হ-য-ব-র-ল আর আবোল-তাবোল-এর অনাবিল হাস্যোচ্ছ্বাস নিয়েই আমরা চমৎকৃত আছি। কিন্তু গদ্যেপদ্যে সেইসব অভাবনীয় অসংলগ্নতার কারিগর সুকুমার রায় ছিলেন বিজ্ঞানের একজন খুবই মেধাবী ছাত্র। বিজ্ঞানবুদ্ধি এবং সাহিত্যবোধ-দুয়ের মিলনে ব্যঙ্গরসিকতার উৎকৃষ্ট গল্পকবিতা ছাড়া, তিনি কয়েকটি মূল্যবান প্রবন্ধও লিখেছিলেন। একদিকে যেমন চিন্তার বাহন ভাষার সঙ্গে চিন্তার যোগ, শিল্পে-ধর্মে-বিজ্ঞানে চিরন্তন জিজ্ঞাসা, বিজ্ঞান আর দৈবের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি গুরুতর বিষয়ের আলোচনা আছে, তেমনি শিল্পে অত্যুক্তির স্থান কিংবা ভারতীয় চিত্রশিল্পের বৈশিষ্ট্য নিয়েও তিনি চিন্তিত। ভাবে ভাষায় মিলে প্রবন্ধগুলিতে যে আশ্চর্য আধুনিকতা আছে, পাঠককে তা পুনরায় এই স্মরণীয় লেখক সম্পর্কে চমৎকৃত করবে। বর্ণমালাতত্ত্ব নামে ছন্দোবদ্ধ একটি অসমাপ্ত প্রবন্ধ এবং তাঁর দুটি ইংরেজি রচনাও এই সংকলনের অন্তর্গত হয়েছে। গ্রন্থাকারে এইসব রচনা এই প্রথম প্রকাশিত হলো। আমরা যে সুকুমার রায়কে চিনি, তার থেকে সম্পূর্ণ অন্য অনন্য এক সুকুমার রায় ধরা পড়েন এই বইটিতে। এই লেখাগুলো প্রকাশ পেয়েছিল প্রবাসী, ল-ন থেকে প্রকাশিত ‘কোয়েস্ট’ প্রভৃতি পত্রিকায়। এই বইটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৫৬ সালে সিগনেট প্রেস থেকে। ৬৫ বছর পর সেই বইটি পূর্বাপর চেহারায় কবি প্রকাশনী থেকে পুনরায় প্রকাশিত হলো।
উপেন্দ্ৰকিশোর রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ সুকুমারের জন্ম ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে। ১৯০৬-এ পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন দুই বিষয়েই অনার্স নিয়ে বি.এসসি পাশ করার পর ১৯১১-য় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গুরুপ্ৰসন্ন ঘোষ বৃত্তি লাভ করে মুদ্রণ বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তিনি বিলেতে যান। লন্ডনে ও ম্যাঞ্চেস্টারে অধ্যয়ন করেন তিনি ও তাঁর গবেষণার জন্য সম্মানিত হন। ১৯১৩-য় উপেন্দ্ৰকিশোরের সম্পাদনায় ছোটদের সচিত্ৰ মাসিক পত্রিকা সন্দেশ’’ প্রকাশিত হয়। সুকুমার দেশে ফেরারী কিছুকাল পরে ১৯১৫-য় উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। সুকুমার ইউ রায় অ্যান্ড সন্স কার্যালয়ের পরিচালনার এবং “সন্দেশ’ সম্পাদনার দায়িত্ব গ্ৰহণ করেন। “সন্দেশ’-এর পাতাতেই তাঁর অধিকাংশ ছোটদের লেখা-গল্প, কবিতা, প্ৰবন্ধ, ধাঁধা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। শুধু নিজের লেখা নয়, ছবি এঁকেছেন তিনি। “হ য ব র ল’, ‘আবোল তাবোল’ জাতীয় আজগুবি চালের বেঠিক বেতাল ভুলের ভবের গদ্য ও পদ্য রচনা ছাড়াও শিল্প সাহিত্য ভাষা ধর্ম বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়ক গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও সক্রিয় ছিল তাঁর লেখনী। আড়াই বছর কালাজ্বরে ভুগে ১৯২৩-এ মাত্র ৩৬ বছর বয়সে সুকুমার রায় ১০০ গড়পার রোডের বাড়িতে পরলোকগমন করেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও তিনি শুয়ে শুয়ে সন্দেশের জন্য ছবি এঁকেছেন, প্রচ্ছদ রচনা করেছেন, গল্প কবিতা লিখেছেন। আবোল তাবোল’-এর ডামি কপিাটাও রোগশয্যায় তৈরি করেছেন। কিন্তু বইটি ছেপে বেরোবার ন” দিন আগে তাঁর মৃত্যু হয়।