সনাতন শিকারি বাঘ শিকারের গল্প যত সহজে বলা বা লেখা যায়, প্রকৃত ব্যাপারটা তার চাইরের অনেক গুণ কঠিন। বিশেষত ধূর্ত নরখাদকের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা যে কী ভয়ানক, যাঁরা জিম করবেটের গল্প পড়েছেন অনুধাবন করতে পারবেন। আমার জানা এক ভদ্রলোক গাছের উপর বসে বাঘ শিকার করতে গিয়ে নীচে জাঁদরেল এক রয়্যাল টাইগার দেখে গুলি করবেন কী, তাঁর হাত থেকে উদ্যত রাইফেল নীচে পড়ে গিয়েছিল। এ-ঘটনা ঘটেছিল সুন্দরবনে। তিনি নিজেই আমায় বলেছিলেন, সেই নিস্তব্ধ বনভূমির মধ্যে বিকেলের পড়ন্ত আলোয় কালান্তক যম-সদৃশ সেই বিশাল প্রাণীটিকে এত কাছ থেকে দেখে তাঁর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল। ভদ্রলোক কিন্তু একেবারে আনাড়ি নন। বাঘ
"জল জঙ্গল নরখাদক সমগ্র-১" শিশির বিশ্বাসের বন ও বন্যপ্রানীদের নিয়ে লেখা মোট তেইশটি গল্পের সমাহার। বেশিরভাগ গল্পেরই পটভূমি সুন্দরবন। সুন্দরবনের জেলে, মউলে (মধু সংগ্রাহক), বাউলে (বাঘ তাড়ানোর ওঝা) সহ নানাবিধ খেটে খাওয়া বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের কষ্টকর আর বিপজ্জনক জীবনযাত্রাকে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর গল্পের মাধ্যমে। বইটি কিছু ক্ষেত্রে চমৎকার বৈশিষ্ট্যের ছাপ রেখেছে। যেমন -
১. সুন্দরবন মানেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আর সাথে বাঘে-মানুষে মরণপণ টক্কর। যা আমাদের কাছে রোমাঞ্চকর হলেও সুন্দরবনের জেলে মউলেদের কাছে ডালভাতের মত নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রতিবছর কত যে লাশ ঝরে, কত যে ছেঁড়া পতাকা ওড়ে দ্বীপগুলোতে আর কত যে সংসার কর্তা হারিয়ে দেউলিয়া হয় তার হদিস কে রাখে! তবে এই সংঘাতের ঘটনাগুলো ঘুরেফিরে এক মনে হলেও আসলে তা না, কিছু না কিছু বৈচিত্র্য থাকেই। শিশির বিশ্বাস তাঁর লেখায় এই বৈচিত্র্য টা একদম পাকাপাকি ভাবে তুলে ধরেছেন -
বাঘবন্দি মন্তর (মন্ত্রের চেয়েও শক্তির দাম বেশি) মউলে বাঘ (বাঘের ওপর টাগ (মৌমাছি)) বাদাবনের কাঁকড়া (বাঘ বনাম কাদা) হেঁতালবাড়ি (বাঘ বনাম হেঁতালের লাঠি) মউলের দুশমন (বাঘ বনাম একরোখা চার মউলে) হাটুরে বাঘের হাহাকার (জালে বাঘ ধরা) বৈকুন্ঠ বাউলে (হাপরে বাঘ ধরা) গর্জনের দিন (বাঘের দৃষ্টিতে লেখা গল্প) জঙ্গলের মধ্যে রত্নপুরী (একটু প্রত্নতাত্ত্বিক এডভেঞ্চার, আধটু বাঘ)
বোঝাই যাচ্ছে গল্পগুলি কেবল বাঘ এলো আর মানুষ খেলো তেমনটা নয়। অনেক বৈচিত্র্য আছে প্রতিটা গল্পে।
২. বাঘের পাশাপাশি সুন্দরবনের দ্বিতীয় আকর্ষণ কী? অবশ্যই লোনা পানির কুমির। সুন্দরবনের ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষেই খাটে সেই বাগধারা "জলে কুমির ডাঙায় বাঘ"। এবং শিশির বিশ্বাসও তাঁর বৈচিত্র্যের প্রকাশ কুমিরের ক্ষেত্রে করেছেন আরো বেশিভাবে-
কুমড়োচেরা কুমির (সুকৌশলে কুমির বধ, কৌশলটা কী তা পড়লে বুঝবেন) জলে কুমির ডাঙায় বাঘ (দি আল্টিমেট ব্যাটল, এবং রসুল চাচার ভাষায়, " এই লড়াইয়ে আবার হারজিত আছে নাকি?") বাদাবনের কুমির (আরেক অদ্ভুত শিকার, মুখে গরান গাছের গুঁড়ি গুঁজে দিয়ে!) কুমির কান্ড (বলদ বাঁধার দড়িতে জুড়ে কুমিরকে গ্রাম ঘুরানো। গল্পটার সাথে নির্বেদ রায় রচিত 'জান্তব' এর 'আশ্চর্য নরখাদক' গল্পের মিল আছে। যদিও সেটা ফ্লোরিডার এলিগেটর নিয়ে।)
৩. বাদাবনের খেটে খাওয়া হতদরিদ্র মানুষ, যাদের জীবনে শুধু বাঘ কুমির নয়, অভিশাপ হয়ে আছে সুদখোর রক্তচোষা মহাজন আর নিষ্ঠুর ডাকাতের দল - তাদের জীবন নিয়েও লিখেছেন শিশির বিশ্বাস। বিশেষ করে 'বাদাবনের বিপদ' এরকমই এক দুধর্ষ ডাকাতের খপ্পরে পড়ে বেঁচে ফিরার অভিযান নিয়ে লেখা। বাঘ কুমিরের চাইতেও এই গল্পটা আমায় বেশি টেনেছে।
এছাড়াও আছে এক অকুতোভয় কিশোরকে নিয়ে লেখা 'অর্জুন সর্দার' ও বাঘের হাতে সন্তান হারানো দুর্ভাগা 'বিমল বাউলে' র গল্পও৷ লেখক বাদার অকুতোভয় মানুষের আদলেই বৈকুন্ঠ বাউলে, শ্রীনাথ বাউলে, রসুল মিয়া - ইত্যাদি চরিত্রের রূপায়ণ করেছেন। দীর্ঘদিনের বাদাভাঙা অভিজ্ঞতা যাকে বলে। এসকল মানুষ কুমিরভরা পানিতে ঝাঁপিয়ে অতিথিকে উদ্ধার করে আনে, নরখাদক বাঘের সামনে দাঁড়িয়ে সমানে হুংকার ছাড়ে - সম্বল হয়তো একটা লাঠি কিংবা দা, বাঘের মুখে মশাল গুঁজে দেয় কিংবা হেঁতাল- সঙ্গীকে রেখে পিছ ফিরে পালায়না। আবার এই মানুষগুলোই মহাজনের হাতে ভিটেমাটি বন্ধক রেখে সর্বস্বান্ত হয়। ডাকাতের পাল্লায় পড়ে হারায় ধার করা নৌকা জাল মাছ সব। বনবিবির পূজা দিয়েও রক্ষা পায়না বাঘের কবল থেকে। হতভাগ্যদের শেষ সাক্ষী হিসেবে রয়ে যায় দ্বীপ দ্বীপান্তরে উড়তে থাকা এক ফালি ময়লা কাপড়।
৪. শিশির বিশ্বাস সুন্দরবনের রঙ্গমঞ্চ ছাড়িয়ে তার গল্পের সংগ্রহকে আরো অনেকদূর নিয়ে গেছেন। এর মাঝে আছে লেখকের প্রকাশিত প্রথম গল্প - সনাতন শিকারি। এক আদিবাসী যুবক উড়িষ্যার সিমলিপাল অরণ্যে কিভাবে তীর ধনুক সম্বল করেই দুর্দান্ত বাঘের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলো তার গল্প। ভালুক নিয়ে দুটো গল্প আছে। 'ভজনের কপাল' ও 'বনের মানুষ'। 'রয়্যাল বেঙ্গলের মুখোমুখি' দন্ডকারণ্যে দুই অফিসারের সরাসরি বাঘের মুখোমুখি পড়ার কাহিনী। রাতের বেলা গাড়ি চালিয়ে ফেরার পথে নিঃসাড় অরণ্যে সদ্য সম্বর শিকার করে খেতে বসা বাঘের সামনে পড়ে যান তারা। বেশ ভালো লেগেছে এই গল্পটা।
এছাড়াও গা ছমছমে ভৌতিক একটি গল্প -'ভূতের চর।' একদম দুধর্ষ লেভেলের না হলেও গা শিউরে ওঠার মত গল্প এটি, পটভূমি সুন্দরবন।
সব মিলিয়ে বইটির তেইশটি গল্পই স্ব গুণে গুণান্বিত। শিশির বিশ্বাসের সবচে বড় গুণ হলো তিনি গল্প গুলো কোথাও বেশি টানেননি, আবার সংক্ষেপও করেননি। ঠিক কোথায় গিয়ে থামতে হবে জানেন। বর্ণনার পর বর্ণনা দিয়ে পাঠককে বিরক্ত করেননি। তিন চার পাতার গল্প - এতেই সব রহস্য রোমাঞ্চ ঠিকঠাক চলে এসেছে। আর প্রচুর বাদাবন ঘুরার ফলে তাঁর অভিজ্ঞতাও ভালো। তাই বনের পরিবেশকে ঠিকঠাক রিপ্রেজেন্ট করতে পেরেছেন।
'জল জঙ্গল নরখাদক সমগ্র প্রথম খন্ড' - শিশির বিশ্বাস, মায়াকানন। রেটিং ৫/৫।