"মুক্তিযুদ্ধের গল্প" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম অধ্যায়। বাঙালির সহস্র বছরের ইতিহাস মূলত পরাধীনতার। প্রাচীনকাল থেকে বাঙালিকে শাসন তথা শােষণ করেছে সেন, তুর্কি, মুঘল ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি। এই ঔপনিবেশিক মনােভাবের সর্বশেষ শক্তি ছিল পাকিস্তান। বাংলাদেশের প্রকৃতিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা। পালা-পার্বণে, কৃষ্টিতে-পুণ্যাহে, বৃষ্টিতে, রােদুরে, ডাঙায়, জলে, মাঠে-ঘাটে, ঘরের আঙিনায় নানা জাতি-ধর্মের-বর্ণের মানুষেরা রচনা করেছেন এক সুখের স্বর্গ। কিন্তু শত অত্যাচার-অনাচার করেও এদেশের মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে শােষক পাকিস্তানিরা ধ্বংস করতে পারেনি। বরং জন্ম-মৃত্যুর অকৃত্রিম বন্ধনে আবদ্ধ বাঙালি সত্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা জেগে উঠেছে আরাে ইস্পাত-কঠিন হয়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পরে দুই রাষ্ট্র সৃষ্টি হয় ভারত ও প্রায় দুই হাজার মাইলের ব্যবধানে দুইটি প্রদেশ নিয়ে নবগঠিত পাকিস্তান। একটি হলাে পশ্চিম পাকিস্তান অন্য পূর্ব পাকিস্তান। আবার তাদের মাঝে জাতিসত্তার মানুষের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। তকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন-শােষণ, অত্যাচার, নির্যাতননিপীড়ন ছিল সীমাহীন। তাই পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ বাঙালি জাতি শুরু থেকেই অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে নামে। পশ্চিম পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে বাঙালি জাতি আন্দোলন গড়ে তােলে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে হঠাৎ করে হামলা চালায় বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সেদিন মানুষ যখন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিল তখনই নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর রাইফেল, মেশিনগান ও ট্যাংক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদাররা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কাপুরুষের মতাে আক্রমণ করে। তাদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিরােধ গড়ার তাৎক্ষণিক কোনাে সুযােগ কারাে ছিল না। তবে ঢাকায় ইপিআর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে দু'টি বাহিনী পাল্টা আক্রমণ করে, তাদের হাতে কিছু অস্ত্র ছিল। কিন্তু সার্বিক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত সুসজ্জিত একটি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এ পাল্টা আক্রমণ বেশিক্ষণ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু বাঙালি তাে হার-মানা জাতি নয়। বাঙালিরা জেগে ওঠে দুর্বার সংগ্রামে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা যুদ্ধ। শান্তিপ্রিয় বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা দুর্ধর্ষ মুক্তিযােদ্ধা এবং অসম সাহসী গেরিলায় পরিণত হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িয়ে আছে এদেশের ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, রাজনীতিক, সৈনিক, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, হিন্দু-মুসলিম, খ্রিস্টান-বৌদ্ধসহ সব শ্রেণির মানুষের রক্তদানের স্মৃতি। এখানে একটি বিষয় বলা প্রয়ােজন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে প্রায় পুরাে জাতি অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিছু চিহ্নিত বিশ্বাসঘাতক ছাড়া দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এদেশের মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ন্যায়ের জন্য, সত্যের জন্য, মানবতার জন্য। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্ব। আমাদের অহংকার। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্থায়িত্বকাল ছিল মাত্র নয় মাস। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে নয় মাসে ত্রিশ লক্ষ নিরীহ মানুষের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, দুই লাখ নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন, এক কোটি মানুষকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা, কয়েক কোটি মানুষকে অভ্যন্তরীণভাবে স্থানচ্যুত করা এবং শত শত জনপদে ধ্বংসের তাণ্ডব এ ধরনের নজির মানব জাতির স্মরণকালের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এদেশের কবি ও কথাসাহিত্যিকরা বেশকিছু গল্প, কবিতা-ছড়া এবং উপন্যাস লিখেছেন। ফলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকালীন জীবনযন্ত্রণার বিভিন্ন দিক অবলােকন করতে পারবে রূপায়িত প্রবীণ ও নবীন গল্পকারদের মাধ্যমে। যা নিঃসন্দেহে আমাদের সাহিত্যের জন্য একটি বড় সুসংবাদ।
শহীদ পরিবারের সন্তান লেখক রফিকুল ইসলাম । 1966 সনের 1 ফেব্রুয়ারি নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুরের নওয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । শৈশবে 1971 সনের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর একমাত্র চাচা শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আরজ আলী বীরোচিতভাবে শহীদ হন, যিনি ছিলেন নিজ পরিবার এবং এলাকাবাসীর স্বপ্ন । অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হতে দেখেন তাদেঁর বাড়িঘর। তাঁর পারিবারিক এই ট্রাজেডি/বিয়োগ-ব্যাথা নিয়ে রচিত হতে দেখেন বাউলগান ও গীতিকবিতা। তখন থেকেই উপলব্ধি করতে শেখেন- মুক্তিযুদ্ধে খুবই মর্মন্তুদ ও বীরোচিত এক ঘটনা ঘটে গেছে তাদেঁর পরিবারে, যার উপলব্ধি ও মূল্যায়ন রয়েছে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সর্বসাধারণের মধ্যে । তখন থেকেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন- বড় হয়ে তিনিও লিখবেন মহান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বস্তুনিষ্ঠ উপাখ্যান । যার ফলশ্রুতিতেই লেখকের এময়ের সৃষ্টি সাড়াজাগানো মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস 'একাত্তরের বিষাদ সিন্ধু'। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন- ত্রিশ লক্ষ শহীদ পরিবারে ঘটে যাওয়া কাহিনীগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে ট্র্যাজিক সাহিত্যের উপাদান, আর দেশপ্রেমিক প্রতিটি শহীদ এ জাতির শ্রেষ্ঠ বীর । এ উপন্যাসটি লেখকের প্রথম গ্রন্থ হলেও লেখালেখির জগতে তিনি নতুন নন। কৈশোর কাল থেকেই তিনি ছড়া ও কবিতা লিখতেন দেশ-বিদেশের রেডিওর সাহিত্য আসরে, শিশু পত্রিকায়, সাপ্তাহিক বিচিত্রায় এবং লিটল ম্যাগাজিনে। অধ্যাপনা পেশায় থেকেও তিনি দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক জনকণ্ঠ ও বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়ায় মুক্তিযুদ্ধ, অর্থনীতি, পরিবেশ-প্রতিবেশ, সমাজ ভাবনা ও ভ্রমণ বিষয়ে দীর্ঘদিন যাবত কলাম/নিবন্ধ লেখক । গদ্য সাহিত্যে তাঁর লেখার সাবলীলতা ও স্বকীয় ছন্দময়তা পাঠককে মোহাবিষ্ঠ করে তুলে । এটি তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও আকর্ষণ। যা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস 'একাত্তরের বিষাদ সিন্ধু'র শুরু থেকে শেষ পর্যন্তও । আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস- এ লেখকের লেখা সর্বদাই পাঠকদের কাছে সমাদৃত হবে ।