বিশ্ব চিত্রকলার ইতিহাস বিষয়ক পুস্তক শিল্প শিক্ষার্থীদের আবশ্যিক পাঠ হলেও সাধারণ শিল্পপ্রেমী, দর্শক, গ্যালারি কর্মী, ও শিল্পাগ্রহীদের জন্য সেসব বোধকরি বরাবরই জটিল পাঠ হয়ে থেকেছে। শিল্পায়োজনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বিস্তার গড়পড়তা পাঠকদের কতটা আগ্রহী করেছে তা নিঃসন্দেহে বিচার্য। রিয়েলিস্টিক, অ্যাবস্ট্রাক্ট, কিউবিজম, সুররিয়েলিজম, পপ, ইনস্টলেশন আর্টের জনপ্রিয়তার বাইরে বহুবিধ শিল্প প্রবণতার যে অনুশীলন হয়েছে শতাব্দী ধরে, এই পুস্তকে বিন্যাসিত হয়েছে সেসব স্বল্পালোচিত আন্দোলন-তত্তে¡র কথাও। সেসব শিল্পচর্চার নানা ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের সমস্যা এবং কখনো পরিচালকের ভূমিকা পালনের কথা, একটি সংক্ষিপ্তসার, যা সেসব অতীত সময়কে বিচার্য। এই পুস্তকটিকে শতাব্দীর শিল্প ধারাক্রমের তথ্যবহুল সংক্ষিপ্ত সারগ্রন্থ বলা যায়। যা জটিল শিল্প সমালোচনামূলক গ্রন্থ না হয়ে বরং আনকোরা শিল্প উৎসাহীদের ও শিল্পানুভ‚তি তৈরির চালিকাশক্তি হিসেবে এবং সমকালীন শিল্পকলা চর্চার প্রেক্ষিত বিবেচনার সহায়ক হতে পারে। পৃথিবীব্যাপী শিল্প তাত্তি¡ককেরা তাদের মতো করে শিল্প ইতিহাস ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে চলেছেন। বিশিষ্ট চিন্তার আলোকে তাদের সেসব কাজ নতুন মাত্রা যোগ করছে। কিন্তু এরই পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ বলে শব্দিত নয় এমন শিল্পভাবুক শিল্পদর্শন তথা ক্রমবিকাশের নানা রহস্যের কথা জানাতে চান। এমনই একজন শিল্পী শফিকুল কবীর চন্দন। বলা বাহুল্য তিনি শিল্প ইতিহাস পরিক্রমার দিকে সবিস্ময়ে তাকিয়ে চেয়েছেন কীভাবে বিশেষজ্ঞতার কঠিন-কঠোর দিদৃক্ষার পথে না গিয়ে সেসব শিল্পভাষার নিজস্ব চালচলনের গতিপ্রকৃতিকে সকলের নজরে আনা যায়। বলা বাহুল্য ‘শিল্পদর্শন’ সেসব আলেখ্যেরই ধারক। আলোচ্য গ্রন্থটিতে নানা তত্ত¡ ও তথ্যকে এক স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে বেঁধেছেন লেখক। কাঠিন্য কমই নজরে আসে। কঠিন কথা একবারে নেই তা নয়, কিন্তু প্রকাশের ভঙ্গিমার গুণে তা সুবোধ্য ও সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। নতুন কথা আছে বিস্তর। বিশেষত বাংলা ভাষায় অনালোচিত একবারে হালনাগাদ পাশ্চাত্যে চর্চিত শিল্প প্রবণতাসমূহের সতেজ উপস্থাপন আকর্ষণীয়। পুরোনো কথাও আছে যা তাঁর প্রকাশ গুণে নতুনের দীপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সত্যি বলতে কী, শিল্প ভাষা-ইশতাহার-তত্ত¡-তথ্য-আন্দোলন-প্রকরণ-প্রবণতা-ঘরানা সম্পর্কে চেনাজানার ব্যাপারে এই বইটি আমাদের অনেকখানি বন্ধুর কাজ করবে।
স্কুলশিক্ষক বাবা ও গৃহকত্রী মায়ের চতুর্থ সন্তান। ছােটবেলায় দেখা ‘মা’ আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন সর্ববিশারদ, যার শিল্পসুষমা ছিল বিচিত্র কারুবাসনা ঘিরে। একদিন মায়ের শস্য ও কারুবাসনার সংসার থেকে ‘বিদ্যাবাসনার নিমিত্তে ঘর ছাড়তে হলাে নাবালক বয়সে অবধারিত বিপত্তি এড়িয়ে, ডিঙিয়ে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক, পথেঘাটে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা গ্রহণ। কলাভবন, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন, ভারত থেকে তন্তুকলা তথা বয়নচিত্র ও ভাস্কর্য (ট্যাপেস্ট্রি ও ফাইবার স্কাল্পচার) বিষয়ে স্নাতকোত্তর। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেছেন কয়েক বছর। বাংলার চারু-কারু অনুষঙ্গ নিয়ে তাঁর নিত্যভাবনার পাঁচালি, যার মধ্যে বাংলার বয়ন ও কারিগর পেশার অন্ত্যজদের নিয়ে সুলুকসন্ধানে বিশেষ উৎসাহী। ফলে এ সংক্রান্ত নিরন্তর গবেষণা লেখালেখি । তচর্চা, সন্তানদ্বয় ‘বয়ন’ ও ‘বৈভব’-এর যত্ন-আত্তি আর ‘টানাপােড়েন’ সংগত করা তাঁর নৈমিত্তিকযাপন নৈবেদ্যস্বরূপ। দীর্ঘ অভিবাসী জীবনে জীবিকার জন্য সার্বক্ষণিক তন্তুশিল্পী হিসাবে ‘তকাজে ব্যাপৃত থাকলেও পড়া-লেখালেখির নিমিত্তে অসংখ্য শব্দরাশি নিয়ে নিত্যদিনের কাটাকুটি। লেখেন মূলত শিল্পকলা বিষয়ে, তবে সংখ্যায় বেজায় কম চিন্তায় কোনাে গুরুনির্দেশ বা বিধিবিধান খাটে না। সঠিক মাত্রায় বাঁধবার আয়াসে বরং বােধ ও প্রাণের ফজিলত শিল্পায়তে নাজিল হয়। প্রকাশিত পুস্তকাদি ‘শিল্পমনীষা’ (২০০১), ‘তদ্ভুকলা ও ট্যাপেস্ট্রি’ (২০০৪), ‘পরনকথা নগরদাইর’, ‘ভিঞ্চি নােটস্’, ‘শিল্পদর্শন’ (২০১০), তন্তুবায় স্বরূপ সন্ধান (২০১৪), ‘মানুষ ভজে রং তুলিতে, ‘শিল্পবয়ান' (২০১৯)। ফসলের আদিম শরীর থেকে বুনাে আমােদে গন্ধ-ছডানাে আরণ্যক গ্রাম বুকে নিয়ে পথিবীর নানা শহরে-গঞ্জে পিঠ ঠেকিয়েছেন বিবিধ ওসিলায়। গত দেড়দশক ধরে শিল্পী শফিকুল কবীর চন্দন ইউরােপ-অভিবাসী। দীর্ঘ একটা সময় কেটেছে উত্তর-ইতালির মিলান শহরে। সার্বক্ষণিক তন্তুশিল্পী হিসাবে বর্তমানে ইংল্যান্ডের লাফবরা শহরে স্ত্রী ও দুই পুত্রসন্তান নিয়ে বসবাস। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের বয়ন ঐতিহ্যের প্রাণভূমি নরসিংদী জেলার এক ছােট সবুজ গ্রামে একদা জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছেলেটি আজ পাশ্চাত্যে তাঁতে পােড়েনের রঙে, নকশায়, বুননে হাজির করে স্মৃতি ছবির মগ্নতা।