প্রাচীন ঘড়ি। একটি বইয়ের নাম। কবিতার বই। কবিতার উপজীব্য গ্রাম, গ্রামের মেঠো পথ, ধান-ছোলা-সরিয়ার সবুজ-হলুদ ক্ষেত, খাল, বর্ষার ভরা গাঙ, নদী, গ্রামীন জীবন। ষড়ঋতুর রংরসের বৈচিত্র্যে ভরা গ্রামের মানুষের উঠা-বসা, বলা-চলা, তাদের জীবনাচারণ। যে গ্রামে আমরা বেড়ে উঠেছি মায়ের আদরে শাসনে, সে গ্রাম আমাদের অন্য মা। কবিতায় সে ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। কবিতায় প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আহবান, মহান মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃনা, মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান ক্যান্টনমেন্টে আটকে পড়া বাঙালি সৈনিকদের কষ্টের কথা (আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় ছিলেন, স্বাধীনতা প্রায় আড়াই বছর পর দেশে ফিরে আসেন)। পরিবার, সমাজের নানা সংগতি-অসংগতি, সাম্প্রতিক মহামারী, নানা ঘটনার সমাহারে কবিতা লেখা হয়েছে। যিনি কবিতাগুলো লিখেছেন, তিনি প্রতিটি ঘটনা শুধু প্রত্যক্ষ করেননি, তাঁর বোধ, চিন্তা, চেতনায় তা লালন করেছেন। একাডেমিক সনদ না থাকলেও তিনি কখনো সংকোচে ম্রিয়মান থাকেননি। কারণ তিনি তো পড়তেন। পড়তেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস। একজন বইপ্রেমী মানুষ হিসেবে তাঁর উপলব্ধি আর দশজনের চেয়ে কিছুটা আলাদাই ছিলো। তবে সেটি কর্মব্যস্ত জীবনে প্রকাশ পায়নি। কর্মজীবীদের যেমন অবসর কাল আছে, যারা গেরস্থ ঘর সামলান, তাঁদের জীবনেও একসময় অবসর কাল আসে। তখন ছেলেমেয়ে সংসার সামলানোর ঝামেলা কমে যায়। এমন একটি সময়ে “প্রাচীন ঘড়ি”তে প্রকাশিত কবিতাগুলো লেখা হয়েছে। কবিতার বইটা হাতে নিতেই এক শিহরণ। মনে হলো পাটখড়ির বেড়া দিয়ে ঘেরা এক প্রশস্ত উঠানে আমি দাঁড়িয়ে, নাকি কাঁচা-মিঠালো আম গাছের নিচে, নাকি লম্বা হালটটাতে, নাকি ভরাবর্ষায় বাড়ির কাছে আসা পানিতে সাঁতার কাটছি, নাকি বই বুকে চেপে স্কুলে যাচ্ছি ভাইবোনদের সাথে। আসলে কবিতাগুলো লেখা হয়েছে এমন সব শব্দে, যেগুলো পড়লে ঐ সময়কার ছবিটিই ভেসে উঠবে চোখে। যিনি লিখেছেন তাঁর মুন্সীয়ানা এখানে, তিনি কোন শব্দকে সাহেবী বা পোশাকী রূপ দেননি। প্রতিটি শব্দ, ঘটনা এক একটি সময়কে উল্লেখ করে। যাঁর কথা বলছি তিনি আমার মা। আমি তাঁর আত্মজা। মায়ের চিন্তা, চেতনা, মননে বেড়ে ওঠা আমাদের ছয় ভাইবোনের। এক সময়ের ব্যস্ত জীবনের নানা অনুসঙ্গ তিনি স্মৃতিতে রেখেছিলেন অনেক যত্নে, ভোলেননি। সেগুলোকে শব্দের অলংকারে গেঁথেছেন কবিতায়। মাকে কিভাবে বর্ণনা করবো। মেয়ের বর্ণনায় মা নয়। একজন পাঠক হিসেবে চেষ্টা করেছি কবি এবং কবিতাগুলোকে আপনাদের সামনে তুলে ধরতে। আর একজনের কথা না বললেই নয়। যিনি প্রচ্ছদ করেছেন এবং কভার পেজে মাকে বর্ণনা করেছেন, তিনি আমার ছোট ভাই মামুন, ব্যাংক কর্মকর্তা। হাজারো ব্যস্ততার মাঝে মায়ের সৃষ্টিকে দুই মলাটে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। তাঁর আগ্রহ আর প্রচেষ্টার কারণেই মায়ের লেখা কবিতা নিয়ে বই প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। ছোট ভাই মামুন আর চাচাতো ভাই আলমগীর টুলু, সহযোগী অধ্যাপক (বাংলা বিভাগ), ঢাকা কলেজ অনেক যত্নে প্রুফ দেখেছেন। মায়ের লেখা কবিতা নিয়ে বই প্রকাশ করবো, বিষয়টি নিয়ে ভাইবোনেরা সবাই excited ছিলাম। বই বের হলো মেলার শেষ দিন। মেলায় না মিললেও আমাদের আনন্দ বই প্রকাশে। সে আনন্দ সবার সাথে শেয়ার করলাম। করোনার এই মহামারীতে সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, সবাই নিরাপদে থাকি।