"স্মৃতির জানালায়" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ ‘স্মৃতির জানালায়’ আমি আমার জীবনের কথা বলার চেষ্টা করেছি। ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে ছড়িয়ে আছে আমার জীবন। আমি আমার জীবনের শুরুতে পিতামাতার প্রথম সন্তান হিসাবে দাদা-দাদির আদরে ও বাবা-মায়ের শাসন ও স্নেহে সমৃদ্ধ হয়েছি। ছোটবেলায় ছিলাম গরুর রাখাল। ধরলা নদীর তীরে ছিল আমাদের বাড়ি। আমাদের গোয়াল ভরা ত্রিশ-চল্লিশটা গরু ছিল। পাঁচ-ছয়টা গাভীর দুধে ভরা থাকত দুধের হাড়ি। ধরলার একটি শাখা নদী আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিক দিয়ে গিতালদহের ছড়া থেকে বর্ষাকালে প্রবাহিত হত। বড় ধরলা ও শাখানদীর মাঝে ছিল বিশাল চর। তাতে ফুটতো কাশফুল, ঝাঁউফুল ও নানা ধরনের ঘাসফুল। এলুয়া, কাশিয়ার ফুল, নদী হইছে হুলস্থুল। এলুয়া ফুটিল আইল্ বান, কাশিয়া ফুটিল্ গেইল বান্'- স্থানীয় প্রবাদ। গরুর লেজ ধরে আমরা ছোট নদী পার হয়ে চরে গরু চরাতাম। বান, ধান, আর গান এ তিন নিয়ে ছিল ধরলাপারের মানুষের জীবন। অতি বন্যা হলে মংগা লাগত। তখন মানুষের বিশেষতঃ ভূমিহীন মজুরদের কষ্টের সীমা থাকত না। এখনও সে মংগা মাঝে মাঝে হানা দেয় অতি বন্যায়। বাল্যকালে আমাকে বাবা-মায়ের সাথে সংসারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হত। বাবার সাথে থেকে সকল রকমের কৃষিকাজ করতাম। বাবা বলতেন, “কোন কাজ শুরু করার আগে ভয় পেলে চলবে না। প্রথমে লক্ষ্য স্থির করতে হবে কাজের অর্ধেককে। অর্ধেকটা হয়ে গেলে কাজটা ভয় পায়। তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। কর্মীর জয় হবেই।' তাই কাজকে আমি কখনও ভয় পাই নাই। বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান হিসাবে মায়ের কাজেও সাহায্য করতাম। বিশেষ করে গৃহস্থালী ও রান্না-বান্নার কাজে। তার রান্নার যে সব পদ্ধতি সে সময়ে দেখেছিলাম তা পরবর্তীকালে সিডনী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কাজে লেগেছিল। প্রায় আড়াই বছর নিজে হাতে রান্না করে খেয়েছি। এবং অন্যকে খাইয়েছি। যারা খেয়েছে তারা প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। একবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (প্রশাসন) সিরাজ উদ্দীন সাহেব সিডনীতে আমার অতিথি হন। তাঁকে গরুর গোশত দিয়ে ভাত খাওয়াই। সে খুব খুশি। এরপর দেশে কোথাও দেখা হলেই বলত, 'আহা, আপনার গরুর গোশতের স্বাদের কথা জীবনে ভুলতে পারব না!"