সবার চোখ যেখানে গিয়ে থামে, সেখান থেকে শুরু হয় কবির দৃষ্টিপথ। এ কারণেই কবিরা দ্রষ্টা। তৃতীয় নয়নেও কবি অনেক কিছু দেখেন। দেখার মৌলিকত্বে পূর্বজ ও সমকালীন কবিদের থেকে নিজেকে আলাদা করেন। নতুনত্বের দাবি মেটাতে পূর্বাপরে নিজেকেও নিজের থেকে আলাদা করতে হয় কবিকে। পুনঃপুন নবায়নে আমৃত্যু থাকতে হয় চিরনবীন। আর, কবিমাত্রই শব্দের নদীতে স্বপ্নের ধীবর। কবির স্বপ্নের বিস্তার তার কবিতা। কারও কবিতায় যদি 'শরীর যাবে না ছোঁয়া দেখো দৃষ্টিসুখ' বা 'বাদামে খোসার মন্ত্র, স্বপ্নজালে পলির রোপণ'-এর মতো ব্যঞ্জনাদীপ্ত পঙক্তির দেখা মেলে, ভিড়-কোলাহল উজিয়ে তাকে আলিঙ্গনে নিতে ভুল করে না অগ্রসর পাঠক। নিলয় রফিকের 'আঁখিআঁকা আদিনাথ' এমন অনেক পঙ্ক্তিতে ঋদ্ধ একটি কবিতাগ্রন্থ। নিলয় রফিকের জন্ম ও শৈশব উপকূলবর্তী জনপদ মহেশখালীতে। সেখানে জীবন ও মৃত্যু হাত ধরাধরি করে চলে। অন্যদিকে, চিরকালের শৈশব কবিদের চিরবর্তমান ঠিকানা। শৈশব সুবাদে নিলয় রফিকের কবিতা দিগন্তবিস্তারী নোনাজীবনের প্রতিনিধি। 'ডকে দেখি কারুকাজ, পিতার সৌরভ', অথবা 'নিসর্গশহরে ঘূর্ণি, বায়ুচাপে ঝড়ের আকাশ' কিংবা 'উড়ে যায় পাতাঘর করুণ সময়' বা 'অনাহারে দিনলিপি ঝড়ের মৌসুম'-এর মতো রূপক-চিত্রকল্প সেই স্বেদগন্ধা নোনাজীবনের নির্মেদ ভাষ্যকার। নিলয়ের কবিতায় চিরকালের সত্য ও সুন্দর জলের ভুবনে মাছের মতো সাবলীল। তার কবিতা চিরবঞ্চিত বৃহত্তরের পক্ষে কথা বলে। 'রৌদ্রেঘামে চকচকে অম্লান সুরত', 'সামনে আগুনশিখা কাঠের সেলাই', 'ভয়াবহ দিনলিপি মানুষের মুখ'- এর মতো পঙক্তি সমূহ এ সাক্ষ্যই দেয়। 'আঁখিআঁকা আদিনাথ' নিলয় রফিকের পঞ্চম কবিতাগ্রন্থ।এ বইয়ের অধিকাংশ কবিতা বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে লেখা। তাই 'আষাঢ়ি প্রথম দিনে বর্ষাফুলে বৃষ্টির প্রার্থনা'র মতো স্নিগ্ধ চিত্রকল্পের পাশে 'স্বপ্নগুলো গৃহবন্দি সবুজ আঁধারে'র মতো পঙ্ক্তিও চোখে পড়ে। এ বইয়ে বেশ কিছু চতুর্দশপদী কবিতা আছে। ইংরেজ কবি ম্যাকলিশ মনে করতেন, 'কবিতা কিছু বোঝায় না; হয়ে ওঠে।' ম্যাকলিশের এই কালজয়ী পঙ্ক্তি সুবাদে বলা যায়- হাইকু না চতুর্দশপদী, নাকি চৌপদী- সেই বিভাজন গৌণ; কবিতার কবিতা-হয়ে-ওঠা'ই বড়ো কথা। নিলয় রফিকের 'আঁখিআঁকা আদিনাথ' সেই 'হয়ে-ওঠা'র একবই নমুনা। যার বই তার ভাষায়- 'শব্দপোড়া স্বপ্নখামে, পৃষ্ঠাভরা আকাশে ঠিকানা।'