‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে নারী,’ নারী সম্পর্কে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও স্মরণীয়তম এ-মন্তব্যটি সিমোন দ্য বোভোয়ারের, যিনি শুধু বিশশতকের নয়, চিরকালের শ্রেষ্ঠ নারীদের, অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ মানুষদের, একজন। ফরাসি ঔপন্যাসিক, দার্শনিক, ও প্রাবন্ধিক সিমোন দ্য বোভোয়ারের মহত্তম গ্রন্থ ল্য দ্যজিয়েম সেক্স, ইংরেজিতে যা বিশ্ববিখ্যাত দ্য সেকেন্ড সেক্স নামে, বাঙলায় দ্বিতীয় লিঙ্গ। নারীবাদের জননী মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট ছিলেন নারীমুক্তির জোয়ার অফ আর্ক, আর সিমোন দ্য বোভোয়ার নারীবাদের আইনস্টাইন। সভ্যতাব্যাপী নারীর পরিস্থিতি সম্পর্কে এমন অসাধারণ গ্রন্থ আর লেখা হয়নি, সম্ভাবনাও নেই, অদ্বিতীয় এ-গ্রন্থ; প্রাজ্ঞ ও শিল্পিতার অনন্য নিদর্শন দ্য বোভোয়ারের দ্বিতীয় লিঙ্গ, যার পাতা থেকে বেরিয়ে এসেছে বিশশতকের দ্বিতীয়াংশের নারীবাদ, এবং পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতাকে বদলে দিয়েছে নানাভাবে। অবিবাহিত, সন্তানহীন, জা-পল সার্ত্রের আমরণ বান্ধবী হিসেবে কিংবদন্তি, যদিও অন্য প্রেমের কাছেও ধরা দিয়েছেন তিনি মাঝেমাঝে, দ্য বোভোয়ার গণ্য হয়ে থাকেন আধুনিক নারীবাদের জননীরূপে, যার কাছে ঋণী আমরা সবাই। তাঁর মহাগ্রন্থটি বাঙলায় অনুবাদ হয়নি, এ-দুরূহ জটিল বিস্ময়কর গ্রন্থের মুখোমুখি দাঁড়ানো কঠিন; এবং এ-কাজটি করেছেন হুমায়ুন আজাদ, যিনি তাঁর নারী নামকি এক সময় নিষিদ্ধ বইটির জন্যে হয়ে উঠেছেন বাঙলায় নারীবাদের প্রধান প্রবক্তা। হুমায়ুন আজাদ অসাধারণ গদ্যে প্রকাশ করেছেন মূল গ্রন্থের জ্ঞান ও সৌন্দর্য, যা বাঙলার পাঠকদের কাছে এক অলৌকিক বিস্ময় বলে মনে হবে।
প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত অভীষ্ট এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার মাধ্যমে ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারের বিরুদ্ধে কলম তুলে নিয়ে বিশেষভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ। প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক এই লেখক একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, গবেষক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, ভাষাবিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক। বাবা-মায়ের বড় সন্তান হুমায়ুন আজাদ ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে রাঢ়িখাল গ্রামে, যার কথা পরবর্তীতে তাঁর বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে উঠে এসেছে। ম্যাট্রিকুলেশন ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। হুমায়ুন আজাদ এর বই সমূহ নারীবাদকে তুলে ধরেছে ও ধর্মীয় মৌলবাদের প্রবল বিরোধিতা করেছে, যার ফলে তিনি একশ্রেণীর মানুষের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদ এর বই এর মধ্যে 'পাক সার জমিন সাদ বাদ', 'সব কিছু ভেঙে পড়ে', 'ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল' ইত্যাদি উপন্যাস ও 'অলৌকিক স্টিমার', 'জ্বলো চিতাবাঘ', 'কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু' ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। হুমায়ুন আজাদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'নারী' প্রবন্ধটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা একসময় নিষিদ্ধ হয়েছিল এই দেশে। প্রতিভাবান এই সাহিত্যিক ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক' সহ আরো অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন হুমায়ুন আজাদ।