক্ষ্মী ভাবি ও ঘটক তোতা মিয়া অন্যতম চরিত্র। উপন্যাসের গল্পটি যখন নাটকীয়ভাবে এগুতে থাকে, দেখা যায় ক্ষোভ ও অভিমান নিয়ে সাবের বিদেশে পাড়ি জমায়। মাখন মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে এবং নাফিলা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। সাবের ও নাফিলার ভাগ্যে কী আছে? নাফিলা কি বেঁচে থাকবে? শেষ মুহূর্তে আবারও একটি নীল ফড়িং ও ছোট্ট সেই রহস্যময় বালিকার আবির্ভাব ঘটে। এরপর কী হয়? এসকল জটের সমাধান মিলবে উপন্যাসের পাতায়।
স্টেরিওটাইপ বা বাঁধাধরা ধরনের এই উপন্যাসে গল্প পাওয়া গেলেও তাতে গভীরতার অভাব লক্ষণীয়। পড়ার সময় মনে হয়েছে যেন অনেকগুলো বিক্ষিপ্ত ঘটনাকে একত্রিত করা হয়েছে। সফলভাবে দৃশ্য তৈরি করা হলেও কোনো দৃশ্যের সঙ্গে নিজের পাঠক সত্তার সংযোগ স্থাপন করতে পারছিলাম না। আবার হৃদয়ে দাগ ফেলে, মনে থাকবে এমন ঘটনা খুঁজে পেতেও ব্যর্থ হয়েছি।
বইয়ের মূল চরিত্র হিসেবে পাঁচটি নামকে প্রাধান্য দেওয়া যায়- একলাছ সাহেব, নাফিলা, সাবের, মাখন এবং বেলাল মাস্টার। বাকি চরিত্রগুলো সহায়ক ভূমিকা রাখলেও তা বিকশিত হতে পারেনি। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, চরিত্রায়নে দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। স্বভাব-বৈশিষ্ট্যের দুর্বল গাঁথুনি, সেইসাথে স্বভাব-বিরুদ্ধ সাংঘর্ষিক কর্মকাণ্ড ভীষণরকম চোখে লাগে। যার কারণে একটিবারের জন্যেও কোনো চরিত্রের জন্য অনুভূতি তৈরি হয়নি। অথচ বইয়ের যে দীর্ঘ কলেবর, চাইলেই তা সময় নিয়ে সংশোধন করার সুযোগ ছিল।
উপন্যাসটিকে অতিপ্রাকৃত ও ভৌতিক জনরাতে ধরা হয়েছে। অথচ বইটিতে ভৌতিকের তেমন কোনো উপকরণ নেই। সামাজিক কুসংস্কার, জিন প্রসঙ্গ ও ধর্মের বেশকিছু আলোচনা থাকলেও তা অতটা প্রভাব তৈরি করে না। আবার অতিপ্রাকৃতের যতটুকু অংশবিশেষ রয়েছে তাও যথেষ্ট নয়, সামান্য মাত্র। তাই বইটিকে মোটামুটি সামাজিক উপন্যাস হিসেবে ধরা যায়।
বইটির লেখনশৈলী নিয়ে আলাপের পূর্বে উপন্যাসে থাকা কিছু অসঙ্গতির প্রতি আলোকপাত করতে চাই। এমনিতে প্রশ্ন ও দ্বিধা তৈরি হয় এমন অসংখ্য মুহূর্ত থাকলেও তা নজর এড়িয়ে গেছি। কিন্তু নিম্নোক্ত বিষয়গুলো কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
ক) ১৫ পৃষ্ঠায় দেখা যায়, একলাছ সাহেব দরজা বন্ধ করে ঘুমালেন। তার শ্যালিকা জেবুন্নেছা দরজা ধাক্কিয়েও খুলতে পারেন না। অথচ একলাছ সাহেব ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার মেয়ে নাফিলা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এমনকি চা-বিস্কুটও এনে দেয়। এটা কীভাবে সম্ভব? বন্ধ দরজা দিয়ে সে ঘরে ঢুকলো কীভাবে?
খ) ৬৪ আর ৭৭ পৃষ্ঠায় ক্লেপ্টোম্যানিয়া রোগের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা যেন জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া। সাবের ও বেলাল এ দু’টি চরিত্রের মাধ্যমে একই ধরণের বিশ্লেষণ অনেকটা দায়সারা ভাবের প্রকাশ করে।
গ) ৮০ পৃষ্ঠায় নাফিলার প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশের জন্য দীর্ঘ বর্ণনা দ্বারা বেলালের চরিত্রটি উপস্থাপন করা হয়। অথচ কান্নারত মেয়েটিকে সান্ত্বনা দেওয়ার মুহূর্তে সেই বেলালের ভাবনার একটি লাইন ছিল এমন- ‘আজ রাতেই যদি নাফিলার সঙ্গে বাসর হয়ে যেত!’ এরকম অপ্রাসঙ্গিক একটি বাক্যের মর্মার্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
ঘ) ৯৪ পৃষ্ঠায় নাফিলাকে বিভ্রান্ত করতে লক্ষ্মী তার স্বামীকে শুনিয়ে শুনিয়ে সাবেরকে নিয়ে যে ধরনের কথা বলে, তা একইসাথে অশোভন এবং অতিরঞ্জিত। যৌক্তিকভাবে চিন্তা করলে, কোনো স্ত্রী’ই তার স্বামীর নিকট পরপুরুষকে নিয়ে এ ধরনের কথা বলতে পারে না। আর স্বামীর পক্ষে তাতে হাসিমুখে সায় দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।
ঙ) ১০৩ পৃষ্ঠায় সাবেরকে কখনো প্রেমিক বা কামনার দৃষ্টিতে দেখে লক্ষ্মী, পর মুহূর্তেই নিজের মায়ের পেটের ভাই হিসেবে বিবেচনা করে। আবার একই পাতায় সাবেরকে শারীরিকভাবে কুপোকাত করার কথাও ভাবে। এখানে আসলে হচ্ছেটা কী, বক্তব্যের সঠিক কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই।
চ) ১০৫ পৃষ্ঠার এক অনুচ্ছেদে হঠাৎ করেই সম্বোধনে পরিবর্তন দেখা যায়। সাবেরকে তুমি করে বলে লক্ষ্মী। এখানে সে তুই সম্বোধনে বেশকিছু বাক্য বলে। এটা হয়তো সম্পাদনার সময় সম্পাদকের নজর এড়িয়ে গেছে। পরবর্তীতে দেখা যায় পরিচয়ের দ্বিতীয় দফা সাক্ষাতে সাবেরকে ৫০ হাজার টাকা ধার দেয় লক্ষ্মী। এটাও বেশ অতিরঞ্জিত লেগেছে।
ছ) ১১০ পৃষ্ঠায় একটি জায়গায় ভুলবশত সাবেরের বদলে মাখনের নাম উল্লেখ করে গল্প টানা হয়েছে। ঐ অংশটুকু বেশ বিভ্রান্তিকর।
জ) যে অলৌকিক ঘটনার সূত্র দ্বারা কাহিনি সুগঠিত হতে পারতো, সেটাই প্রথম ১২ পৃষ্ঠার পর হুট করে গায়েব হয়ে যায়। যার দ্বিতীয় উপস্থিতি মেলে ১০০ পৃষ্ঠার শেষে ১১১তম পৃষ্ঠায়। এখানে একলাছ সাহেবের সাথে বেলাল মাস্টারের টানা জেরা পর্ব চলার পর ধারণা করা হয়, একলাছ সাহেব সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত। এ রোগে মানুষের হ্যালুনিসেশন বা দৃষ্টিভ্রম হয়। ব্যস, এ পর্যন্তই। এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা, যুক্তি, সূত্রপাতের কারণ; কোনোটার সঠিক জবাব আর পাওয়া যায় না।
ঝ) ১৯৯৯ সালের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাসে ১৪৬ পৃষ্ঠায় এসে দেখা যায়, সাবের গাউসুল আজম মার্কেটের একটি সাইবার ক্যাফেতে বসে সুইডেনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের খোঁজ নিতে থাকে। অথচ নেট থেকে পাওয়া তথ্যমতে- বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সাইবার ক্যাফে সেবা চালু হয় বনানীতে, ১৯৯৯ সালে। গ্রামে বেড়ে ওঠা সাবেরের পক্ষে এত স্বল্প সময়ে কম্পিউটার, ইন্টারনেট সেবা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ কীভাবে সম্ভব, তা বোধগম্য নয়।
ঞ) ১৬৪ ও ১৬৫ নম্বর পৃষ্ঠায় নাফিলা ও বেলালের কথোপকথন যতটা আধ্যাত্মিক, ঠিক ততটাই বোধগম্যের বাইরে। ওইটুকুন অল্প বয়সের মেয়ে, যে কি-না এসএসসি পরীক্ষার্থী; বেলাল মাস্টারের অমন দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক কথার কীই-বা বুঝলো আর সেই-বা কী ধরনের উত্তর দিল, তা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়। এটাকে স্রেফ হেঁয়ালি কিংবা রহস্য হিসেবে ধরারও সুযোগ নেই।
এতগুলো অসঙ্গতি তোলার কারণ হলো- বইটির যদি নতুন সংস্করণ আসে, তাহলে বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেওয়ার অনুরোধ থাকবে। অবশ্য সংশোধনের পরিমাণ অনেক বেশিই। তবুও কিছু জিনিস পরিবর্তন করা বাঞ্ছনীয়।
এই বইয়ের গল্প বলার ঢং এবং উপস্থাপনা সবকিছুই ধীরগতির। শুধুমাত্র অধ্যায় ছয়-এ যখন মাখনের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সাবেরকে গ্রেফতার করে পুলিশ, এই অংশের গল্পের গতি ঠিকঠাক ছিল। এছাড়া কাহিনির এক পর্যায়ে সাবের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ভুল বোঝাবুঝির অবসানে নাফিলার সঙ্গে ফোনে কথা বলবে। কিন্তু দেখা করবে না। সেই সাবেরই পরবর্তীতে নাফিলাকে চিঠি লিখলো, ফোন করল না কিংবা দেখাও করল না। আর চিঠি কার হাতে দিল? তার গৃহশিক্ষক বেলালের হাতে। এই যে জোরপূর্বক একটা ট্র্যাজেডি আনার চেষ্টা, এটা অত্যন্ত দুর্বল লেগেছে।
বইয়ের সর্বশেষ অধ্যায়ে এত পরিমাণ ঘটনার সন্নিবেশ করা হয়েছে, যা হজম করতে কষ্টই হয়েছে। বিশেষ করে একের পর এক মেলোড্রামা এবং কাকতালীয় ঘটনার যোগসূত্র স্থাপন করা হয়েছে, একইসাথে অবিশ্বাস্য ও অতিরঞ্জিত মনে হয়। নাফিলার বিয়ে, মাখনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা, নাফিলার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা, ভিনদেশের মাটিতে সাবেরের সঙ্গে লক্ষ্মীর আকস্মিক দেখা হওয়া, বেলাল চরিত্রের মাঝে হুট করেই আমূল পরিবর্তন, সাবের ও নাফিলার পুনর্মিলণের দৃশ্যটি... এককথায়- অতি নাটকীয়। এমন অনেক ব্যাপার রয়েছে যার পূর্ণ ব্যাখ্যাও নেই। অবশ্য বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখক বলেই দিয়েছেন- ‘সবকিছুর ব্যাখ্যা হয় না- ব্যাখ্যা খুঁজতে নেই!’
এবার আসি লেখনশৈলী প্রসঙ্গে। লেখকের গল্পের ভাষা সাবলীল থাকলেও উপস্থাপনায় বৈচিত্র নেই, বরং গদবাঁধা। পুরো উপন্যাসজুড়ে অসংখ্য ইংরেজি শব্দের ব্যবহার রীতিমতো দৃষ্টিকটু লেগেছে। চাইলে সেসকল শব্দের অনেকগুলোর বাংলা রূপ বা অর্থ ব্যবহার করা যেত। বইয়ে জোরপূর্বক এবং মনগড়া বেশকিছু দর্শনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে একে-অপরের সাংঘর্ষিক হিসেবেও পরীলক্ষিত হয়েছে। গল্প কখন কোনদিকে মোড় নিচ্ছে, উপস্থিত চরিত্রদের কথোপকথন, তাদের উদ্দেশ্য; কোনোকিছুই স্পষ্ট নয়। কোনো অর্থও দাঁড় করাতে পারে না। যত্নের অভাব যেমন লক্ষণীয়, তেমনি মনে হয়েছে- যেন লেখায় তাড়াহুড়ো ছিল। নাফিলার সাথে সাবেরের টেলিফোনে কথোপকথন, নাফিলার উদ্দেশ্যে লেখা সাবেরের চিঠি, বেলাল মাস্টারের কথোপকথন, সবই যেন কবিতার আদলে লেখা। এমনকি বইয়ের যে সেটাপ, সেটা দেখতেও অবিকল কবিতার মতোই। যা পড়তে গিয়ে ছন্দপতন হয়েছে।
সম্পাদনা ও বইয়ের প্রোডাকশন নিয়ে বড় ধরনের অভিযোগ আছে আমার। এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, উপন্যাসটিতে সম্পাদনার বড় অভাব ছিল। বিরামচিহ্ন, যতিচিহ্নের কমতি বেশ ভুগিয়েছে। সেইসাথে অতিরিক্ত বর্ণনা, অপ্রাসঙ্গিক শব্দ কমানোর সুযোগ ছিল। চাইলে চরিত্রের নাম, বাক্যের মধ্যকার দূরত্ব, সংলাপ, এককথায় বইয়ের সেটিংয়ের সময় স্পেস আরও কমানো যেত। ২১৬ পৃষ্ঠা বা সাড়ে ১৩ ফর্মার বইটিকে অনায়াসে ১৭৬ পৃষ্ঠার মধ্যে এনে বইয়ের খরচও কমানো যেত। যে গল্প-কাহিনিতে উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে, সঠিক সম্পাদনা করা গেলে হয়তো এটি ১১২-১২৮ পৃষ্ঠার একটি বই হতে পারতো। অল্প শব্দ-বাক্যে আরও বেশি ঝরঝরে ও পাঠ উপযোগি হতো এটি।
লেখকের পড়া এটাই আমার প্রথম বই। সার্বিক বিচারে এতটুকু বলতে পারি- লেখক গল্প বলতে ভালোবাসেন। চরিত্রের দ্বারা ঘটনার সৃষ্টি এবং চেষ্টা করেন সাবলীল ভঙ্গিমায় গল্প বলে যেতে। যা দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়তে হয়। তবে প্রসঙ্গ যখন “নীল ফড়িং”, এই বইয়ের গল্প-কাহিনি, চরিত্র; বিশেষ করে কাহিনিতে বর্ণিত ছোট ছোট ঘটনাসমূহ কোনোটাই একদম নতুন নয়। ইতোপূর্বে অসংখ্য সিনেমায়, গল্প-উপন্যাসের বইতে তা নানাভাবে অসংখ্যবার উঠে এসেছে। যারা সামাজিক প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস পড়তে পছন্দ করেন, তারা পড়তে পারেন বইটি। .
বইয়ের নাম: নীল ফড়িং লেখক: আব্দুল্লাহ শুভ্র প্রকাশনী: কবি প্রকাশনী প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ জনরা: অতিপ্রাকৃত ও ভৌতিক পৃষ্ঠা সংখ্যা:২১৬ মুদ্রিত মূল্য:৩৭৫টাকা
সাবের বলতে শুরু করে, তুমি বেঁচে থাকবে শুধু আমারই জন্য, জ্বলজ্বলে তারাগুলো সে কথাই আমাকে বলে যায়! নাফিলা কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে একটা উত্তর দেয়--- জ্বলেজ্বলে তারাগুলো অন্ততকাল পর্যন্ত জ্বলতেই থাকবে!আমিও অন্ততকাল তোমারই থাকব!
আচ্ছা যে বইটার বেশিরভাগ বাক্যই এমন রোমান্টিক সংলাপে ভরপুর সেই বইটার জনরা অতিপ্রাকৃত ও ভৌতিক কেন দেওয়া হলো!বইটি নিয়ে প্রথমে কিছুটা আলোচনা করা যাক। তারপর না হয় আমরা সিদ্ধান্ত নেবো কেন এ জনরা নির্ধারণ করা হলো।
১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাস।ঝলমলিয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার একলাছ সাহেব মতি মিয়ার চায়ের দোকানে বসে গল্প করেন।হঠাৎ করেই লাল রঙের ফ্রক পরা ফুটফুটে মেয়ের আবির্ভাব ঘটে।মেয়েটি তার পরিচয় দিলে একলাছ সাহেব স্তব্ধ হয়ে যান। সেদিন উনি বাসায় ফিরে এশার নামাজ আদায় করার পর আরো দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। তার মেয়ে নাফিলা, স্ত্রী তাহেরুন্নেছা কে নিয়ে সুখের সংসার। মাঝে মাঝে শালী জেবুন্নেছার আগমন ঘটে বাড়িতে।মসজিদে একদিন একলাছ সাহেবের নতুন কেনা পাম্প সু হারিয়ে গেলে মসজিদের ক্যাশিয়ার মকবুলের সাথে কথার মনোমালিন্য হয়। মকবুলের ছেলে সাবের ও গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যানের ছেলে মাখনের ভালো বন্ধুত্ব।দশম শ্রেণী পড়ুয়া নাফিলাকে ইংরেজি পড়ানোর জন্য প্রথমে সাবেরকে ঠিক করা হলেও তার বাবার দ্বিমতে বেলাল স্যারকে ঠিক করা হয়।সুন্দরী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নাফিলাকে পছন্দ করে একই গ্রামের বেলাল স্যার,সাবের ও মাখন।নাফিলা সাবেরকে পছন্দ করে এ বিষয়টা মাখন জেনে গেলে চেয়ারম্যানের ছেলে হওয়ায় বাবার প্রভাব খাটিয়ে সাবেরকে গ্রামছাড়া করে এবং শেষে নাফিলাকে বিয়ে করার জন্য উঠে পড়ে লাগে।বাবার ক্যান্সার ধরা পড়লে সাবের অনেকটা ভেঙে পড়ে চিকিৎসার টাকা কিভাবে ম্যানেজ করবে সে কথা ভেবে।তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে লক্ষী।লক্ষীর সাথে সাবেরের সখ্যতা ও মাখনের ষড়যন্ত্র সবকিছু একত্রিত হয়ে সাবেরকে নাফিলার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যায়। এদিকে বাবার মৃত্যুর পর সাবের পড়াশোনা করতে বিদেশ চলে যায়।মাখন নাফিলাকে পছন্দ করার পরও মদ খেয়ে ফূর্তিবাজি করে বেড়ায়।এটাই তার জীবনে কাল হয়ে তাকে শেষ করে ফেলে।শেষ অবধি ছোট্ট নাফিলার সহায়তায় সাবের ও নাফিলার প্রেম পূর্ণতা পায়।সেটা কীভাবে! জানতে হলে পড়তে হবে বইটি।
🌒পাঠ প্রতিক্রিয়া:- লেখক প্রকৃতির যে অপরূপ সৌন্দর্য বইয়ে তুলে ধরেছেন তা সত্যিকার অর্থেই প্রশংসনীয়।গ্রামের নাম থেকে শুরু করে শীতকালীন প্রকৃতির বর্ণনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এছাড়া বিজ্ঞান ও রোগ বিষয়ক বিভিন্ন আলোচনা যেমন সুপারনোভা, কালপুরুষ,ক্লেপ্টোম্যানিয়া সম্পর্কিত ছোট ছোট আলোচনাগুলো আমার ভাল লেগেছে।বইটা পড়ার সময় লেখক কিছুটা কমেডিয়ানভাবে যে মাখন ও তোতা মিয়া কে উপস্থাপনা করেছেন তাতে মাঝে মাঝে হেসেছি একই সাথে নাফিলার মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বিশেষ করে লক্ষ্মীর প্রতি যে আচরণ করেছিল তাতে রাগ হয়েছিল। বইটিতে মোট দশটি পর্ব আছে। পড়ার সময় মনে হয়েছে লেখক খুব তাড়াহুড়ো করে বইটি লিখেছেন।দুই থেকে পাঁচ পর্বটির মধ্যে চরিত্র গুলো আরো ভালভাবে ডেভেলপ করা যেতো বইয়ের কাহিনীটি লেখার সময় যদি আর একটু ভেবে চিন্তে লিখতেন তবে আমার মতে ভাল হতো। গ্রামীণ জীবন ও এ জীবনে চেয়ারম্যানের প্রভাবে সাবের ও নাফিলার জীবন বিশেষ করে সাবেরের জীবন যে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে তা লেখার মাধ্যমে লেখক ঠিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ক্ষমতার দাপটে চাইলেই কিছু করতে পারে তা বেশ ভালভাবে তুলে ধরেছেন।পরিবার ও নিজের মেয়ের প্রতি দায়িত্ব ও বিশ্বাসের চিত্র একলাছ সাহেব চরিত্রকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন তার লেখনীর মাধ্যমে।এ ধারায় ব্যতিক্রম নন মা তাহেরুন্নেছা ও খালা জেবুন্নেছা।এছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সকল চড়াই উতরাই পেরিয়ে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সাবেরের মাধ্যমে দেওয়া বার্তাটির জন্য লেখককে ধন্যবাদ দিতেই হয়। ব্যতিক্রম নয় নাফিলাও।কিন্তু যথোপযুক্ত শব্দ চয়ন ও বাক্যের আলাপে তুলে ধরতে লেখক এখানে ব্যর্থ হয়েছেন আমার দৃষ্টিতে। তবে চরিত্রগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা গুলো তুলে ধরার প্রয়াস ভাল লেগেছে।এছাড়াও সাবের ও নাফিলার আবেগ-ভালবাসা কে কেন্দ্র করে লেখা বাক্যগুলোর বিশ্লেষণ ভাল ছিল।
🌒চরিত্র বিশ্লেষণ:-
➡একলাছ সাহেব: পুরো বইটি জুড়ে তার অবস্থান ছিল একজন দায়িত্বশীল বাবার মত। মেয়ের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও তার সহজ সরল ব্যক্তিত্ব লেখক তার লেখনীর মাধ্যমে খুব সুন্দর করে তুলে ধরেছেন। মেয়েদের জীবনে সব থেকে বেশি দরকার সার্পোট যেটা নাফিলা তার বাবা একলাছ সাহেব থেকে পেয়েছেন।
➡তাহেরুন্নেছা ও জেবুন্নেছা: এ দুটি চরিত্রের উপস্থিতি কম ছিল। শেষের দিকে তাহেরুন্নেছার সরস উপস্থিতি ছিল। তবে জেবুন্নেছা চরিত্রও কম যায় না।খালা ও বন্ধু হিসেবে নাফিলার হতাশার সময় তাকে উৎসাহ ও সাহস প্রদান করার মাধ্যমে প্রধান চরিত্রে তাকে দাঁড় করানো হলে ভুল হবে না।
➡সাবের: এ চরিত্রটি আমার ভাল লেগেছে।সাবেরের মাধ্যমে বর্তমানে আমাদের জেনারেশন কে উৎসর্গ করে হতাশায় নিমজ্জিত না হয়ে সাবেরের মত ধৈর্যশীল হয়ে যুদ্ধ করে নিজের স্বপ্নটাকে পূরণ করার ব্যাপারটা তুলে ধরতে লেখক স্বার্থক। আমার মনে হয় আমাদের জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে সাবেরর মত ধৈর্যশীল হওয়া উচিত।
➡নাফিলা : একই নামে বইয়ে দুটো চরিত্র আছে। বড় নাফিলা ও ছোট্ট নাফিলা। নাফিলা সাবের ও বেলালের চোখে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হলেও লেখকের শব্দে তা আমি বুঝতে পারিনি। তবে তার যুক্তিসঙ্গত উত্তর প্রদান লেখক ভালভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আর ছোট নাফিলা কে কেন্দ্র করেই হয়তবা লেখক বইয়ের জনরা অতিপ্রাকৃত ও ভৌতিক দিয়েছেন।এই চরিত্র কে আরো কিছু পৃষ্ঠায় বন্দী করলে বইয়ের জনরা স্বার্থক হতো।
➡মাখন: ভিলেন চরিত্র হিসেবে লেখক মাখনকে বেশ ভালভা।এ উপস্থাপন করেছেন। দাঁতের বাক্স নামটি তার জন্য যথার্থ।তবে তার বেশ কিছু কাজ একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে।নাফিলাকে পছন্দ করার পরও হোটেলে মেয়েদেরকে নিয়ে ফূর্তি করেছে।
➡লক্ষ্মী: প্রথম প্রথম এই চরিত্রকে চরিত্রহীন লেগেছিল পরে ভেবে দেখেছি মানুষ নিঃসঙ্গ অবস্থায় থাকলে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে যেখানে কীভাবে মনের আদালতে নিজের বিরুদ্ধে রায় দিতে হয় বুঝতে পারে না। তবে সাবেরকে সাহায্য করার ব্যাপারটা ভাল লেগেছে।
➡তোতা মিয়া: যাকে ঝলমলিয়া গ্রামের মানুষ রেডিও বলে ডাকে।লেখকের শব্দে এ চরিত্রটি ঘটকের পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।ঘটকরা যেমন লোভী হয় তোতা মিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়।
➡মতি মিয়া: যার চরিত্র আমার কাছে কিছুটা ধোয়াশা।ছোট্ট নাফিলা সম্পর্কে এত কিছু সে কিভাবে জানে বা একলাছ সাহেব কে নিয়ে বলা তার কিছু ভবিষ্যতবাণী এবং শেষে হুট করেই অন্য কোথাও চলে যাওয়া কেমন জানি জমে নাই।
➡চেয়ারম্যান : গ্রামের চেয়ারম্যানের চরিত্র যেভাবে লেখক চিত্রায়ণ করেছেন তা যথার্থ মনে হয়েছে।প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দিনকে যে রাত করতে পারেন তারই প্রতিচ্ছবি চেয়ারম্যান।
➡বেলাল স্যার: বেলাল স্যার যেন আজকাল অধিকাংশ গৃহশিক্ষকের প্রতিচ্ছবি।১৩/১৪ বছরের মেয়েকে তার নিশ্চয়ই প্রেমিকার চোখে দেখা ঠিক হয়নি।
➡মোনায়েম সাহেব: লেখক ২১৬ পেজের একটা বইত অনেকগুলো চরিত্র এনেছেন। তার মধ্যে অভিভাবকদের জন্য বিশেষ করে যাদের বাসায় হোম টিউটর আছে তাদের জন্য এ চরিত্রটা থেকে কিছু শিক্ষণীয় দিক আছে। এই যে মোনায়েম সাহেব নিঃস্বার্থভাবে সাবেরকে সাহায্য করেছেন তার বাবার চিকিৎসার সময় বা তাকে যখন থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এই ছোট্ট ছোট্ট সাহায্য গুলো সাবেরকে তার জীবনের প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে প্রভাবকের মত কাজ করেছে।
এছাড়াও মকবুল সাহেব,হৃদী,দেবদুলাল,সাবেরের মা,রবিন ইত্যাদি আরো কিছু চরিত্রের উপস্থিতি খুব স্বল্প পরিসরে ছিল।
🌒প্রিয় চরিত্র:- একলাছ সাহেব, মোনায়েম সাহেব ও সাবের।
🌒বইটির যে বিষয়গুলো ভাল লাগে নি:- ১.প্রথমত বইটির জনরা নিয়ে কিছুটা দ্বিধা কাজ করছে পড়া শেষে। লাল ফ্রক পরা নাফিলা ও মতি মিয়াকে কেন্দ্র করেই কি লেখক এ জনরায় ফেলেছেন কি!! ২.বইয়ের কিছু বাক্য বা কথোপকথন ভাল লাগে নি।অপরিপক্ক লেগেছে। যেমন: জেবুন্নেছার এখন বয়স প্রায় ত্রিশ। বিয়ে খোজা হচ্ছে। পাত্র খোজা হয় বিয়ে খোজা হয় ব্যাপারটা যায়নি আমার কাছে। এছাড়াও প্রথমদিকে একলাছ ও মতি মিয়ার কথোপকথন আছে। ভাইসাহেব,এত সুন্দর মাফলারটা কে দিয়েছেন?একলাছ সাহেব বলে ওঠেন-মতি মিয়া মুরুব্বিদের সাথে ইতরামি করতে নাই। আমার বোধগম্য হয়নি এখানে ইতরামি ব্যাপারটা কি। এরকম বেশ কিছু লাইন আছে।লিখতে গেলে বড় হয়ে যাবে। ৩.ছোট্ট ও বড় নাফিলার চরিত্র ডেভেলপমেন্টটা ভাল লাগে নি।ছোট্ট নাফিলা কে কেন্দ্র করে অতিপ্রাকৃত ব্যাপারটা আরো গভীরভাবে লেখা উচিত ছিল। ৪.নাফিলা ও সাবেরর একে অন্যের প্রতি ভালোবাসার সময়গুলো নিয়ে বিস্তারিত লেখা উচিত ছিল। পার্কে দেখা করার পর থেকেই তাদের প্রেম ঘটিত ভালবাসায় বিচ্ছেদ ঘটে যায়।লেখায় তাদের দুজনের যে আবেগ তুলে ধরা হয়েছে সেই হিসেবে প্রতিফলন সাইডটা মিসিং। ৫.বইটির অধিকাংশ লাইন কবিতার মত করে লেখা হয়েছে যেটা ভাল লাগেনি।
🌒প্রচ্ছদ:- ক্যাম্পাসে একদিন বইটা আমার হাতে দেখে অনেকে প্রচ্ছদ দেখে বলেছিল এটা কী ভূতের বই?আমি জবাবে বলেছিলাম ঐরকম কিছু না। জনরা অতিপ্রাকৃত। তো র্যান্ডমলি সবাই এক দেখাতে বইটাকে ভূতের ভাবে। আমার কাছে প্রচ্ছদটি অভারঅল লেগেছে। যাই হোক ভৌতিক ভৌতিক ব্যাপারটা আছে প্রচ্ছদে।
🌒বানান ও রচনাশৈলী এবং সম্পাদনা:- বইটিতে বানান ভুল তেমন চোখে পড়েনি। এজন্য প্রকাশনী বা লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ। শব্দচয়নে কিছুটা এলোমেলো লেগেছে কিছু জায়গায়। তবে বইয়ের প্রকাশনীকে পুনরায় ধন্যবাদ পৃষ্ঠার অপচয় না করার জন্য।আশা করবো সম্পাদনার বিষয়ে প্রকাশনী আরো সতর্ক হবে
🌒নামকরণ:-
নামটির সাথে বইয়ের কাহিনীর খুব একটা মিল পাওয়া না গেলেও নামটি আমার ভাল লেগেছে। তবে আমার মতে বইয়ের নাম নিষিদ্ধ জামরুলতলা হলেও মন্দ হতো না।
🌒প্রিয় কিছু লাইন:-
"নীরবতাই পরিশ্রমহীন এক ধরনের ইবাদত" "নিঃসঙ্গতা আর ভালবাসা দুটো দুই ব্যাপার"
🌒বইটা যাদেরকে সাজেস্ট করবো: বইয়ের জনরা অতিপ্রাকৃত ও ভৌতিক হলেও তেমন ভয়ের কিছু নেই।অতিপ্রাকৃত কিছু বিষয় আছে তবে গভীরভাবে কিছুই নেই। যাদের সমকালীন বা সামাজিক উপন্যাস পড়তে ভাল লাগে তারা পড়তে পারেন। এছাড়া অতিপ্রাকৃতের মধ্যে প্রেমের গল্পের স্বাদ পেতে চাইলে পড়তে পারেন।
শেষ করতে চাই বইটিতে উল্লেখিত কিছু লাইনের মাধ্যমে "কোন সুখে ভাসিয়ে নাও,আমি যে কবি! আমি ভেসে চলি, আমাকে ডোবাও,আমি ডুবি!
আমিও বইটি পড়ার সময় ডুবে ছিলাম কিছুটা তবে লেখকের শব্দচয়ন ভাল লেগেছে।যদি সময় দিয়ে বা আরো ভেবে চিন্তে লিখতো বইয়ের প্লট টা পাঠক প্রিয়তা পেতো। লেখক ও প্রকাশনীর জন্য শুভকামনা।
Read More
Was this review helpful to you?
By Sakib Ahmed,
09 Jun 2024
Verified Purchase
#রকমারি_নীল_ফড়িং_বুক_রিভিউ_প্রতিযোগিতা
একটি বই, চতুর্ভুজ প্রেমের গল্প, না-কি বাংলা সিনেমার কোন দৃশ্যপট? কিংবা হতে পারে ভারতীয় কোন সিরিয়ালের গল্প আপনি পড়ছেন। “নীল ফড়িং” যেন সবগুলোর মিশেলে জগাখিচুড়ি ধরনের একটি গল্প।
বইটির শুরুটা হয়েছিল রহস্য দিয়ে। যেখানে একজন বাচ্চা মেয়েকে দেখা যায়। ধরুন, আপনি কোথাও বসে চা পান করছেন। তখন একটি বাচ্চা মেয়েকে দেখে খেয়ালের বশে তার সাথে কথা বলতে চাইলেন। নাম, পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু সেই মেয়েটা যদি আপনার পরিবারের ইতিবৃত্ত নিজের নামে চালিয়ে দেয়, তখন আপনার অনুভুতি কেমন হবে? ইখলাছ সাহেব এমনই এক পরিস্থিতিতে পড়েছেন। সামনে যে বাচ্চা মেয়েটি রয়েছে সে নিজের পরিচয়ে ইখলাছ সাহেবের পরিবারের সবার নাম বলছে। বিষয়টা বিভ্রান্তিকর। কে এই মেয়ে? কোথা থেকে এসেছে? গ্রামের এই পরিবেশে সবাই সবাইকে চিনলেও এই মেয়েটাকে চেনা যাচ্ছে না। কেমন যেন রহস্য ঘেরা। হুট করে নেই হয়ে যায়। তার চারিপাশে নীল রঙের ফড়িং ঘুরছেই বা কেন? কোনো রহস্য আছে কি?
বইটির শুরুটা এভাবে ছিল। জানা যায়, মেয়েটি এভাবে কোনো পরিবারের মেয়ের নাম নিলে সে মেয়েটি মারা যায়। যেই গল্পের শুরু এমনভাবে, সেই গল্প নিয়ে আকর্ষণ জেগে ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু এই আকর্ষণ মিইয়ে যেতেও সময় লাগেনি। কেননা লেখক এই রহস্যের আবহ ধরে রাখতে পারেননি। যে অতিপ্রাকৃত আবহ দিয়ে লেখক সূচনা করেছেন, সেই আবহ পুরো বই জুড়ে পাওয়া যায়নি। বরং একটি সস্তার রোমান্টিক গল্প; যখন প্রেমের জন্য রেষারেষি, কামড়াকামড়ির এক কাহিনিতে পরিণত হয়েছে। যা আসলে কোনো গল্প হয়েছে কি না, সেটাও প্রশ্ন থেকে যায়।
এই গল্পের প্রধান চরিত্র ধরে নেওয়া যাক নাফিলা। স্কুল পড়ুয়া একটা মেয়ে। সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবে। গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী কিশোরী। তার প্রেমে ডুবে যাওয়া পুরুষের অভাব হওয়ার কথা না স্বাভাবিক। প্রথম যে ছেলেটি নাফিলার প্রেমে পড়ে, সে সাবের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একজন মেধাবী ছাত্র। নাফিলার সৌন্দর্য্যে প্রেমে পড়ে যায়। ইচ্ছে ছিল ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে নাফিলার বাড়িতে প্রবেশ করে মেয়েটির মন জয় করবে। কিন্তু নাফিলাদের স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক বেলাল স্যার সেই জায়গা দখল করে নেয়। আর চেষ্টা থাকে নাফিলার মনে অনুপ্রবেশের।
তবে সবচেয়ে বেশি চেষ্টা থাকে সাবেরের। এবং সেখানে সে সফলও হয়। গভীর রাতে ফোনালাপে যে প্রেম হয়, তার উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে নাফিলার মনেও। কিন্তু ভালোবাসার এই ক্ষণ বেশিদিন স্থায়ী হয় না। কেননা সাবেরের বন্ধু মাখন, যে আবার চেয়ারম্যানের বখে যাওয়া ছেলে— তার নজর পড়েছে নাফিলার উপর। আর এমন ছেলে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য সবকিছু করতে পারে। এখানে বন্ধুকে শত্রু করতে পারে। বন্ধুর ক্ষতি সাধন করতে পারে। মোটকথা জোর করে অর্জন করার এক ধরনের প্রবণতা কাজ করে। কিন্তু ভালোবাসা কি জোর করে আদায় করা যায়?
মাখন এমন কিছু ঘটনার অবতারণা করে, যাতে নাফিলা এই সাবেরের ভালোবাসা এই মধুর সম্পর্ক শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যায়। মাত্র একদিন স্থায়ী হয় তাদের প্রেম! আর তাতেই দুইজন দুইজনকে বেশ ভালই অনুভব করে। কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারে না। আমাদের মানব চরিত্রের এক ধরনের বৈশিষ্ট্য আছে— আমরা খুব সহজে মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হই। আর এতে সবচেয়ে কাছের, ভালোবাসার মানুষকে ভুল বোঝা অমূলক নয়। এখানে আমার একটা কথা মনে হয়েছে— যেহেতু নাফিলা আর সাবেরের সম্পর্ক এক দিনের, সেহেতু দুইজনে কেউ কাউকে ঠিকমতো চিনতে পারেনি। তাই অন্যের কথায় বা ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে ভুল বুঝতে শুরু করে। কারণ তাদের মনের মধ্যে সেই সংযোগ তৈরিই হয়নি। অন্যদিকে আরেকটা বিষয় আমার অতিরঞ্জিত লেগেছে, মাত্র একদিনের প্রেম যেখানে, সেখানে অতীত আঁকড়ে ধরে স্মৃতিচারণ কীভাবে করে? তাদের আসলে স্মৃতিটা কোথায়?
উপন্যাসটির চরিত্রগুলোর চারিত্রিক সমস্যা প্রকট। মাখনের কথা তো আগেই বলেছি! নাফিলার প্রতি প্রেম অনুভব করার পরও মদ-গাঁজায় ডুবে থাকা, মেয়ে মানুষ নিয়ে ফুর্তি ছিল নিত্যনৈমত্তিক বিষয়। এছাড়া বেলাল স্যার তার ছাত্রীর প্রতি যেমন আবেগ অনুভব করত, তাতে তাকে ছ্যাচড়া মনে হয়েছে বেশি। সবকিছুতে সে অনুভব করে নাফিলার প্রতি ভালোবাসা! এই কারণেই তো নাফিলা পরীক্ষায় ফেল করছে। ঠিক মতো না পড়ানোর কারণে। এই গল্পে আরেকটি চরিত্র ছিল, লক্ষ্মী বৌদি। যে সাবেরকে ভাইয়ের মতো মনে করে, স্নেহ করে; আবার অন্যদিকে স্বামী বিদেশে থাকার সুবাদে অনৈতিক চিন্তা করে! মানে, ভাবা যায়? এ জাতীয় গল্প তো ভারতীয় সিরিয়ালকে হার মানাবে।
এদিকে নাফিলার থেকে সাবেরকে দূরে রাখতে একের পর এক কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে মাখন। যেখানে নিকৃষ্ট এক ষড়যন্ত্রে পুলিশের হাতেও ধরা পড়তে হয়েছে। নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে তাই পরিবারসহ গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসে। অন্যদিকে সাবেরের বাবা মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত। একদিন এভাবেই জীবন নিঃশেষ হয়। সাবেরও একদিন সিন পিছুটান ছেড়ে বাংলাদেশ ছেড়ে পাড়ি জমায় বিদেশ। যেখানে নাফিলা নামক ক্ষত বারবার জানান দেয় ভালোবাসায় হেরে যাওয়ার উপাখ্যান।
অন্যদিকে সাবেরকে হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত নাফিলা। একদিনের প্রেমে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, সেটা ভাবা যায় না। আমার কাছে অতিরঞ্জিত লেগেছে বিষয়টা। দিনশেষে কার সাথে কার মিল হবে? মাখন, সাবের না-কি বেলাল স্যার? না-কি অমিলে শেষ হবে গল্পটা!
লেখকের লেখনশৈলী এখানে গুরুত্বপুর্ণ হতে পারত। শুরুতে হুমায়ূন আহমেদের ধাঁচে লেখা মনে হলেও, সেই সংযোগ কোথাও যেন অনুপস্থিত। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পড়তে বিরক্ত লেগেছে। লেখকের গল্প বলার ধরনেও মনে ধরার মতো কিছু ছিল না। বরং একঘেয়েমি একইভাবে লেখক গল্প বলে গিয়েছেন। এটাও বিরক্তির অন্যতম কারণ। একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম— যে লেখা একটি প্যারায় শেষ করা যেত, সেখানে লেখক প্রতিটি বাক্য আলাদা আলাদা প্যারায় লিখেছেন। এখন এক বাক্যকে প্যারা বলা যায় কি না আমার জন্য নেই। এমন কেন? এভাবে পড়তেও এক ধরনের ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিল বারবার। তাছাড়া লেখকের কিছু শব্দচয়নে ঘাটতি ছিল, বা জানার ঘাটতি। কয়েক জায়গায় এমন সময় লক্ষ্য করেছি। আমি যেহেতু বই পড়ার সময় নোট করি না, তাই মনেও নেই। তবে একটা শব্দ মনে আছে, লেখক কোনো এক জায়গায় তবজি বা এমন ধরনের কোনো শব্দ উল্লেখ করেছিলেন। যার অর্থ বলেছে আদব-কায়দা। আমার জানামতে শব্দটি হবে তমিজ। এরূপ ভুল বেশ কয়েক জায়গা দেখা গিয়েছে।
তাছাড়া লেখকের জ্ঞান বিতরণের ইচ্ছা প্রবল মনে হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় কারণে অকারণে জ্ঞান বিলিয়েছেন। যার অনেক কিছুই প্রয়োজন ছিল না। বিশেষ করে প্রেম বিষয়ক জ্ঞান বিতরণ প্রচুর পরিমাণে ছিল। কেউ যদি বইটি পড়ে, তাইলে সে হয়তো প্রেম বিশেষজ্ঞ হয়ে যেতে পারে। এছাড়া সংলাপের ক্ষেত্রেও লেখকের দুর্বলতা প্রকট আকার ধারণ করেছিল। বাবা তার ছেলেকে মাগীবাজি শব্দ উল্লেখ করে শাসন করছে, বিষয়টা পছন্দ হয়নি। সম্পর্ক যেমনই হোক, ঘটনাপ্রবাহ যেভাবেই চলুক; কিছু বিষয় আসলে আমলে নেওয়া উচিত। কখন কোন চরিত্র দিয়ে কী বলা উচিত সেটা ভেবে দেখা উচিত। এছাড়া সংলাপের রিপিটেশন ছিল অত্যধিক। একই ঘটনা বিভিন্ন আঙ্গিকে বারবার বলার কারণে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছিলাম বারবার।
লেখক গল্পে চমক রাখতে বেশকিছু ঘটনাপ্রবাহের অবতারণা করেছেন, যা কাকতালীয় ছাড়া বেশি কিছু না। এতে করে ভুল বোঝাবুঝি, নানান নাটুকে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। উপন্যাসের শেষ দৃশ্য যেন এমনই এক ঘটনা। এই প্রথম কোনো উপন্যাসের হ্যাপি এন্ডিং খুব বেশি বিরক্ত দিয়ে গিয়েছে।
উপন্যাসের নামকরণের যথার্থতাও এখানে ঠিকঠাক পাইনি। শুরুতে এক অতিপ্রাকৃত ঘটনার আভাস দিয়েছিলেন, যার সাথে হয়তো নীল ফড়িং নামটা যায়। কিন্তু পুরো বই জুড়ে সেই অতিপ্রাকৃত ভাব হারিয়ে রোমান্টিক জাতীয় বই ছাড়া বইটিকে কিছুই মনে হয়নি। আর শেষে এসে কিছুটা আভাস দেওয়া হয়েছে, তাও সব ধোঁয়াশা। আর এখানেই বইটির নামকরণ তার আবেদন হারিয়েছে। এই দিকটা প্রতিটি লেখকের আসলে বিবেচনা করা উচিত। একটি বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নামকরণ। এখানে গল্পের সাথে সামঞ্জস্য না হলে, বিষয়টা সুখকর কিছু নয়।
পরিশেষে, একটি উপন্যাস; যায় শুরুটা অতিপ্রাকৃত ঘরানার ছিল। তা গল্পের মাঝে কেন রোমান্টিক আবহ চলে এলো বোধগম্য হয়নি। প্রেম, প্রেম আর প্রেম। প্রেমের জন্য মারামারি-হানাহানি, বিচ্ছেদের আবেগ, আমার ফিরে পাওয়ার আনন্দ! তাও যদি স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে হতো! মনে হয়েছে যেন বাংলা সিনেমার কোনো চিত্রনাট্য পড়ছিলাম, কিংবা ভারতীয় কোনো সিরিয়াল। কোনটা? এ নিয়ে এক প্রকার মারামারি করাই যায়!
আমার হৃদয়ের আকাল অনবদ্য সক্ষমতার! কোন সে নক্ষত্র বিবেকের মতো হারিয়েছে শূন্যতার অসীমে--- আকাশের নীলাভ উৎসবি দেহে...
ঢাকার অদূরে ঝলমলিয়া গ্রাম, রাত বারোটার কাছাকাছি সময়, পৌষ মাসের ভয়াবহ এক শীতের অন্ধকার রাতে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার একলাছ সাহেব বসে আছেন মতি মিয়ার চায়ের দোকানে। গা ছমছমে পরিবেশে হঠাৎ করে আগমন ঘটে লাল রঙের ফ্রক পরা রহস্যময় এক মেয়ের। মেয়েটির আশেপাশে ওড়াউড়ি করছে কিছু নীল ফড়িং। জানা যায় লাল ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটির নাম নাফিলা ও তার বাবার নাম একলাছ। মেয়েটি যখন তার পরিচয়ে একলাছ সাহেবের পারিবারিক তথ্য দিচ্ছিল তখনই ঘাবড়ে যান একলাছ সাহেব। মতি মিয়া একলাছ সাহেবকে মেয়েটির অলৌকিক ও রহস্যময় কিছু হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। আকস্মিকভাবে আবির্ভূত হওয়া ছোট্ট এই রহস্যময় মেয়েটি কে? তার সাথে একলাছ সাহেব ও নীল ফড়িংয়ের যোগসূত্র কোথায়?
একলাছ সাহেবের একমাত্র মেয়ে নাফিলা এসএসসি পরীক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র সাবেরের সঙ্গে নাফিলার প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে, সাবেরের বন্ধু মাখন ও গৃহশিক্ষক বেলাল মাস্টার দুজনেই নাফিলাকে পছন্দ করে। সাবের ও নাফিলার সম্পর্ক ভাঙ্গনের জন্য মাখন নানান কূটকৌশল অবলম্বন করতে থাকে। কী হবে তাদের সম্পর্কের পরিণতি? মাখন কি তার ঘৃণ্য কর্মে সফল হবে? সাবের ও নাফিলার সম্পর্কের ব্যাপারে অবগত হওয়ার পর বেলাল মাস্টারের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? গল্পটি অতি নাটকীয়ভাবে এগুতে থাকে।
"নীল ফড়িং" উপন্যাসটি মোট দশটি অধ্যায়ে বিভক্ত। মাঝারি আকারের এই বইটিকে প্রেম, বিরহ, ভালোবাসা, হিংসা, প্রতিশোধ ইত্যাদির আলোকে সাজানো হয়েছে। প্রত্যেকটি উপন্যাসেরই কিছু ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক থাকে। কিছু বইয়ে হয়তো ইতিবাচক দিক বেশি থাকে, আবার কিছু বইয়ে নেতিবাচক দিক অধিক। কিন্তু এই বইটি নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করার মতো কিছু খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। যতই সামনে এগিয়েছে ততই চোখে পড়েছে অতি নাটকীয় ঘটনাবলী। যেগুলো বিরক্তির উদ্রেক ছাড়া আর কিছু ঘটাতে পারেনি।
উপন্যাসটি অলৌকিক ও রহস্যময় ঘটনা দিয়ে শুরু হয়েও তার ধারাবাহিকতা ঠিকভাবে ধরে রাখতে পারেনি। হঠাৎ হঠাৎ লাল ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটির আবির্ভাব হলেও তা কোনো ভৌতিক আবহ সৃষ্টি করতে পারেনি। তার কাজটা আসলে কী সেটাই ভালোভাবে পরিষ্কার নয়। একলাছ সাহেবের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে যে ভীতিকর একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল পরবর্তীতে সেটা যেন নাই হয়ে গেলো। মতি মিয়ার একলাছ সাহেবকে সাবধান করে দেওয়াটা গা ছমছমে পরিবেশের সৃষ্টি করলেও পরবর্তীতে এর কোনো রেশ লক্ষ করা যায়নি। উপন্যাসটির জনরা মূলত অতিপ্রাকৃত ও ভৌতিক। কিন্তু অতিপ্রাকৃত ও ভৌতিক বলতে আদতে উপন্যাসে কিছুই ছিল না। সহজে ভীতিগ্রস্ত হওয়া আমার মনে এক ফোঁটাও ভয়ের সৃষ্টি করাতে পারেনি। উল্টো বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলার মতো অবস্থা হয়েছে।
একলাছ সাহেব তার মেয়ে নাফিলাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। উপন্যাসে তা ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। পক্ষান্তরে, নাফিলাও বাবা অন্তঃপ্রাণ। তাদের বাবা-মেয়ের সম্পর্কটা দারুণ।
উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র নাফিলা। তাকে যতই অবলোকন করছিলাম ততই মনে হচ্ছিল তাকে জোর করে ম্যাচিওর বানানো হয়েছে। নাফিলাকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও স্ট্রং ক্যারেক্টার বলা হলেও তার মধ্যে এসবের কিছুই ফুটে উঠেনি। পারতপক্ষে সে একজন দুর্বল চরিত্রের অধিকারী। পক্ষান্তরে, সাবেরকে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে তাকেও সেরকম মনে হয়নি। দুজনকে যতই শক্তপোক্ত বলা হোক না কেন তাদের বেশকিছু দুর্বলতা রয়েছে। উপন্যাসে সাবেরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কথাটা কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে। একসময় বিষয়টাকে অতিরিক্ত মনে হয়েছে। সাবের যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তা শুরুতেই বলা হয়েছে। তারপরও বারবার একই কথার পুনরাবৃত্তিতে বিরক্ত লেগেছে। আবার কিছু খাপছাড়া কথাও রয়েছে। যেমন নিম্নোক্ত লাইনদুটোই ধরা যাক। - "তুমি কীসে পড়ো?" - "আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।" কীসে পড়ো'র বিপরীতে "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি" এমন উত্তর তো হতে পারে না। এখানে মনে হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বেশি হাইলাইট করা হয়েছে। যেটা অনেকটাই অতিরঞ্জিত।
সাবের ও নাফিলার ভালোবাসার গভীরতা অনেক। উপন্যাসে তা-ই উপস্থাপন করা হয়েছে। বিচ্ছেদের পর তাদের উভয়কেই ভুলতে না পারা, সম্পর্কের রেশ অনেক বছর ধরে থাকা খুব কমই লক্ষণীয়। বিশ্বাস যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং তৃতীয় পক্ষের দ্বারা প্ররোচিত হলে সম্পর্কে ফাটল ধরে সেই বিষয়টাই উপন্যাসে পরিলক্ষিত হয়েছে। যাচাই না করে অবিশ্বাস করলে সেই সম্পর্ক বেশিদিন টিকতে পারে না। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচল আমাদের সমাজে অহরহ দেখা যায়। সাবের ও নাফিলার বিচ্ছেদের কারণটা খুবই দুর্বল লেগেছে। তাদের সম্পর্ক যেমন হঠাৎ করে শুরু হয়েছে, বিচ্ছেদও তেমন হঠাৎ করেই হয়েছে। তবে এখানে একটা কিন্তু রয়ে গেছে। তাদের মাত্র ২/৩ বারের দেখায় ও কয়েকটা ফোনালাপে এতো গভীর ভালোবাসা হয়ে গেল? জিনিসটা মাত্রাতিরিক্ত নাটকীয় মনে হয়েছে। তাদের সম্পর্কের গভীরতা বুঝানোর জন্য আরেকটু সময় তাদের দেয়া যেতো। তাহলে তাদের বিচ্ছেদটা ভালোভাবে ফুটে উঠতো। তাদের সম্পর্কটা ছিল অল্প কিছু দিনের। কিন্তু এই কিছুদিনের রেশ ধরেই নাফিলা বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও তার ডিপ্রেশন থেকে বের হতে পারে না। কিছুদিন পর পরই সে ডিপ্রেশনের চরম মাত্রায় চলে যায়। সেই সাথে আমিও বিরক্তির চরম মাত্রায় চলে গেছি। তবে এখানে একটা প্রশ্ন রয়েই যায়। সাবের নাফিলার নাম্বার পেলো কীভাবে? বিষয়টা পরিষ্কার নয়।
সব সম্পর্কেই বিশ্বাস থাকা জরুরি। সেটা প্রেমের সম্পর্কেই হোক কিংবা বন্ধুত্বের। হিংসাপরায়ণ হয়ে সাবেরের সাথে করা মাখনের কর্মকাণ্ডগুলো একটু বেশিই বাড়াবাড়ি লেগেছে। সাবের ও নাফিলার বিচ্ছেদের পরও সাবেরকে হেনস্তা করে সীমা লঙ্ঘন করে ফেলেছে মাখন। আবার নাফিলাদের টিনে ঢিল পরা দেখে মনে হয়েছে মাখনের জন্য একটা সুযোগ তৈরি করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। কারণ মাখন যখন নাফিলাদের টিনে ঢিল মারার এই পদ্ধতি অবলম্বন করে তার পর থেকেই অলৌকিক কোনো শক্তি এই কাজ আর পুনরায় করেনি।
অন্যদিকে, জেবুন্নেছা ও তাহেরুন্নেছা একলাস সাহেবকে নিয়ে মজা করতে করতে কখন যে সীমা লঙ্ঘন করে ফেলে সেটা তাদের খেয়ালও থাকে না। তাদের এই বাড়াবাড়ি রকমের মশকরা, একলাস সাহেব ও জেবুন্নেছাকে নিয়ে তাহেরুন্নেছার অযথা সন্দেহ বিরক্তির মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। তাছাড়া তাদের আচরণও ছিল খাপছাড়া।
লক্ষ্মী সাবেরকে ছোট ভাই ভাবলেও হঠাৎ হঠাৎ তার অনুভূতি জাগ্রত হওয়া ছিল চরম বিরক্তিকর। একবার প্রতিশোধপরায়ণ হওয়া, তো আবার কোনোরকম অনুতপ্ত না হয়ে হঠাৎ করে ভালো হয়ে যাওয়া ছিল প্রচন্ডরকম খাপছাড়া কাজ। যেটা বেলাল মাস্টারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
উপন্যাসে কিছু কিছু চরিত্রকে অতি মাত্রায় বেকুব মনে হয়েছে। তারা শুধু ধারণা করে নেন, সবকিছু বুঝে ফেলেন নিজের মতো করে। তাছাড়া উপন্যাসে অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় কিছু বর্ণনা রয়েছে। যেগুলোর আদতে কোনো দরকার ছিল। তাছাড়া অহেতুক কিছু কথোপকথনও লক্ষণীয়। সবকিছুর ব্যাখ্যা হয়না কিংবা ব্যাখ্যা খুঁজতে নেই। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। উপন্যাসের বেশকিছু ঘটনার ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল। যেমন একটা বিষয়, মতি মিয়ার হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যাওয়া৷
বইটির প্রোডাকশন কোয়ালিটি ভালো। তবে বই দু'হাতে টেনে ধরে পড়তে হয়েছে। সম্পাদনায় অনেক ঘাটতি রয়েছে। বর্ণনার ক্ষেত্রে একটা বাক্য শেষ হওয়ার পর পরবর্তী বাক্য পাশাপাশি শুরু না করে পরবর্তী লাইনে চলে গেছে। একটানা কয়েকটা বাক্যও এভাবে লাইন বাই লাইন লেখা হয়েছে। যেমন - "গত রাতে ফ্রেশ একটা ঘুম হয়েছে। নিজেকে দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে। দাঁতগুলো একটু উঁচু, এটাই বড় সমস্যা।" এরকম আরো অনেকগুলো বাক্য রয়েছে। বর্ণনাগুলো একটা প্যারার মতো হলে দৃষ্টিনন্দন হতো। কিন্তু বইয়ে উল্লিখিত বর্ণনার ধরন দেখে কিছুটা বিরক্তবোধ করেছি। আবার কোনটা বর্ণনা আর কোনটা উক্তি সেটা বুঝতেও একটু অসুবিধে হয়েছে। উক্তিগুলোর ক্ষেত্রে উদ্ধৃত চিহ্ন ব্যবহার করলে ভালো হতো। উপন্যাসে বিরামচিহ্নের ব্যবহারে কিঞ্চিৎ ত্রুটি রয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় দাঁড়ির পরিবর্তে প্রশ্নবোধক ও আশ্চর্যবোধক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। তন্মধ্যে প্রশ্নবোধক চিহ্নটা বেশি চোখে লেগেছে। আবার বইয়ের নামকরণ "নীল ফড়িং" কেন দেওয়া হয়েছে আমার মাথায় ঢুকেনি। নীল ফড়িংয়ের অস্তিত্ব প্রচ্ছদ ও গল্পে লক্ষ্য করা গেলেও তার কাজটা আসলে কী তা পরিষ্কার নয়। সেই মোতাবেক নামকরণও আমার ভালো লাগেনি। এই নামকরণের পেছনে সলিড একটা কারণ থাকা দরকার ছিল।
◑বই পরিচিতি : নাম : নীল ফড়িং লেখক : আব্দুল্লাহ শুভ্র প্রকাশনী : কবি প্রকাশনী রিভিউদাতা : ফারজানা উর্মি
Read More
Was this review helpful to you?
By Nazmun Nahar Rmn,
09 Jun 2024
Verified Purchase
#রকমারি_নীল_ফড়িং_বুক_রিভিউ_প্রতিযোগিতা
বই: নীল ফড়িং লেখক: আব্দুল্লাহ শুভ্র প্রকাশনী: কবি প্রকাশনী জনরা: অতিপ্রাকৃত ও ভৌতিক পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২১৬ মুদ্রিত মূল্য: ৩৭৫৳
অতিপ্রাকৃত জনরায় নাকি অশরীরী থেকে গল্পের ব্যাপ্তি বেশি থাকে। শর্ষের মাঝে ভূত লুকায়িত কথাটির মর্ম খুঁজতেই পাঠক বইয়ের পাতায় পাতায় ডুবতে থাকে। সেই কথার মান রাখতেই হাতে নিয়েছিলাম 'নীল ফড়িং।' পৃষ্ঠাও উল্টেটি একের পর এক। গল্পটা আসলে কি নিয়ে তা নিয়েই আমি দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে নাফিলা। গল্পটা নীল ফড়িং এর নয় বরং নাফিলার। তার সাথেই এগুতে থাকা চতুর্মাত্রিক প্রেমের গল্প। বিচ্ছেদের স্বাদ সেই সাথে নাটকীয় পরিস্থিতির শিকার একদলের গল্প। নাটকের কাহিনী নাকি নাটকীয় গল্প? এই দ্বিধাটুকু বোধহয় পাঠক শেষ অব্দি না গেলে বুঝবে না।
▪️ কাহিনী সংক্ষেপ: গল্পের শুরু হয় ১৯৯৯ সালের পটভূমিতে। চায়ের দোকান থেকে। ব্যাংক কর্মকর্তা একলাছ সাহেব (বর্তমানে রিটায়ার্ড) তাকে দেখা যায় মতি মিয়ার চায়ের দোকানে। রাত গভীর। তখনি তাদের সামনে আবির্ভাব ঘটে একটি ছোট্ট মেয়ের। মেয়েটির নাম নাফিলা। একলাছ সাহেবের মেয়ের নাম ও নাফিলা। প্রথমত মনে হতে পারে এক নামের দুটি মেয়ে থাকা অবাস্তব কিছু নয় তবে মেয়েটিকে যখন তার ঠিকানা জিজ্ঞেস করা হয় তখন সে একলাছ সাহেবের পুরো জীবনবৃত্তান্ত বলতে শুরু করে। কি অদ্ভুত না! শুরুটা গা ছমছমে ভাব নিয়ে হলেও ঘটনা পাল্টে যায় চোখের পলকে। পরের ধাপে ঘটনার কেন্দ্রে চলে আসে একলাছ সাহেবের মেয়ে নাফিলা চরিত্রটি। সে কিছুদিন পর ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবে। দেখতেও ভীষণ সুন্দরী। সুন্দরী বলেই তার উপর নজর আছে তিন তিনটি পুরুষের। প্রথমজন সাবের; ঢাবির ছাত্র। দ্বিতীয়জন সাবেরের বন্ধু; চেয়ারম্যান সাহেবের বখাটে ছেলে নাম মাখন। তৃতীয়জন নাফিলার গৃহশিক্ষক, নাম বেলাল। একটি মেয়ের প্রতি সকলের এক প্রকার অবসেশন এটা বলতে গেলে অনেকটা বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতোই মনে হয়েছে। এরপর এই পছন্দের জের ধরে বন্ধুত্বের উপর চীড় পড়ে। সাবের আর নাফিলার প্রেম একদিকে আর পৃথিবী যেন অন্যদিকে। সকলেই কোনো না কোনোভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে চলেছে তাদের আলাদা করার। মাঝে অবশ্য সফল ও হয়। একসময় সাবের দেশ ছেড়ে বাইরে চলে যায়। এদিকে নাফিলাও তার স্মৃতিতে কাতর হয়ে পরীক্ষায় ফেল করে বসে। সম্পর্কের টানাপোড়েনের মাঝেই নাফিলার বিয়ে ঠিক হয় তাও মাখনের সাথে! অতিপ্রাকৃত গল্প মোড় নেয় বিচ্ছেদের করুন রূপে। কোথাও যেন অপূর্ণতার সুর আবার মনে হবে কোথাও পূর্ণতার সুর। এ যেন একের ভেতর দশ!
▪️জনরা বিশ্লেষণ: অতিপ্রাকৃত, ভৌতিক,রোমান্টিক নাকি সমকালীন? জনরা হিসেবে অতিপ্রাকৃত ও ভৌতিক উল্লেখ থাকলেও আমার মনে হয়েছে লেখক তার মর্ম রাখতে ব্যর্থ। প্রথম দিকে লেখক ছোট্ট মেয়েটিকে সামনে এনে যে ভৌতিক আবহাওয়া তৈরি করে গিয়েছিলেন এক- তৃতীয়াংশ যেতে না যেতেই সেই আবহাওয়া বদলে যায় প্রেমের গল্পে। যেখানে বন্ধুত্ব ও রূপ নেয় গোপন শত্রুতে! আবার বর্ণনাভঙ্গি এতোটাই নাটকীয় মনে হয়েছে যে এক মূহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল আমি কি কোনো বাংলা সিনেমার স্ক্রিপ্ট পড়তে বসলাম?
▪️ চরিত্র বিশ্লেষণ: উপন্যাসের মূল চরিত্র নাফিলা। নাফিলাকে লেখক বরাবর ই আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন নারী হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। অথচ আমার মনে হয়েছে চরিত্রটি ভীষণ দুর্বল। আর বেশ কিছু দিক অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়েছে। যেমন সাবের আর নাফিলার প্রেমের শুরু টেলিফোনে কথা বলতে গিয়ে। সম্পর্কের বয়স ও দিন দুয়েক। পরবর্তীতে দেখানো হয় সাবেরের জন্য নাফিলা ভেঙে পড়েছে। অথচ এই সম্পর্কের স্থায়িত্ব ছিল কতদিন? স্মৃতির কথা তো আরো পরের।
এরপর মাখন নামক চরিত্রটি। অত্যাধিক ধুর্ত প্রকৃতির এবং বন্ধু হিসেবেও অযোগ্য। তবে মাখন চরিত্র টা কিছুটা ফানি ছিল। কিন্তু নাফিলার গৃহশিক্ষক বেলাল চরিত্র নিয়ে আমি অনেকটা কনফিউজড। শিক্ষককে মা বাবার সমান মনে করা হলেও লেখক এখানে শিক্ষককে তার ছাত্রীর প্রেমে পড়তে দেখিয়েছেন। এবং নাফিলার দেওয়া চিঠিও তিনি নিজের কাছে রেখে দেন শুধুমাত্র নাফিলা আর সাবেরের বিচ্ছেদ চেয়ে। এটাও কি কল্পনা করা সম্ভব? আর লক্ষ্মী বৌদি নামে যে চরিত্র দেখানো হয়েছে আমার হয়েছে এটি না টানলেও হতো। লক্ষ্মী একদিকে সাবেরকে তার ছোটভাই বলে সম্বোধন করে অন্যদিকে তার প্রতি অন্যরকম অনুভূতি রাখে।
এছাড়াও পার্শ্ব চরিত্র হিসেবে ছিল নাফিলার মা তাহেরুন্নছা এবং খালা জেবুন্নেছা। এই দুটি চরিত্রের কথোপকথন আমার কাছে খানিকটা ন্যাকামো মনে হয়েছে। কথায় কথায় নিজের স্বামী আর বোনকে নিয়ে সন্দেহপ্রবণ মনোভাবটা খুব একঘেয়েমি ছিল বটে।
আর ছোট্ট নাফিলা যার উদয় হ্ওয়া এবং হারিয়ে যাওয়া আবার ফিরে আসা এর মাঝে সে কে, কোথা থেকে আসে এই বিষয়ে কোনো সুরাহা লেখক ছাড়েননি। বলতে গেলে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে যাকে অনায়াসে দাঁড় করানো যেত সেই মাঝে এসে গায়েব হয়ে যায়।
▪️পাঠ প্রতিক্রিয়া: বহুদিন পর অতিপ্রাকৃত জনরার বই হাতে নিয়েছিলাম। যদিও বইটি নিতান্ত ছোট বলেই মাইন্ড রিফ্রেশ করার ইচ্ছে ছিল তবে পড়ার পর মনে হয়েছে হয়ত আমি ভুল জনরা সিলেক্ট করেছি নয়ত আমার রুচিতে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে।
দশ অধ্যায়ে বিভক্ত বইটি প্রায় অর্ধেক শেষ করেই একবার মনে হয়েছিল আর আগাতে চাই না। তবে মাঝপথে কিছু রেখে দেওয়ার মতো বদ অভ্যাস আমার নেই। "নীল ফড়িং" এ ফড়িং খুঁজতে গিয়ে আমি খুঁজে পেয়েছি এক হালি হতাশা। বইটি পড়ার সময় একেকবার একেক রকম অনুভুতি কাজ করছিল। নাফিলা আর সাবেরের বিচ্ছেদের পর নাফিলা যখন ভেঙে পড়ে তখন মনে হচ্ছিল সামনে হয়ত সেড এন্ডিং অপেক্ষা করছে। সেই সাথে লেখক সাবেরকে দেখিয়েছেন যে কি না দিব্যি নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। প্রেমের অনুভূতি তাকে ছুঁতে পারছে না। অথচ নাফিলা একাই সবটা বয়ে চলেছিল। এর মাঝেই তার বাবার অসুস্থতার সময় তার বিয়ে ঠিক হয় মাখনের সাথে। মাখন, যাকে কিনা নেগেটিভ চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে তার সাথেই একলাছ সাহেব নাফিলাকে বিয়ে দিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন। যেন সারা দেশে ছেলের অভাব চলছিল! যখনি মনে হয়েছে হয়ত এবার ভালো কিছু হবে হয়ত গল্প তার জনরার দিকে এগুবে তখনি লেখক আমাকে আশাহত করেছেন। বিচ্ছেদের এক গুনগুন গান শুনিয়ে শেষে আমাকে হ্যাপি এন্ডিং ধরিয়ে দিয়েছেন। তাও নাটকীয় ভাবে। বিশেষত শেষের অধ্যায়ে সব ঘটনার জগাখিচুড়ী পাকিয়ে ছেড়েছেন।
তবে এতেই আমি তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারিনি। অসামঞ্জস্য দিকগুলো পড়ে আমি রীতিমত থ' হয়ে বসেছিলাম। যেমন: শুরুর দিকে দেখানো হয় রাত ১২.৩০টায় মতি মিয়া বলছে এশার নামায পড়বেন। একলাছ সাহেব ও বললেন তার ও নামায পড়া বাকি। তিনি বাসায় গিয়ে এশার নামায আদায় করেন। অথচ এশার নামাযের শেষ সময় নিয়ে লেখকের ন্যূনতম ধারণা নেই জেনে খুব অবাক হয়েছি। এরপর একলাছ সাহেব গভীর রাতে তার মেয়েকে বলছে গোসলের জন্য গরম পানি করো। এরপরো নাফিলা বলছে,'এতো রাতে গোসল করলে ঠান্ডা লাগবে না?' যেখানে বলাই হয়েছে গরম পানি করতে সেখানে ঠান্ডা লাগার কথা আসবে কেন? এমন আরো কিছু লাইন আপাতত মাথায় আসছে না।
আর "নীল ফড়িং" এ একটা বিষয় খুব চোখে লেগেছে। সেটা হলো লেখক গল্প দেখাননি বরং বলে গেছেন। গল্প পড়ার সময় তা চোখে ভাসানো যায়নি। বর্ণনাভঙ্গি সেরকম ছিল না। বলা বাহুল্য গল্পের জনরার সাথে ঘটনার মিল নেই বললেই চলে। কিন্তু লেখনভঙ্গি আরেকটু উন্নত করলেও পড়তে গিয়ে ইন্টারেস্ট পাওয়া যেত। শুরুতে যেমন পাঠককে কাছে ঘেরাতে সক্ষম হয়েছিলেন সেটা পুরোটা সময় ধরে রাখার চেষ্টা করতে বিফল হয়েছেন। লেখকের উপস্থাপনা ভঙ্গিতে বেশ কমতি ছিল। লেখকের মতে, সবকিছুর মানে খুঁজতে নেই। তাইতো গল্পের ইতি তো আছে কিন্তু কোনো সুখকর বিষয় জড়িয়ে নেই।
▪️প্রোডাকশন, সম্পাদনা ও অন্যান্য: বইটির প্রোডাকশন বেশ ভালো। তবে প্রচ্ছদটা আমার কাছে যুতসই মনে হয়নি। বইয়ের প্রচ্ছদ এর ঘটনার আলোকে তৈরি হয় অথচ এখানে নামকরণ, প্রচ্ছদ কিংবা ঘটনা কোনোটার অন্তমিল আমি পাইনি।
এছাড়াও বইয়ে বেশকিছু বানান ভুল চোখে পড়েছে। বাক্যবিন্যাস আমার কাছে বেশ নড়বড়ে মনে হয়েছে। একই লাইনের পুনরাবৃত্তিও চোখে পড়েছে। আর বিরামচিহ্নের ব্যবহারে সম্পাদকের অনীহাই ফুটে উঠেছে যেটা আসলেই বিরক্তিকর ছিল।
▪️ পার্সোনাল রেটিং: ২/৫
Read More
Was this review helpful to you?
By Priyanka Ganapati,
10 Jun 2024
Verified Purchase
#রকমারি_নীল_ফড়িং_বুক_রিভিউ_প্রতিযোগিতা
❝...প্রেম কখনো নদীর ঘোলা পানির মতো হয়ে যায় আবার কখনো স্বচ্ছ ঝরনার সুপেয় পানির মতো পরিষ্কার হয়ে বইতে থাকে। কখনো মরুদ্যানের ধূলিঝড় কিংবা কখনো সাইক্লোনের মতো আবেগ এসে সবকিছু ভাসিয়ে নেয়। ভালোবাসা এক ধরনের অলৌকিক পাগলামি।❞
শুদ্ধতম এক অনুভূতির নাম ভালোবাসা। কিন্তু কাউকে ভালোবাসলেই কি ভালোবাসার মানুষের সাথে একসঙ্গে থাকার গল্প সৃষ্টি হয়? কেউ হয়তো ভালোবাসার মানুষকে পায় আবার কেউ হয়তো পেয়েও হারায়। তবে সত্যিকারের ভালোবাসার অনুভূতি কি কখনো হারিয়ে যায়? মনের গোপন প্রকোষ্ঠে সেই অনুভূতির বাস তো চিরস্থায়ী। আবার কারো মনে সৃষ্টি হয় ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্য এক অনৈতিক জেদ। ভালোবাসার বিভিন্ন রূপকে কেন্দ্র করেই লেখক আব্দুল্লাহ শুভ্র রচনা করেছেন ❝নীল ফড়িং❞ নামক এক উপন্যাস।
উপন্যাসের কাহিনীর সূত্রপাত ঘটে পৌষ মাসের এক শীতের রাতে ঝলমলিয়া গ্রামের মতি মিয়ার চায়ের দোকানে। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা একলাছ সাহেব যখন সেই চায়ের দোকানে চা খেতে আসেন তখন তার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে লাল ফ্রক পরা রহস্যময় এক ছোট্ট বালিকার সাথে। বালিকাটি যখন তার পরিচয় ব্যক্ত করে একলাছ সাহেব তখন ঘাবড়ে যান। মতি মিয়া তাকে জানান যে, মেয়েটি এমনই এক অন্ধকার রাতে এক ভদ্রলোকের সাথে এভাবেই কথা বলেছিল এবং পরবর্তী দিন সেই ভদ্রলোকের মেয়ে পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। ‘নাফিলা' নামক এক কন্যার জনক একলাছ সাহেব অজানা এক ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে সেই চায়ের দোকান ত্যাগ করে। একলাছ সাহেবের ভয় কি অমূলক? না-কি সত্যিই কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার স্বাক্ষী হতে যাচ্ছেন তিনি?
রহস্যময় বালিকার সাথে একলাছ সাহেবের স্বাক্ষাতের পরে তার জীবনে ঘটতে থাকে অদ্ভুত কিছু ঘটনা। তাদের বাড়ির টিনের চালে বৃষ্টির মতো ঢিল পড়া, নাফিলার শোবার ঘরের বড় জানালার পাশে করমচা গাছের ডাল ভয়ংকারভাবে নড়চড়া করা, আবার রেললাইনের ধারে জামরুল গাছের কাছে রহস্যময় মৃত্যুর মতো বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। এসব রহস্যময় ঘটনা কি মানবসৃষ্ট? না-কি কোনো অতিপ্রাকৃত রহস্য জড়িয়ে রয়েছে এসব ঘটনার সাথে?
এস.এস.সি পরীক্ষার্থী নাফিলাকে কেন্দ্র করে বিস্তার লাভ করে 'ভালোবাসা' নামক অনুভূতির এক মায়াজাল। একই এলাকার মেধাবী শিক্ষার্থী সাবের, চেয়ারম্যানের পুত্র বখাটে মাখন, গৃহশিক্ষক বেলাল সবার মনেই নাফিলার জন্য ভালোবাসার উদ্ভব ঘটে। কিন্তু নাফিলার সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে সাবেরের সাথে। এই সম্পর্ক কি পরিণতি লাভ করে? মাখন ও বেলালের ভালোবাসা কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে সবার জীবনে?
একলাছ সাহেব, নাফিলা, সাবের, মাখন, বেলালসহ তাদের জীবনের সাথে সম্পর্কিত আরও কিছু চরিত্রের জীবনের গল্প জানতে হলে, উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে পাঠককে হাতে তুলে নিতে হবে ❝নীল ফড়িং❞ বইটি।
◾পাঠপ্রতিক্রিয়া:
উপন্যাস জীবনের কথা বলে, বাস্তব জীবনকে প্রতিনিধিত্ব করা বিভিন্ন চরিত্রদের সুখ-দুঃখের গল্প বলে, ব্যক্ত করে মানব মনের বিভিন্ন অনুভূতিকে, তুলে ধরে আমাদের ঘুণে ধরা সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতিকে। ❝নীল ফড়িং❞ উপন্যাসটিও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। ঝলমলিয়া গ্রামের কিছু চরিত্রের উপস্থিতিতে লেখক ব্যক্ত করেছেন বিংশ শতাব্দীর শেষভাগের এক চমৎকার আখ্যান।
উপন্যাসের প্রারম্ভ হয় এক অপ্রাকৃতিক ঘটনার মধ্য দিয়ে। ভুতের ভয়ে শঙ্কিত পাঠক হওয়ায় দুরুদুরু বুক নিয়ে পাঠে অগ্রসর হচ্ছিলাম। তবে সেই ভয় বেশিক্ষণ স্থায়িত্ব লাভ করেনি। লেখক ভৌতিক ঘটনার চেয়ে সমাজের গল্প, মানুষের গল্পই বেশি বলেছেন। উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে লেখক আমাদের গ্রামবাংলার বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। যেখানে একলাছ সাহেবের মতো সম্মানিত ব্যক্তিদের জীবন ক্ষমতাধর চেয়ারম্যান, তার বখাটে সন্তান ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং তিনি শিকার হয় নোংরা রাজনীতির। যে সমাজে তোতা ঘটকের মতো নারীলিপ্সু অমানুষেরা ওৎ পেতে থাকে, ছলে বলে কৌশলে চেষ্টা করে নারীদের ফাঁদে ফেলতে। লক্ষ্মীর মতো যেসব নারীর স্বামী প্রবাসে বসবাস করে, তারা তাদের একাকিত্ব মুহূর্তের ভুলে ঘটিয়ে ফেলতে পারে চারিত্রিক অবক্ষয়ের মতো ঘটনা।
একইসাথে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও কৈশোরের চঞ্চলতাকে ধারণকারী নাফিলা এবং মেধাবী ও আদর্শ চরিত্রের সাবেরের জীবনে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো আগমন ঘটে ভালোবাসার। টেলিফোনে চুপিচুপি কথা বলা, সবাইকে লুকিয়ে দেখা করা, অভিমান যখন ঘিরে ধরে তখন চিঠিতে মনের ভাব ব্যক্ত করা ইত্যাদি ছোট ছোট বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে লেখক আমাদের শৈশবের সাথে সম্পর্কিত এক মিষ্টি প্রেমের গল্প বলেছেন। যে গল্পে আছে প্রেমের সৌন্দর্য, আছে অভিমান, সন্দেহ ও দূরত্ব, আছে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতে বিচ্ছেদ।
উপন্যাসের বেশ কিছু অপছন্দের চরিত্রে মধ্যে মাখন ও বেলাল অন্যতম। মদ, জুয়া ও নারীতে আকৃষ্ট মাখন চরিত্রটি নিজ অবস্থানে যথার্থ। গৃহশিক্ষক বেলালের নাফিলার প্রতি মুগ্ধতা আমাদের সমাজের বাস্তবতায় স্বাভাবিক মনে হলেও তার মনে নাফিলাকে নিয়ে সৃষ্ট ভাবনা তার প্রতি আমার মনে ঘৃণার মনোভাব সৃষ্টি করেছে। তরুণ প্রজন্মের কিছু চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক তাদের প্রেম-ভালোবাসা, মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও অবক্ষয়, সামাজিক বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন।
এই বইয়ে বর্ণিত প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। কন্যার প্রতি একলাছ সাহেবের স্নেহময় আচরণে, পিতার প্রতি নাফিলা ও সাহেবের দ্বায়িত্ব-কর্তব্যবোধে যেমন একটি সুন্দর পারিবারিক বন্ধনের পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি বিপদের মুহূর্তে সাবেরের নিজেকে স্থির রাখা ও নিজ কর্মে তার একনিষ্ঠতা ও অধ্যাবসায় মনে অনুপ্রেরণার জন্ম দেয়। আবার মোনায়েম সাহেবের মানবতা ও সন্তানের টিউটরের প্রতি তার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি মনের শ্রদ্ধার সৃষ্টি করে। পিতামাতা ও তাদের উঠতি বয়সের সন্তানের জন্য লেখক বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রেখেছেন অনেক শিক্ষণীয় গল্প। বইয়ের আরেকটি বিষয় আমাকে দারুণভাবে আপ্লূত করেছে, সেটি হচ্ছে এর উৎসর্গ।
অপ্রাকৃতিক, সামাজিক ও রোমান্টিকতার মিশেলে লেখক পাঠককে এক চমৎকার গল্প বলতে চেয়েছেন। কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন এর ছন্দপতন ঘটেছে। উপন্যাসের চরিত্রদের চারিত্রিক গঠন যদি আরেকটু জোরালো হতো, ঘটনার বিবরণ যদি আরেকটু গোছানো ও বাস্তবতা নির্ভর হতো, অলৌলিক ঘটনাবলি যদি আরেকটু কাহিনিতে সুন্দরভাবে বিস্তার লাভ করতো, যদি জনরা নিয়ে পাঠক মনে সংশয় তৈরি না হতো, যে অল্প কিছু প্লট হোল রয়েছে সেগুলো যদি না থাকতো তাহলে হয়তো আমার পাঠক হৃদয় আরও তৃপ্ত হতো ও পাঠক লেখকের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেতো চমৎকার একটি উপন্যাস।
বইটি প্রকাশিত হয়েছে ‘কবি প্রকাশনী' থেকে। বইটির পৃষ্ঠার মান, ফন্ট সাইজ সবকিছুই ঠিকঠাক মনে হয়েছে। চমৎকার বাঁধাইয়ের জন্য বই পড়ার ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেছি। তবে বইয়ের সম্পাদনায় কিছুটা যত্নের অভাব অনুভব করেছি। বানান ভুল চোখে না পড়লেও বইয়ের সেটাপ ও বিরামচিহ্ন ব্যবহারের দিকে আরেকটু নজর দেয়া যেতো। বইয়ে নীল ফড়িংয়ের উপস্থিতি না থাকার কারণে অনেক পাঠকের মনে নামকরণ নিয়ে কিছুটা দ্বিধা কাজ করলেও আমরা মনে হয়েছে অতিপ্রাকৃত ঘটনা, চরিত্রদের জীবনের সুখ-দুঃখ ও ভালোবাসাকে রূপক অর্থে লেখক ❝নীল ফড়িং❞ নামের মধ্য দিয়ে বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
রিভিউটি শেষ করছি উপন্যাসের চরিত্র সাবেরের লেখা কয়েক ছত্র বাক্যর মধ্য দিয়ে -
❝পূর্ণতার বিষোদগারে অপূর্ণতাই যেন মহাবিশ্বের প্রতি আমার এক সাগর ভালোবাসা। অবিশ্বাসগুলো না লেখা সাদা পৃষ্ঠায় পরিণত হয়েছে। সাদা পৃষ্ঠায় আমি বেঁচে থাকার গল্প লিখতে শুরু করেছি। আমি লিখে চলছি... বেঁচে আছি এখনও।❞
◾বই পরিচিতি:
বইয়ের নাম ~ নীল ফড়িং লেখক ~ আব্দুল্লাহ শুভ্র প্রকাশনী ~ কবি প্রকাশনী প্রচ্ছদ ~ ধ্রুব এষ মুদ্রিত মূল্য ~ ৩৭৫ টাকা
বইটি পাওয়া যাচ্ছে rokomari.com এ...
Read More
Was this review helpful to you?
By Kazi Hasan Jamil,
11 Jun 2024
Verified Purchase
#রকমারি_নীল_ফড়িং_বুক_রিভিউ_প্রতিযোগিতা
“ভালোবাসার বৈশিষ্ট্যই এমন। কোনো যুক্তি, কোনো অনুশাসনের বাঁধনে বাঁধা যায় না একে। যখন আসে, তখন সবকিছু মাড়িয়ে দাম্ভিকভাবেই আসে।” ~ জুলিয়ান (আশিয়ানী)
ভালোবাসা, সৃষ্টির সেই শুরু থেকেই অবিরাম ধারায় বয়ে আসছে; যে চলমান ধারা অব্যাহত থাকবে পৃথিবী ধ্বংসের আগ পর্যন্ত। প্রেম-ভালোবাসা শ্বাশ্বত ও সুন্দর; পৃথিবীর শুদ্ধতম অনুভূতি যা মানুষকে শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে জীবনের অমসৃণ পথ ধরে এক অজানা পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। সেই অজানা পথেই একসাথে বেড়িয়ে পড়েছিল পুবাইলে অদূরে ঝলমলিয়া গ্রামের সাবের ও নাফিলা। কেমন হয়েছিল তাদের অজানা পথের পরিণতি? কোথায় গিয়ে থেমে ছিল সে পথ?
বলছিলাম আব্দুল্লাহ শুভ্র এর লেখা “নীল ফড়িং” উপন্যাস নিয়ে। উপন্যাসের গল্পটা মূলত কী নিয়ে? চলুন তার আগে দেখে নেই আমাদের এই উপন্যাসের শুরুটা হয়েছিল কীভাবে....
নব্বই দশকের শেষ দিকে, বাংলা পৌষ মাস চলছে, ইংরেজি ডিসেম্বর মাস। বাইরে ভীষণ শীত। রাত বেশ গভীর। পুবাইলের অদূরে ঝলমলিয়া গ্রাম। মতি মিয়ার চায়ের দোকানে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার একলাছ সাহেব বসে আছেন। কোনক কারণে দোকানে আজ অন্য কোনো ক্রেতা নেই, হয়তো শীতের দাপট একটু বেশি হওয়াই এর পেছনে দায়ী।
এ সময় হঠাৎ লাল ফ্রক পরা রহস্যময় একটি ছোট্ট মেয়ের আবির্ভাব ঘটে। সেই সঙ্গে কিছু নীল ফড়িং। লাল ফ্রক পরা রহস্যময় মেয়েটিকে নাম জিজ্ঞেস করায় সে জানায় তার নাম নাফিলা। তার বাবার নাম একলাছ। একলাছ সাহেব ঘাবড়ে যান। হারিকেনের আলোয় ছোট্ট মেয়েটিকে ভালো করে দেখতে থাকেন। কিন্তু তখন দোকানদার মতি মিয়া, একলাছ সাহেবকে সতর্ক করে দেন, এ মেয়েটি অলৌকিক, রহস্যময় কোনো কিছু। এর আগেও এই মেয়েটি অন্য কোনো এক ভদ্রলোকের সঙ্গে এই দোকানে, এমনই রাতের আঁধারে কথা বলেছিল। ঐ ভদ্রলোককেও লাল ফ্রক পরা মেয়েটি একইভাবে, ভদ্রলোকের নিজের মেয়ের নামে, নিজের নাম বলেছিল! পরদিন ওই ভদ্রলোকের নিজের কন্যাটি পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যায়। একলাছ সাহেব ভয় পেয়ে যান।
কী? ঘটনাটা কী হতে পারে তাই ভাবছেন? ভাবারই কথা, বেশ আগ্রহ জাগানিয়া উপক্রমণিকা। চলুন আরেকটু সামনে যাই।
একলাছ সাহেবের একমাত্র মেয়ে নাফিলা। এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। বেশ সুন্দরী হওয়ায় নাফিলার প্রেমে পড়ে যায় নাফিলার স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক বেলাল স্যার। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের ছাত্র, একই এলাকার ছেলে সাবেরও নাফিলাকে পছন্দ করে অনেকদিন থেকেই। যদিও এখন পর্যন্ত মুখ ফুটে বলেনি। একদিন রাতে সাবের তার বন্ধু মাখনদের বাড়ি গিয়ে নাফিলাদের বাড়ির ল্যান্ডলাইনে কল দেয়। কল রিসিভ করে নাফিলা। দুইজন প্রথম একে অপরের সাথে কথা বলে। শুরু হয় তাদের প্রেম গাঁথা, অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা।
মাখন এলাকার চেয়ারম্যানের ছেলে। নাফিলার সৌন্দর্য্যে মোহিত সেও। বন্ধু সাবেরের তারই বাসায় বসে নাফিলার সাথে রাত-বিরেতে প্রেমের আলাপ সে দেখে সহ্য করতে পারে না।
এভাবেই চতুর্ভুজ প্রেমের গল্পটি নাটকীয়ভাবে এগুতে থাকে।
হালকা অতিপ্রাকৃত ঘটনার ছোঁয়ায় সামাজিক-রোমান্টিক জনরার বই “নীল ফড়িং”। জামরুল তলার রেল লাইন, নীল ফড়িং, লাল ফ্রক পড়া মেয়ের মতো অতিপ্রাকৃত কিছু ঘটনার দেখা মেলে এই বইয়ে।
এরই সাথে এগিয়ে যায় ঝলমলিয়া গ্রামের কিছু মানুষের জীবনের গল্প। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে পুবাইলের অদূরে ঝলমলিয়া গ্রামের গ্রামীণ চিত্র ফুটে উঠেছে। উঠে এসেছে গ্রামীণ রাজনীতির মারপ্যাঁচ, ষড়যন্ত্র যেখানে কিছু স্বার্থন্বেষী মানুষ নিজেদের ইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্য অন্যের ক্ষতি করতে, জীবন ধ্বংস করে দিতেও কুন্ঠা বোধ করে না।
তবে বেশ প্রমিজিং একটা শুরুর পর বইয়ের কাহিনি ৩৬০° ঘুরে যায়। মতি মিয়ার চায়ের দোকানের ঘটনা সহ পরাবস্তব বিষয়গুলোতে লেখক পরবর্তীতে আর তেমন আলোকপাত করেননি। বইয়ের ফ্ল্যাপে একটা কথা লেখা,“সবকিছুর ব্যাখ্যা হয় না, ব্যাখ্যা খুঁজতে নেই।” বাক্যটার কারণেই হয়তো লেখক আমাদের কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে যাননি।
চরিত্র নির্ভর এই উপন্যাসে লেখক অসংখ্য চরিত্রের অবতারণা করেছেন। প্রধান নারী চরিত্র নাফিলা, যাকে কখনো সাবের, আবার কখনো বেলাল স্যার বারবার আখ্যায়িত করেছে “আত্মমর্যাদাবান” , “ব্যক্তিত্বসম্পন্ন”, বয়সের তুলনায় অনেক বেশি “পরিপক্ক” নারী হিসেবে। আমার কাছে এই চরিত্রটাকে ম্যাচিউরড মনে তো হয়নিই, বরং দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী থেকে এর থেকে বেশি ম্যাচিউরিটি আশা করি। রাত-বিরেতে এক ছেলে ফোন দিল, দুই-একটা মিষ্টিমিষ্টি কথা বললো আর নাফিলা সিদ্ধান্তে এসে গেলে সাবের পরিচয় দেওয়া ছেলেটার নাম আসলেই সাবের, যে কিনা একজন চমৎকার মনের ছেলে। আবার রাতে ফোনে কয়েকদিন কথা হওয়ার পর, দেখা হওয়ার দ্বিতীয় দিনেই সাবেরের বুকে ঝাপিয়ে পড়তে দেরি করেনি নাফিলা। ভালোবাসার সাগরে এমন ডুবই দিয়েছিল যে, সম্পর্কে ফাটল ধরায় সেই সাগর থেকে আর উঠে পর্যন্ত আসতে পারেনি। ডুবে গেছে একদম অতল গহব্বরে। ফলাফল? এসএসসি পরীক্ষায় ফেইল, পাগল প্রায় অবস্থা, পরিবারকে হয়রানি ও অপরিসীম দুশ্চিন্তার সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া। অবশ্য এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে নাফিলার মুখ থেকে গভীর দার্শনিক কথা লেখক বলিয়েছেন লেখক, যা আরোপিত লেগেছে উপরোক্ত ঘটনাপ্রবাহের কারণেই।
আছে, প্রবাসী স্বামী দেবদুলালের স্ত্রী, এলাকার অন্যতম সুন্দরী লক্ষ্মী ভাবি। সুদর্শন সাবেরকে প্রথম দেখায় মনে ধরে তার। ঘটনাক্রমে সাবেরের সাথে কথা হওয়ার পর, দীর্ঘদিনের একাকিত্বের কারণে অন্য চিন্তা মাথায় ঘুরতে থাকে লক্ষ্মীর। পরমুহূর্তেই আবার সাবেরকে নিজের মায়ের পেটের ছোট ভাই ভাবতে শুরু করে। এহেম এহেম...একদিকে “অন্য চিন্তা”, অন্যদিকে ছোটভাই...কেমন হয়ে গেল না?
আরও আছে তোতা ঘটক। একলাছ সাহেবের শালিকা জেবুন্নেচ্ছার সাথে বিপত্নীক চেয়ারম্যানের দ্বিতীয় বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আসেন একলাছ সাহেবের বাড়িতে। জেবুন্নেছাকে দেখার পর তোতা ঘটকও প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিল কিনা বা দৈহিক আকর্ষণবোধ করেছিল কিনা কে জানে। দেখা গেল এরপরে এসে সে নতুন প্রস্তাব দিল যে জেবুন্নেছার সাথে তোতা মিয়ার বিবাহ দিতে রাজি হলে সে তার স্ক্রী কে তালাক দিবে...
এছাড়াও আছে সাবের, আদর্শ, চরিত্রবান, মেধাবী এবং সেই সাথে সুদর্শন ছেলে। টিপিক্যাল নায়ক যেমন হয় আরকি। আরো আছে বেলাল স্যার ও মাখন। এদেরকে নিয়ে বললেও লেখাটা বেশ বড় হয়ে যাবে তাই আর বলছি না। চরিত্রগুলো তেমন মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতো মনে হয়নি।
বইয়ের ক্লাইম্যাক্সে গিয়ে লেখক অনেকগুলো বিষয়কে একসাথে নিয়ে আসতে চেয়েছেন। ফলে বেশ জগাখিচুড়ি হওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দিলেও লেখক বেশ ভালোভাবে সামলে নিয়েছেন এদিকটা, তবে এখানেও আছে প্রচুর নাটকীয়তা, কাকতালীয় ঘটনাবলির মহাসমারোহ।
হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, “অপেক্ষা হলো শুদ্ধতম ভালোবাসার একটি চিহ্ন। সবাই ভালোবাসি বলতে পারে। কিন্তু সবাই অপেক্ষা করে সেই ভালোবাসা প্রমাণ করতে পারে না।” চতুর্ভুজ প্রেমের কারণে গ্রামীণ রাজনীতির শিকার হয়ে সাবের এবং নাফিলাকেও অপেক্ষা করতে হয়েছে, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করতে হয়েছে; তাদের জীবনে নেমে এসেছিল অন্ধকার বিপর্যয়। আর তারপর? কীভাবে ঘুরে দাঁড়ালো তারা? কী হয়েছিল সবশেষে তাদের সম্পর্কের পরিণতি। সেটা জানতে পড়তে হবে বইটি।
সবশেষে আমার কাছে “নীল ফড়িং” পরাবাস্তবতার মিশেলে কোনো সফল উপন্যাস হয়ে উঠতে পারেনি। তবে রোমান্টিক উপন্যাস হিসেবে বেশ অনেকটাই এগিয়ে। লেখকও সম্ভবত একটা প্রেমের গল্পই বলতে চেয়েছিলেন। নব্বইয়ের দশকের শেষে একটি গ্রামের দুইজন ছেলে-মেয়ের যে ভালোবাসার চিত্র তিনি উপস্থাপন করেছেন, যারা এই ঘরনার বই পড়ে তাদের হয়তো ভালো লাগবে।
◑ বই পরিচিতি: ▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬ ➠ বই : নীল ফড়িং ➠ লেখক: আব্দুল্লাহ শুভ্র ➠ প্রকাশনী: কবি প্রকাশনী ➠ পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২১৬ ➠ মুদ্রিত মূল্য: ৩৭৫ টাকা
Read More
Was this review helpful to you?
By Dr Abu Hena Mostofa Farhad,
10 Jun 2024
Verified Purchase
#রকমারি_নীল_ফড়িং_বুক_রিভিউ_প্রতিযোগিতা খুব কাছে এসো না কোন দিন যতটা কাছে এলে কাছে আসা বলে লোকে এ চোখ থেকে ঐ চোখের কাছে থাকা এক পা বাড়ানো থেকে অন্য পায়ের সাথে চলা কিংবা ধরো রেল লাইনের পাশাপাশি শুয়ে অবিরাম বয়ে চলা । তার চেয়ে বরং দূরেই থেকো প্রেমের, গভীর মানচিত্রে যেমন লুকিয়ে থাকে ভালোবাসা, তেমন দূরেত্বেই থেকে যেও এই কবিতার মতো ভালবাসার মানুষের কাছে আসতেও আমার ভয় করে। ভালবাসা না পাবার নাকি ভালবাসার মানুষকে হারানোর; কোনটাকে ভয় বেশি পেয়েছিলাম আজ আর মনে পড়ে না। আমার প্রেমহীন জীবনে স্নিগ্ধ ভালবাসার ছোঁয়া পেতেই তো একদিন ঘুরে এসেছিলাম পুবাইলের ঝলমলিয়া গ্রামে। গ্রামের টঙের দোকানে একদিন সন্ধ্যায় চা খেতে গিয়ে প্রথমবার নীল ফড়িং দেখেছিলাম। টঙের পিছে ছোট্ট একটা নীল ফড়িং আকাশমনি গাছে বসে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। সামনেই দোকানদার মতি মিয়া চা বানাচ্ছিলেন আর স্থানীয় মুরুব্বি একলাছ সাহেব বসে ছিলেন চায়ের অপেক্ষায়। কতগুলো নীল ফড়িং হারিকেনের আলোয় এদিক সেদিক উড়ছিল। একলাছ সাহেব রাতবেরাতে আবারো হারিকেনের আলোয় দেখেছিলেন সেই একই নীল ফড়িং। কিন্তু নীল ফড়িংয়ের সাথে লাল ফ্রক পরা রহস্যময় একটি মেয়েকে দেখে আরো বেশি অবাক হয়ে যান। মেয়েটাকে আমরা কেউ কখনো দেখিনি। একলাছ সাহেব মেয়েটির সাথে কী কথা বলেছিলেন? সবই কি অলৌকিক, নাকি এর মাঝেও লুকিয়ে আছে প্রেম ভালবাসার কোনো অজানা আখ্যান? মিলেনিয়াম সমসাময়িক গ্রামীণ সমাজের এই প্রেমময় কাহিনি আমাদের আশেপাশের তরুনদের কথা বলে, তাদের জীবনে বিনা মেঘে বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ নিয়ে আসা প্রেমকাব্যের সুর তোলে। তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব, পরিবারিক আবহের প্রচ্ছন্ন চিত্রের দেখা মেলে এই উপন্যাসে। ‘নীল ফড়িং’ সাহিত্যের বিচারে পুরোপুরি চরিত্র নির্ভর উপন্যাস। অনেকগুলা চরিত্র এই উপন্যাসের সব কথা বলে; তারা গড়ে তোলে নিজেদের জীবনের চিত্রনাট্য। গল্পটা শুরু হয় একলাছ সাহেবের পরিবার ও তার মেয়ে নাফিলাকে পছন্দ করা তিন তরুণকে নিয়ে। নাফিলাকে কেন্দ্র করে লাটিমের মতো ঘুরতে থাকে বাকী তিন জনের জীবন। নাফিলা ও সাবের উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র হলেও বাকি চরিত্রদের কম বেশি আনাগোনা ছিল পুরো উপন্যাস জুড়ে। নাফিলাকে দেখানো হয়েছে আত্মসচেতন, দৃঢ় চরিত্রের পড়ুয়া ছাত্রী হিসেবে। কিন্তু এমন চরিত্রের মেয়ে হঠাৎ একদিন ফোনে কথা বলে প্রেমে পড়ে যাবে? এখনকার যুগে অনলাইনে প্রেম হতেই পারে। কিন্তু গ্রাম্য পরিবেশে নিজের বাসার সামনে প্রেমিকের সাথে দেখা করা, এত কম সময়ে তাকে জড়িয়ে ধরা কতটুকু প্রাসঙ্গিক? অন্তত নাফিলার মতো চরিত্রের ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী বলতেই হচ্ছে।
ঘটনায় আরো দেখা মেলে নাফিলার শিক্ষক বেলাল সাহেবের। তিনি যেমন নিজের ছাত্রীকে পছন্দ করেন, তার পরিচিত এলাকার সুদর্শন ও মেধাবী ছাত্র সাবেরও নাফিলাকে পছন্দ করে। অন্যদিকে সাবেরের বন্ধু চেয়ারম্যানের বখাটে ছেলে মাখনও একই মেয়ের প্রেমে মত্ত। উপন্যাসে সাবেরকে দেখানো হয়েছে টিপিক্যাল আদর্শ ছেলে, মেধাবী ছাত্র তথা সর্বগুণে গুণান্বিত একজন প্রেমিক হিসেবে। এই ক্লিশে চরিত্রায়ন না করলেই হয়তো বেশি ভাল হতো। গল্পের নায়কের যদি সব গুনই থাকে তাহলে কাহিনির ঘটঘটায় তাকে নিয়ে পাঠক মনে ভয়, উৎকন্ঠা আসবে কীভাবে? অন্যদিকে নাফিলার শিক্ষক বেলাল সাহেব হচ্ছেন সেই মানুষ যিনি ‘বিসিএসের মতো বড় চাকরি পেলে আর গ্রামের স্কুলে পড়াবেন না!’ বাণীতে বিশ্বাসী। একজন অন্তঃসারশূন্য চতুর মানুষের প্রতিচ্ছবি বলা যায় তাকে। তার চরিত্রকে আরেকটু গভীরভাবে দেখলে তার বয়স্ক মনের অস্তিত্বের দেখা মেলে। তিনি নাফিলার ব্যক্তিত্বকে ৪০ বয়সী একজন নারীর সমতুল্য মনে করেন! এটা তার বিকৃত মানসিকতা নাকি নাফিলার প্রেমে দূর্বল মানুষের অবান্তর চিন্তা সেটা বলা মুশকিল।
সাবের এবং বেলাল দুই চরিত্রের ভাল খারাপ দিক বিবেচনায় আনলে স্পষ্টভাবে দেখা যায়; সাবেরকে বেশি ভাল আর বেলালকে বিরক্তিকর একজন মানুষে পরিণত করতে গিয়ে দুটো চরিত্রই বরং আরো হালকা হয়েছে। প্রেমের গল্পে প্রেমিকাকে পাবার জন্য দুটো শক্ত চরিত্র কী উপন্যাসের গাঁথুনি আরো মজবুত করতো না? এই দুজনের বিপরীতে বরং চেয়ারম্যানের বখাটে ছেলে মাখন কুলোর মতো দাঁত খিচিয়ে তার জোর উপস্থিতি জানান দিয়েছে। মদ ও জুয়ায় আসক্ত এই বদখত প্রেমিকপ্রবরের চরিত্রটি ছাপড়ির ছেলেদের সাথে শুধু তুলনা করা যায়। তিনজনের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে বরং নেশাখোর মাখনের চরিত্রায়ন উপন্যাসের সাথে কোনো মতে চলে। এই উঠতি বয়সী তরুণদের প্রেম, পরিণতি, তাদের মনস্তত্ত্ব এবং পারিপার্শ্বিক সামাজিক প্রভাবের কখনো প্রবল, কখনো ঘুমন্ত উপস্থিতি এই উপন্যাসের মূল বিষয়। উপন্যাসে অন্য চরিত্রদের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই, রিটায়ার্ড একলাছ সাহেবের পরিবারের অযাচিত সাংসারিক ঝামেলা। কখনো নিজের স্ত্রীর আচরণে বিরক্ত হোন,কখনো দেখা যায় মসজিদ কমিটির সদস্য মকবুল সাহেবকে নিজের মতো করে খারাপ ভেবে নেন। মধ্যবয়সী লক্ষী ভাবীর চরিত্র দিয়ে অশালীন মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে। লক্ষী ভাবীর চরিত্র কেনো হঠাৎ সাবেরের দিকে কামনার দৃষ্টিতে দেখবে এটার উপযুক্ত কোনো কারন বা ব্যাখ্যা দেখিনি। লেখক কখনো তার গল্পে নিয়ে আসেন তোতা মিয়ার মত এলাকার সুযোগসন্ধানী নিচু শ্রেণীর মানুষের কথা। গল্প উপন্যাসে বেশিরভাগ সময় এলাকার চেয়ারম্যান মাতব্বরদের খারাপ হিসেবে দেখানো হয়। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এতগুলো চরিত্রের আবির্ভাব হয়েছে কালবৈশাখীর মতো, তারা নিজেদের গল্প বলে গেছে টর্নেডোর মতো। চরিত্রনির্ভর উপন্যাসে চরিত্র তৈরীতে যত্নশীল না হবার কারণে গল্পের স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে পাঠকের মনে।
লেখক আব্দুল্লাহ শুভ্র পরাবাস্তুব জগতের খোলসে চিরাচরিত প্রেমের গান গেয়ে শুরুতে গ্রামের মেঠোগলিতে চমৎকারভাবে পাঠককে হাঁটিয়েছেন। গল্পের সাথে পাঠকের এই পথচলা আরো মধুর হতো যদি উপন্যাসের ঘটনাগুলো আরো বাস্তবসম্মত এবং পরিণত হতো; যদি চরিত্রগুলো শুধু প্রেমে সফল হবার চেষ্টায় না থাকতো। দুজন মানুষের ভালোবাসার আখ্যান স্নিগ্ধ, ঘোরলাগা, অদ্ভুত বিষন্নমাখা লাগতো আমার পাঠক হৃদয়ে যদি লেখক কাহিনি পরস্পরায় অলৌকিক উপাদানগুলো আরো সুন্দরভাবে মিশেল করাতেন। উপন্যাসে বর্ণনাভঙ্গিতে মাঝে মধ্যেই হুট করে পরিবর্তন এসেছে। চরিত্রের পয়েন্ট অফ ভিউয়ের এই পরিবর্তন সুপাঠ্য নয়। উপন্যাসের জঁরা অতিপ্রাকৃত ও ভৌতিক বলা হলেও আদতে এটি ‘উনিশ-কুড়ির’ সাহিত্য বললে মানানসই হয়। প্রেমের গল্পে আপনি ভূতকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন বিষয়টা কেমন লাগবে? পরাবাস্তব অংশটুকু খাপছাড়া ভাবে কখনো ছোট্ট মেয়েটার মাধ্যমে, কখনো একলাছ সাহেবের চিন্তার অন্তর্দ্বন্দ্বে, আবার কখনো বা নাফিলার মনস্তত্ব থেকে দেখতে পাওয়া যাবে। লেখকের গদ্যশৈলীতে পরাবাস্তব ঘটনা জমে উঠার আগেই কাঁচা প্রেমের স্পর্শে সেই লেখার রেশ আবার মিইয়ে গেছে। গল্পের শুরুটা যেমন প্রমিজিং ছিল, পরবর্তীতে কাহিনির ধারাবাহিকতা সেভাবে থাকেনি। কাহিনি তার গতিপথ পাল্টে পুরোপুরি উঠতি বয়সীদের প্রেম আর গ্রাম্য সমাজে তাদের অবাস্তব পরিণয় পরিনতিতে শেষ হয়েছে। ‘নীল ফড়িং’ মেটাফোর নাম দিয়ে লেখক অবশ্য শুধু প্রেমের কথা বলতে চাননি। ‘নীল ফড়িং’ আমাদের জীবনের সব সুখ দুঃখের এক মায়াময় মোহনীয় রূপকল্প। যত্নশীল হাতের স্পর্শে হয়তো এই মায়া বাস্তবতায় আলোকিত হয়ে তরুণ পাঠকের মনে জায়গা করে নিতে পারতো। তারপর হয়তো একদিন প্রেমিকের গুটিগুটি হাতে লেখা চিরকুট আসতো বিদেশ বিভূঁই থেকে__ সাদা পৃষ্ঠায় আমি গল্প লিখতে শুরু করেছি, আমি বেঁচে আছি এখনো। তুমি কি এখনো আগের মতই আছো? তুমি কি অপেক্ষায় থাকবে জোৎসনা রাতে? আমার একাকীত্বের গল্পটা শুনতে।
বই: নীল ফড়িং লেখক: আব্দুল্লাহ শুভ্র প্রকাশনী: কবি প্রকাশনী
Read More
Was this review helpful to you?
By Shahriar Nabil ,
10 Jun 2024
Verified Purchase
#রকমারি_নীল_ফড়িং_বুক_রিভিউ_প্রতিযোগিতা
"নীল ফড়িং" একটি সমাজের বহুরূপী চিত্র ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসের গল্পের মাধ্যমে। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে প্রথমে মনে হবে ভাটি অঞ্চল থেকে জোয়ারে ভেসে আসছে গল্পটি। তারপর, একটা চায়ের দোকান, কিছুটা রোমাঞ্চকর, কিছুটা নীরবতার কোলাহল, চাঁদের ম্লান আলোর বয়সি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, বাস্তবতা মোড়ানো চা-দোকানদারের জীবন, নীল ফ্রগ পরা রহস্যের আলো-আঁধারের কিশোরীই গল্পের বর্তমান অথবা ভবিষ্যৎ। অপরিচিত এবং অদৃশ্য আতঙ্কের সামনে কয়েকটি আগন্তুক গাছ। এ নিঃশব্দতায় উপন্যাস তার নিজের গল্প বলতে বলতে আমাদের নিয়ে যাবে এক জাদুবাস্তবতার পৃথিবীতে। আরও উপন্যাসের গল্পটিতে ফুটে উঠেছে কাছের মানুষের দূরে চলে যাওয়া, ভালোবাসাকে ফিরে পাওয়া ব্যকুলতা ইত্যাদি।
▪️বইয়ের থেকে: উপন্যাসের মূল চরিত্র নাফিলাকে ঘিরেই মূলত কাহিনি। যে কিনা এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। শুরুতেই দেখা নাফিলার বাবা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা একলাছ সাহেব। উনি নাফিলাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। পুবাইলের অদূরে ঝলমলিয়া গ্রাম থাকতেন। গ্রামের মতি মিয়ার চায়ের দোকানে একলাছ সাহেব বসে আছেন। রাত্র গভীর চারিদিকে কোনো কোলাহল নেই। কিন্তু তখনই সময় লাল ফ্রক পরা রহস্যময় একটি ছোট্ট বালিকার আবির্ভাব ঘটে এবং তার সেই সঙ্গে কিছু নীল ফড়িং। একলাছ সাহেব পুরোপুরো বিস্মিত হয়ে যায়, লাল ফ্রক পরা রহস্যময় ছোট্ট বালিকাটি আর কেউ নন তার মেয়ে নাফিলা। কিন্তু তার তো একটি মেয়ে নাফিলা তাহলে এই বালিকা কে?
একদিকে গল্পের প্রধান চরিত্র নাফিলা ঝলমলিয়া গ্রামের সুন্দরী কিশোরী। এদিকে সুন্দরী হওয়ায় বিদ্যমান তাকে দেখে প্রেমে পরে যায় এই গল্পের সাবের নামে একজন, সাবের এলাকার মেধাবী ছেলে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। এদিকে সাবেরের সঙ্গে নাফিলার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু এখানেই বেধে যায় সমস্যা তাহলে, এই গল্পের আরও দুটি চরিত্র তা হলো মাখন, যে কিনা চেয়ারম্যানের ছেলে এবং তার শিক্ষক বেলাল মাস্টার! তারাও নাফিলার প্রেমে পরে যায়।
এদিকে সাবেরের বন্ধু ছিল মাখন, যে ছিল চেয়ারম্যানের বখে যাওয়া ছেলে। সে কোনো ভাবেই নাফিলার সাথে সাবেরের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি। সে নাফিলার ভালোবাসা পাওয়ার সবকিছু করতে পারে এবং এমনকি বন্ধুর ক্ষতি সাধন করতেও কিছুপা হবে না। এরই মাঝে মাখন নাফিলাকে সাবেরকে দূরে রাখতে একের পর ফন্দি এঁটে বসে এবং মাখনের ষড়যন্ত্রে পুলিশের হাতেও ধরা পড়তে সাবেরকে। নাফিলা ও সাবেরের ভালোবাসা এই মধুর সম্পর্ক শুরু হতে না হতেই মুহুর্তেই শেষ হয়ে যায় তাদের ভালোবাসা। জীবন বাঁচানোর তাগিদে পরিবারসহ গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসে। একদিকে সাবেরের বাবা মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। একদিনকে ভালোবাসাকে হারানে অন্যদিকে নিজের বাবাকে হারানোর ভয়, সবকিছুই কেমন জেনে সাবেরের কাছে অন্ধকার মনে হচ্ছিল। এভাবেই জীবন নিঃশেষ হয়। বাংলাদেশ ছেড়ে পাড়ি জমায় বিদেশ। দূরে চলে গেলেও তারা তাদের ভালোবাসা বাড়তে থাকে। দু'জন দুইজনকে বেশ ভালই অনুভব করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আসলে কি হয়েছিল নাফিলা ও সাবেরের? তারা কি আবারও একসাথে হয়েছিল? নাফিলা কি ফিরে পেয়েছে তার ভালোবাসাকে? এমন সব হাজারো প্রশ্ন নিয়ে সম্পর্কের এই গল্প চলতে থাকে। নাফিলার বিয়ে ঠিক হয়ে যায় চেয়ারম্যানের ছেলে মাখন সাথে৷ নাফিলার জীবনে মেনে আসে বিষন্নতা ও কালো অধ্যায়। এখানেই কি সব শেষ হয়ে যায়? নাফিলা কি তার ভালোবাসা হারানোর আর্তনাদ ভুলতে পেরেছে? শেষে সাবেরেরই বা কি পরিণতি হয়েছিল? নাফিলা কি ভালোবাসার হারানোর আর্তনাদ ভুলতে পেরেছে? আর এমনই সব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে অবশ্যই এই বইটি পড়তে হবে?
▪️পাঠ প্রতিক্রিয়া: এই উপন্যাসের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর নিুবিত্তের জীবনের নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে উপন্যাসিক আমাদের অনেক কঠিন বাস্তবতার দিকে নিয়ে যেতে থাকে। প্রথমে একটা ভৌতিকতার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের কাহিনি এগোতে থাকে। একটা ঘোর। একুশ শতকের দ্বিতীয় বিশ্বের প্রান্তিক গ্রাম তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ঐশ্বর্য দেখিয়ে দেখিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সবুজ-শ্যামলে ভরা এ প্রাণখোলা গ্রামের কুটিল এবং জটিল সমীকরণগুলোও উঠে আসছে উপন্যাসের ছোট ছোট সাবপ্লটে। এসেছে গ্রামের রাজনীতি, ধর্ম, মানুষ-নির্মিত সামাজিক ব্যাকরণ, স্থানীয় প্রভাব-প্রতিপত্তির মধ্যে থাকা নির্মমতা। উপন্যাসের কেন্দ্র যদিও একটি ত্রিভুজ প্রেম। কিন্তু, এই প্রেমের কাহিনিকে অবলম্বন করে লেখক মূলত তুলে ধরেছেন এমন এক বাস্তবতা- যেখানে ভয় আছে, সন্দেহ আছে; রাজনীতি যেখানে বিষাক্ত সাপ হয়ে নিজেকে ছড়িয়ে রেখেছে।
মানুষ হয়তো জানেই না, মানুষের অন্যায় অনুতাপ, ভয়; কোনো না কোনোভাবে তাকে তাড়া করে বেরাবেই। লেখকের অবচেতনেই তার ভেতরের মানবিক গুণাবলী লেখককে দিয়ে এই ছোট অথচ খুবই প্রয়োজনীয় পাঞ্চলাইনগুলো লিখিয়ে নিয়েছে।
উপন্যাটিতে দেখা যায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বেলাল সাহেব। তিনি নাফিলার ইংরেজির টিচার। শিক্ষক হলেও তার মধ্যে একজন শিক্ষকের নৈতিক যে গুণাবলী থাকা দরকার তার যথেষ্ট অভাব লেখক যৌক্তিকভাবেই দেখাতে পেরেছেন। শিক্ষক হয়ে ছাত্রীর টেবিলের দামি/সুন্দর কলম চুরির লোভ সামলাতে না পারা শিক্ষকই যে এই উপন্যাসের ভিলেন হবেন তা প্রথমেই বুঝা গেল। এই চুরিই তার চরিত্রের মাপকাঠি হতে পারে। হয়েছেও তাই। সে ছাত্রীকে শিক্ষকের চোখে না দেখে দেখেছেন (ভালোবাসার লেবাসে) কামনারই চোখে। এই শিক্ষকের কূটচালে উপন্যাসের নায়ক-নায়িকার জীবন নরকে পরিণত হয়। উপন্যাসের এই শিক্ষক চিরত্রই দেখিয়ে দেয় যে, শিক্ষক যদি শিক্ষকের গুণাবলী সম্বলিত না হয় তাহলে জাতির জীবনে অনেক ক্ষতি নেমে আসতে পারে।
ভোগের কামনা, ক্ষমতা আর অবৈধ টাকার প্রভাবে মত্ত চেয়ারম্যানের বখাটে ছেলে মাখন। মাখন তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেধাবী বন্ধু নাবিল আর তার প্রেমিকার জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। অন্যায়-অনিয়ম আর প্রকৃত শিক্ষার অভাবে সমাজ কতটা ভেঙে পড়তে পারে তা এই উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্রের মাধ্যমে লেখক সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন।
পুরো উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে পাঠক এক ভয়াবহ জর্নির শিকার ঠিকই হবেন। তবে, সবকিছুর পরে সত্যই যে টিকে যায় তা দেখে যে কোনো পাঠকের হতাশা কেটে যেতে পারে। আর প্রকৃত প্রেমিকা যদি তার প্রেমের সত্যকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে সেও যে শত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ভালোবাসা পায়; তারও প্রমাণ লেখক উপন্যাসে দিয়েছেন। উপন্যাসটি এমন একটি জার্নি যেখানে গল্প আছে, সমাজের কোথায় কোথায় কী কীভাবে সমস্যা রয়েছে চরিত্রের মধ্যে তা দেখানো আছে। আছে এসব থেকে উত্তরণের পথ এবং দৃঢ সংকল্পের দৃষ্টান্তও। এই উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে। যারা রোমান্টিক বা সামাজিক জনরার বই পছন্দ করেন আশা করি তাঁদের ভালো লাগবে।
▪️বইয়ের প্রোডাকশনঃ বইটির প্রচ্ছদ এবং অন্য সব দিক আমার কাছে খুবই ভালো লাগছে। বইটিতে লেখক সবগুলো চরিত্রকে অত্যন্ত নিখুঁত ও সুন্দর ভাবে বর্ননা করেছেন। তবে বইটিতে কিছু বানান ও বেশ কিছু শব্দের ব্যবহারে ঘাটতি রয়েছে। পরবর্তীতে আশা করি এসব দিকে লক্ষ রাখবেন।
"আমার হৃদয়ের আকাল অনবদ্য সক্ষমতার! কোন সে নক্ষত্র বিবেকের মতো হারিয়েছে শূণ্যতার অসীমে-- আকাশের নীলাভ উৎসবি দেহে..."
পুবাইলের অদূরে ঝলমলিয়া গ্রাম। রিটায়ার্ড ব্যাংকার একলাছ সাহেব শীতের রাতে মতি মিয়ার দোকানে চা খাচ্ছিলেন। এসময় আবির্ভাব ঘটে এক রহস্যময় বালিকার। সে এসে দাবি করে তার নাম নাফিলা। মেয়েটির পিতার নাম, পরিচয় একলাছ সাহেবের সাথে সম্পূর্ণ মিলে যায়। আশেপাশে নীল ফড়িং উড়তে থাকা কে এই ছোট শিশুটি? কী তার আসল পরিচয়?
**স্পয়লার এলার্ট**
Life is more than a drama. সে ড্রামাকেই লেখক আরো বেশি ড্রামাটাইজ করে লিখেছেন।
উনিশ শতকের শেষ দিকের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটি লেখা হয়েছে। একজন এসএসসি পরীক্ষার্থী নাফিলা; যে কিনা তার পড়াশোনাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা, সে অনার্স প্রথম বর্ষের একজন ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রের সাথে অপরিপক্ব প্রেমের নিদর্শন এ বইটি।
নাফিলা সাবেরের প্রেমের ব্যাপারটা বেশ বেখাপ্পা লেগেছে। সাবের কোথা থেকে নাফিলার টেলিফোন নম্বর পেয়েছে আমার সে ধারণা নেই। টেলিফোন কলে দু তিনদিনের কথাবার্তায় প্রেম হয়ে যায়। সাবের ভোরবেলা নাফিলার সাথে দেখা করতে যায়। কলিংবেল চেপে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্যদিন গেটের ভেতর ঢুকে নাফিলাকে জড়িয়ে ধরে থাকলেও পরিবারের কেউ দেখছে না- এটা খুব অস্বাভাবিক লেগেছে।
বেলাল স্যার নামে নাফিলার যে ইংরেজি শিক্ষকের উল্লেখ আছে সে নিঃসন্দেহে একজন লম্পট চরিত্র। সাবের এবং নাফিলার সম্বন্ধে জেনেও নাফিলাকে যেকোন উপায়ে নিজের করে নিতে চেষ্টায় কোন ত্রুটি রাখেন নি।
নাফিলা চরিত্রের সবচেয়ে অস্বাভাবিক বিষয় ছিল তাকে বারংবার আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বলা হয়েছে। অথচ তার চরিত্রে তেমন কোন বৈশিষ্ট্য ফুটেই ওঠেনি। এসএসসি পরীক্ষার আগে অবিশ্বাসের জের টেনে সম্পর্কের ইতি হয়। তার পরীক্ষার ওপর যে প্রভাব পড়েছে সেটা খুবই বিরক্তিকর লেগেছে। পরীক্ষা খারাপ দিয়ে এসে বাকি পরীক্ষা এটেন্ডই করেনি! প্রেম মানুষের জীবনের একটা অংশ। এটাকেই ধ্যান জ্ঞান ধরে নিজের জীবনের যে ক্ষতি করেছে সেটা আত্মমর্যাদার পরিবর্তে মাথায় ঘিলু না থাকার প্রবল লক্ষণ প্রকাশ করে।
এক বছর ড্রপ দিয়ে পরবর্তী বছরে পরীক্ষায় এটেন্ড করে পাশ করে ঠিকই। কিন্তু এক বিচ্ছেদের কারণে যে অসুস্থতা তাকে গ্রাস করে তার ভার বয়ে চলতে হয় সারাজীবন।
একদিনের বোটানিক্যাল গার্ডেনের ঘুরতে যাওয়ায় তাদের প্রেমের গাঢ়ত্ব এতোটাই বেড়ে গেল যে বছরের পর বছর সেই অনুভূতি উতরে উঠতে পারছেনা?
খালা জেবুন্নেছা চরিত্র ছিল কিছুটা অস্বাভাবিক। একলাছ সাহেবের পরিবারে তার স্ত্রী তাহেরুনেছা ও শ্যালিকা জেবুচ্ছেছার আচরন ছিল খাপছাড়া। অভিভাবক হিসেবে নাফিলার জীবনে এগিয়ে যাওয়ার আশা না জুগিয়ে খালা সাবেরের সাথে মিটমাট করে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছিলেন।
সাবেরের বন্ধু মাখনের সাবেরের প্রেমিকাকে পছন্দ হচ্ছে, চৌধুরী সাহেবের জন্য জেবুনেচ্ছার কাছে প্রস্তাব পাঠাতে গিয়ে কাজীরই পাত্রীকে পছন্দ হচ্ছে, নিজ স্ত্রীকে তালাক দিয়ে জেবুন্নেছাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে।
মাখনের মাঝে চরিত্রের দোষ সর্বপ্রকারে প্রকাশ পেয়েছে। ঈর্ষা থেকে বন্ধুর প্রেমিকাকে পটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু এতো নারী সংসর্গে থেকেও নাফিলাকে বিয়ে করতে চাওয়ায় তার দৃৃঢ়তার পেছনে যুক্তি কী?
লক্ষ্মী নামে এলাকার হিন্দু একজন 'ভাবী' চরিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। সে নিজ স্বামীকে খুব ভালোবাসেন। একইসাথে সাবেরের প্রতি কিছুটা দুর্বল, ক্ষণে ক্ষণে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অবৈধ সম্পর্কের অপবাদ তুলতে ইচ্ছা হয় তার। আবার বলছেন এমন ভাই থাকলে ভালো হতো।
বিচ্ছেদে নাফিলা পাগলপ্রায়। মাখনের সাথে তার বিয়ে হয়, কিন্তু বিয়ের দিনের যে নাটকীয়তা - তা বইয়ের অন্য সবকিছুকে হার মানাবে।
১ম বর্ষে থাকাকালেই সাবের পাড়ি দেয় বিদেশ। তার সেখানে গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়। নাফিলা এতো বছর নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়েও তার অপেক্ষায় থাকে।
দ্বিগুন নাটকীয়তা যুক্ত করে বেলাল স্যারের মাধ্যমে সাবের নাফিলার ফোনে যোগাযোগ হয়। এর পরদিনই সাবের দেশে চলে আসে। অথচ বিদেশে তার সদ্য চাকরি, সে ছুটির আবেদন করারও কোন প্রয়োজন বোধ করেনি।
দেশে ফেরত আসছে ভালো কথা, এর মাঝে আরেক মারপ্যাচ। তাদের ফ্ল্যাটে ইন্ডিয়ান আরেক ব্যক্তি ছিল সাবের নামে। ফ্লাইটের দিন উনি এক্সিডেন্টে মারা গেলে সুপারভাইজার দেশে জানায় সাবের মারা গেছে। ততক্ষণে নাফিলা শোকে কাতর হয়ে ট্রেন লাইনে যায় আত্মহত্যা করতে। এসময়ই সাবের আসে। সেই ছোট নীল ফড়িং উড়তে থাকা বালিকা তখন এসে সাবেরকে পথ দেখিয়ে ট্রেন লাইনের কাছে নিয়ে যায়। (এ ছোট মেয়েটির এতো বছরে বয়স বাড়েনি।) কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে যে নাফিলার লাশ দেখতে হতো, সাবেরের হ্যাঁচকা টানে সে বেঁচে যায়। অতঃপর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে শুরু করে।
পাঠপ্রতিক্রিয়া: আমার এটুকুর জীবনে যতো নাটক, ড্রামা, মুভি, সিরিজ দেখেছি কিংবা যত বই পড়েছি - সব মিলিয়েও এ নাটকীয়তাকে টক্কর দিতে পারবে না। প্রতি পাতায় পাতায় টুইস্ট। টুইস্টে টুইস্টে মাথা ঘুরে গেছে।
আমি এখনো টিনেজার। কিন্তু তাদের অপরিপক্ব প্রেমের কাহিনী পড়ে প্রতিটা মুহূর্তে মেজাজ ঠিক রাখা দায় হয়ে পড়ছিল। তবে যাদের ন্যাকা ন্যাকা প্রেম কাহিনী পড়তে ভালো লাগে তারা পড়ে দেখতে পারেন।
নীল ফড়িং নামটা লেখক কেন দিয়েছেন তা তিনিই ভালো জানেন। বইয়ের শুরুতে ছোট বালিকার মাধ্যমে যে খাপছাড়া অতিপ্রাকৃত রহস্য ঢোকানো হয়েছে, গল্পের শেষ অব্দি যেন এর জের টানতেই আর কোন যুক্তি ছাড়াই নীল ফড়িং উড়োউড়ি নিয়ে এন্ডিং দিয়েছেন।
লেখকের লেখার ভাষা খুবই নাজুক। প্রতিটা কথার অপ্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। যেমন- 'বিপদে আপদে সাবেরের এড্রেনালিন হরমোন অতি দ্রুত নিঃসরণ হয়। এ হরমোনকে বলা হয় বিপদমুক্তির হরমোন। মানুষের শরীরে এই হরমোন নিঃসরণ হয় বলেই বিপদ আপদের সময় মানুষ উপস্থিত বুদ্ধি তৈরি করতে পারে এবং একসময় বিপদ কাটিয়ে ওঠে। সাবেরের একটি বিরল প্রজাতির দোষ কিংবা গুণ যাই বলা হোক না কেন তা হচ্ছে, যেকোনো নেগেটিভ নিউজকে অতি দ্রুত একসেপ্ট করে ফেলা, খুব একটা যাচাই বাছাই না করে তা বিশ্বাস করে ফেলা।.... অত্যন্ত কোমল এবং বিশ্বাসী হৃদয়।'
উদ্ভট ভাবগম্ভীর কথাবার্তা মেজাজ খিচড়ে দিয়েছে। কেবল টাকা দিয়ে কিনেছি বিধায় ব্যালকনি দিয়ে বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারছি না। পুরো গল্পে ভালো লাগার মতো একটা কিছুই পাইনি। প্রায় বছর তিনেক পরে কোন বই পড়ে পুরো সময় নষ্ট ফিল হচ্ছে।
ওভারভিউ শুধুই -- 'গোঁজামিল গোঁজামিল'।
প্রোডাকশন: প্রোডাকশন কোয়ালিটি ভালোই বলা চলে। প্রচ্ছদ ভালো লাগেনি। বইয়ে দু'একটা বানান ভুল ছিল। পড়ার সময় সম্পাদনার অভাব বেশ ভালোভাবেই পরিলক্ষিত হয়েছে।
#রকমারি_নীল_ফড়িং_বুক_রিভিউ_প্রতিযোগিতা ‘ভালবাসার মৌলিক প্রাণশক্তি এই মুগ্ধতা। অপার ভালোবাসায় অন্তর থেকে তৈরী মুগ্ধতা একটি অলৌকিক চেম্বারে সংরক্ষিত থাকে।’ এক জীবনে শত আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মাঝেও প্রত্যেকেই ভালবাসা পেতে চায়, কিন্তু সবার জীবনে কী প্রেম আসে? ভালবাসার সবচেয়ে গভীরতম স্তর হলো প্রেম। যৌবনে আমরা প্রথম প্রেমের স্বাদ পাই। হয়তো প্রেমের ফাগুনে এত ফুল ফোটেনি, যত সুর আছে রবীন্দ্র সঙ্গীতে। তবুও প্রিয়ের হৃদয়ে ভালবেসে বসে আছে তার বসন্তপথিক। কারো জীবনে একবারই প্রেম আসে, কারো জীবনে হয়তো আসে একাধিকবার। একই সঙ্গে একাধিক প্রেম আসলেও সবার সাথে সম্পর্কগুলো অবশ্যই প্রেম নয়, অন্য কিছু। প্রেম কখনো আমাদের জীবনে ফুলের সুবাস নিয়ে আসে; কখনো তার বিপরীতে নিয়ে আসে অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব। এই প্রেমের মাঝে অন্য কারো একতরফা ভালবাসা প্রেমিক যুগলের জীবনে বিষের কাঁটার মতো বিঁধতে পারে। আলোচ্য উপন্যাস ‘নীল ফড়িং’ আব্দুল্লাহ শুভ্রের লেখা অলৌকিক ঘটনার ছোঁয়ায় মিষ্টি প্রেমের গল্প। অলৌকিক ঘটনা দিয়ে শুরু হয়ে উপন্যাসে উঠে এসেছে ভালোবাসা পাবার কাঙাল গুটিকয়েক যুবার জীবন রহস্য। উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ শুরু হয় পৌষ মাসের এক ভীষণ শীতে একলাছ সাহেবের অচেনা এক মেয়ের সাথে কথা দিয়ে। অদ্ভুত এই মেয়েটিকে দেখার পর থেকেই তার মনে অজানা আতঙ্ক কাজ করে নিজের মেয়ে নাফিলার জন্য। ওই মেয়েটি নাকি পূর্বে আরেক ভদ্রলোকের সাথে কথা বলেছিল। পরদিন সেই লোকের মেয়েটা ডুবে মারা যায়। কী ভয়ংকর সর্বনাশা কান্ড ভাবতে ভাবতে একলাছ সাহেব বাসায় ফিরে যান। এরপর ঘটতে থাকে অদ্ভুত সব কান্ড। টিনের চালে ঢিলের শব্দে সবাই আতংকিত হয় আবার নাফিলার শোবার ঘরের বড় জানালার পাশে করমচা গাছের ডাল ভয়ংকারভাবে নড়চড়া করে। এসব কী ভৌতিক কোনো ঘটনা নাকি এর পিছনে অদৃশ্য কোন অপশক্তি রয়েছে? সবই রহস্য রয়ে যায়। ‘নীল ফড়িং’ উপন্যাস আমাদের সমাজের আশেপাশের মানুষদের গল্প বলে। শহুরে পরিবেশ থেকে দু’চোখ সরিয়ে গ্রামীণ সমাজে মনোযোগ দিলে তাদের জীবনে আবহমানকাল ধরে চলে আসা সামাজিক সমস্যাগুলো উপন্যাসে দেখা মেলে। একলাছ সাহেবের মতো গ্রামের সম্মানিত ব্যক্তি নিজের আত্মসম্মানের ভয়ে অশিক্ষিত চেয়ারম্যান ও তার সমর্থকদের চাপে গুটিয়ে পড়েন। উপন্যাসের অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই, একলাছ সাহেবের মেয়ে নাফিলা তার প্রিয় মানুষ সাবেরের মনে নির্মল প্রজাপতি রূপে ধরা দিয়েছে । বর্ষার আকাশ জুড়ে চলে আসা মেঘেদের মতো হঠাৎ একদিন নাফিলার মন জয় করে নেয় এলাকার মেধাবী ছাত্র সাবের। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই শিক্ষা ও চাকরির জন্য সংগ্রামে ব্যস্ত থাকে। তারা সব সময় শহরমুখী হবার চেষ্টায় রত। তাদের এই জীবনের মাঝে যখন প্রেম ও সামাজিক বাঁধা চলার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় সেটা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে অসহনীয় করে তোলে।
লেখক সাবেরকে দেখিয়েছেন একজন প্রাণবন্ত ও খোলা মনের মানুষ হিসেবে। নিজের ক্যারিয়ার নিজে সচেতন এই যুবক মানবতাকে জীবনের সবচেয়ে বড় ধর্ম মনে করে। নিজের সমস্ত ভালবাসা ও হৃদয়ের লাবণ্যের ফোয়ারা নাফিলার জন্য নিবেদিত। একই সাথে বিদ্রোহী ও অভিমানী মনে হওয়ায় নাফিলার সাথে প্রেমে ঝামেলা হবার পর মানসিকভাবে অস্থিরতা দেখা দেয়। ব্যক্তিত্ববোধ ও মানসিক টানাপোড়নে তাদের সম্পর্ক ভাঙনের দিকে নিয়ে যায়। দুজনের দূরত্ব বাড়ার কারনে নাফিলা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। তাদের প্রেমহীন হৃদয়ের অব্যক্ত অনুভূতিকে লেখকের চোখে দেখলে,ভালোবাসার মৃত্যু অনেকটা তারার মৃত্যুর মতো। অন্যদিকে সাবেরের বন্ধু মাখন, নাফিলার সঙ্গে সাবেরের এই সম্পর্ককে মেনে নিতে পারে না। মাখন নিজেও নাফিলাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। মাখনের কূটকৌশলে প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্কে ফাটল ধরে। তৃতীয় আরেকজন নাগর হচ্ছেন নাফিলার গৃহশিক্ষক বেলাল মাস্টার। নাফিলাকে ভালোবাসতে গিয়ে ছাত্রী-শিক্ষক সম্পর্ক ঘোলাটে করে ফেলেন।
জীবন সংগ্রামে আমরা প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছি। একজন ছাত্র তার জীবন সংগ্রাম যেভাবে শুরু করে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক কর্মক্ষম মানুষের জীবন সংগ্রামে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চলে। এই সংগ্রাম শুধুমাত্র সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য নয়, ভালোবাসার মানুষকে নিজের কাছে পাবার সংগ্রাম ও বটে। লেখক আবদুল্লাহ শুভ্র ‘নীল ফড়িং’ উপন্যাসে বিভিন্ন মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের জীবনের চাওয়া পাওয়া বিষয়গুলো তুলে এনেছেন। একজন শিক্ষিত যুবকের প্রেমে তার রুচিসম্মত ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন থাকে। সাবেরের মান-অভিমান চলে নাফিলার সাথে সামান্য বিষয় নিয়ে। নাফিলার সাথে সাবেরের সম্পর্ক হয়েছে অস্বাভাবিক দ্রুততায়। দুজনের চরিত্র গঠনের আগেই তাদের প্রেম হয়ে যাওয়া তাদের অনুভূতিগুলা অনুভব করতে পাঠকের বেগ পেতে হবে। আপনি অবশ্যই একজন মানুষের অতীত, বর্তমান নিয়ে পাঠকের মনে ধারণা দিয়ে তারপর তাকে নিয়ে চলতে চাইবেন? তাই নয় কী? নাহলে চরিত্রের সাথে একাত্ম হতে পারে না পাঠক। এখানে দেখানো হয়েছে প্রেমে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি সব সময়ই বিনামেঘে বজ্রপাতের মত বিপদজনক। মাখনের মতো বখাটে যুবক তাদের প্রেমের জগৎ কলুষিত করে ফেলে, সমাজে আরো মানুষের কাছে ছোট করে ফেলে। লক্ষী ভাবিকে ব্যবহার করে সাবেরের চরিত্রে কালিমা লেপে দেয় মাখন। অন্যদিকে বেলাল মাস্টার নিজে নাফিলাকে পেতে বেইমানি করে সাবেরের সঙ্গে। লক্ষী ভাবির চরিত্রায়ন কাহিনিতে একদম বিচ্ছিরি লেগেছে। বেলাল মাস্টার ও সাবেরের চরিত্রায়নও গৎবাঁধা বলা যায়। মাখন আরেক ধাপ এগিয়ে একবারে পঁচা নষ্ট চরিত্র। উপন্যাসের সবগুলো চরিত্রের উপস্থাপনা একটু বেশি রোমান্টিক অ্যাঙ্গেলে দেখানো হয়েছে। লেখকের অনেকগুলা চরিত্র তৈরি করেছেন, তাদের সম্পর্কের অলিগলিতে পাঠককে ঘুরতে দিয়েছেন। কিন্তু সবই কানাগলির মতো শেষ হয়েছে এক বদ্ধ রাস্তার মোড়ে।
ভৌতিক আবহে লেখা বলা হলেও এই উপন্যাসের মূল কাহিনিতে শুধু প্রেমের গল্প রয়েছে। একটি পরিপূর্ণ সমকালীন উপন্যাস হতে গিয়েও হয়নি শুধুমাত্র চরিত্রগুলির একমুখী দৃশ্যায়নের জন্য। লেখক কাহিনিতে একটি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন বিখ্যাত কবি টি.এস.এলিওটের কবিতা Fire Sermon কবিতা মধ্যে….. Burning burning burning burning Oh lord Thou plukest me out টি.এস.এলিয়ট আমাদের মনে করিয়ে দেন যে আমাদের আত্মার দূর্দশার কারন আমাদের চারপাশেই রয়েছে। আমরা যে বইগুলি পড়ি, যেখানে আমরা বাস করি, আমরা যে সঙ্গীত শুনি সব কিছুতেই তার দেখা মেলে। আর আমাদের এই সমাজ, সংস্কৃতি কেবল তখনই বেঁচে থাকতে পারে যখন আমরা সেটা নিজেদের মনে গেঁথে নিতে পারি। প্রেম ভালবাসাও তেমনি আমাদের অন্তরের সৌন্দর্য। সুন্দর, বিশুদ্ধ প্রেম আমাদের জীবনে সুখ আনে, আমাদের বেঁচে থাকার আশা দেখায় সামনে এগিয়ে যাবার জন্য।
বই: নীল ফড়িং লেখক: আব্দুল্লাহ শুভ্র প্রকাশনী: কবি প্রকাশনী