উনিশ শ' একাত্তর বাঙ্গালির পরম প্রাপ্তির বছর। এ বছরের ১৬ই ডিসেম্বর যুদ্ধ শেষে শ্রেষ্ঠ অর্জন আমরা লাভ করি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাড়িয়ে মনে হয় সে যেন রুপকথার সাগর পাড়ি দিয়ে একটি নতুন দেশ আমরা লাভ করেছিলাম। তার নায়ক ছিলেন দুই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠবাঙালি শেখ মুজিব। তার অনুসারী ও সহযোদ্ধা ছিলাম আমরা, বাংলার নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ। যারা হাজার হাজার বছর ধরে সংগ্রাম করেছেন, শাসকদের হাতে বলি হয়েছেন, কিন্তু নিজস্ব কওমের স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বঙ্গভুমির এই অংশের শেখ মুজিবই। আর সেই স্বরাজ আন্দোলন- সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ভারত, রাশিয়া, ভূটান সহ স্বাধীনতাকামী মানুষ ও মানবতাবাদী বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো। সেই একাত্তরের এখন মনে হয় জোছনা রাতের স্বপ্ন। আমাদের স্বপ্নের নায়ককে বন্দি করে রেখেছিল পাকিরা। তার দোষ বাপদাদাদের আনা পাকি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন নতুন রাষ্ট্র কায়েমের লক্ষে। তিনি দেশের মানুষকে সেই সাতচল্লিশ থেকে সুপথে চলার পথ দেখিয়েছেন। এই লোকটি ভারতের চর, দুই পাকিস্তান ভাঙ্গার অগ্রদূত। ঢোকাও জেলখানায়। যুদ্ধ এবং প্রতিরোধের প্রথম দিনই তাকে পাকিরা জেলখানায় নিয়ে গেল। আমরাও তার নির্দেশমতো দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য সেই অসম লড়াইয়ে অংশ নিলাম। দখলদার পাকিবাহিনি ১৯৫৮ সালে পাকাপাকিভাবে দখল নিয়েছিল। অবশ্য শুরুটা অবৈধভাবে সেই সাতচল্লিশে। প্রায় এক বছর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থায় ছিলেন বাঙ্গালির মনোনীত ব্যক্তিরা। কিন্তু সামরিক শাসক ইস্কান্দার মির্জা সেই যে ক্ষমতা দখল করল, তা চলল আইয়ুব খান ইয়াহিয়া হয়ে- এ অংশে নিয়াজি পর্যন্ত। তবে বাঙ্গালির সকল সংগ্রাম ও আন্দলনের চূড়ান্ত পরিনতি ঘটে একাত্তরে। যা ধাপে ধাপে বিকাশ ঘটিয়েছিলেন বাঙ্গালির স্বাধীনতার মহাপুরুষ শেখ মুজিব। সেই পাকি স্বাধীনতার লগ্নে অর্থাৎ ৪৭-এর পূর্বে যখন পাকি- রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পাকিরা এদেশে বাঙ্গালিদের হত্যা শুরু করে, তখনই বুঝতে পারেন ৪৭-এর স্বাধীনতা ভুয়া দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ধর্ম কখনো একটি আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে পারে না। তাই তিনি আটচল্লিশে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিদের বিরুদ্ধে প্রথম মাঠে নামলেন তমদ্দুন মজলিশের আবুল কাশেমসহ ছাত্রলীগ, রেলওয়ে স্রমিক ইউনিয়নের লোকজন নিয়ে। মুজিব সেই যাত্রায় ‘উত্তম মধ্যম’ খেয়ে ভাষা আন্দোলন তুঙ্গে ওঠালেন। আবার তিনদিন জেলেও থাকতে হল। বায়ান্নতেও তাই। তারপর তার ভাষণের বিপ্লবী জাগরন, আন্দোলন, সংগ্রাম এবং পাশাপাশি পাকিদের জেলে ১৩/১৪ বছর বসবাস। চূড়ান্ত নির্বাচনে কোটলিপারা- গোপালগঞ্জ থেকে প্রথম বিজয়, ৬৬ সালে ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন বা স্বায়ত্ত শাসনের লক্ষে ৬ দফা ঘোষণা এবং এরই প্রেক্ষিতে আগরতলা ষড়যন্ত্রমুলক মামলাও ৬৯ সালে গনঅভুত্থান। ৭০-এর নির্বাচনে পাকিতে বাঙালি বিপুল বিজয়, ৭১- এর অসহযোগ আন্দোলন ও স্বাধীনতার ঘোষণা এবং দখলদার হঠানোর লক্ষে বাঙালির সর্বশেষ মরণপণ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কোণো স্বাধীনতাকামী বাঙালী ঘরে থাকতে পারেনি। ১৯৭১-এর পঁচিশে মার্চ থেকেই পাকি সৈন্যরা সমগ্র পূর্ববাংলায় বাঙালি নিধনে নেমে পড়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করে। লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে ধরে নিয়ে যায় সেনা ছাউনিতে। লুটে তাদের সম্ভ্রম আর ১ কোটি মানুষ ঘড়-বাড়ী ছেড়ে আশ্রয় নেয় পাশের রাষ্ট্র ভারতের ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, কলকাতা, বিহার ও অন্য প্রদেশগুলোয়। এই সময় ত্রিপুরা, আসাম, কলকাতার মানুষ ৪৭-এর হিন্দু নির্যাতন ভুলে আমাদের আশ্রয় দেয়। এ সময় ভারতের জনগণ নিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়ালেন একাত্তরের মিত্রমাতা ইন্দিরা গান্ধী। তিনি তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ইন্দিরা গান্ধী রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে। তার দাদা প্রখ্যাত রাজনীতিক মতিলাল নেহরু, বাবা পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু এবং মা ও ফুফুরাও ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেত্রী। সেই ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব বাংলায় মানবতার বিপর্যয় দেখে এবং পাকি সৈন্যের গণহত্যার খবর শুনে তিনি- • ২৭শে মার্চ লোকসভায় আমাদের সমর্থনে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। • ৩১শে মার্চ সহানুভূতি জানিয়ে সংসদে প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। • ৯ই আগস্ট রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদন করেন। • ১৫ই আগস্ট মুজিবের গোপন বিচার সম্পর্কে পৃথিবীর রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে তারবার্তা পাঠান। • ৩০শে সেপ্টেম্বর ব্রেজনেভ, পদগর্নি ও কোসিগিনের সঙ্গে আলোচনা করেন। • ৩১শে অক্টোবর লন্ডনে যুক্তরাজ্যেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন • ৪ঠা নভেম্বর বাংললাদেশের প্রতি সহানুভূতির জন্য নিক্সন প্রদত্ত সভায় ভাষণ দেন। • ১০ই নভেম্বর জার্মানির রাষ্ট্রপ্রধান উইলির সঙ্গে আলোচনা করেন। • ২৭শে নভেম্বর মুজিবের মুক্তির জন্য ইয়াহিয়াকে আহ্বান জানান। • ৩রা ডিসেম্বর কলকাতার বিশাল জনসভায় বাংলাদেশকে পুনরায় সমর্থন জানান। • ৪ঠা ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আক্রমণ চালায়। • ৬ই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতির ঘোষণা দেন। • ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় নিয়াজি বিনা শর্তে আত্মসমর্পন করে। • ৭ই জানুয়ারি ১৯৭২ ভারত থেকে শরণার্থী ফেরত পাঠানো শুরু হয়। • ৮ই জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি লাভ। • ১০ই জানুয়ারি দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান সাক্ষাৎ করেন। অতপর বঙ্গবন্ধু স্বদেশ ফিরে আসেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরিপূর্ণতা পায় ১০ই জানুয়ারি। একাত্তরের সেই সব কাহিনি প্রথম আমরা দেখতে পাই একটি গ্রন্থে। সেই গ্রন্থটির নাম জয় ইন্দিরা জয় মুজিব। তখন মুক্তিযুদ্ধের কোনো গ্রন্থ রচিত হয়নি। সংবাদিকবৃন্দ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যুদ্ধদিনের চিত্র তাদের স্মৃতিকথায় ফুটিয়ে তোলেন। এক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন পত্রিকা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ভাবলে অবাক হতে হয়, যুদ্ধের রেশ তখনো শেষ হয়নি। ঠিক সেই সময় আত্মসমর্পণের দু-মাসের মধ্যেই দোল পূর্ণিমায় এই ঐতিহাসিক বইটি প্রকাশ করে কলকাতায় ৩৩ কলেজ স্ট্রিটের সাহিত্য মন্দির। বইটির শুরু ১৯৭১-এর ৬ই ডিসেম্বর ভারত যেদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় সেই দিনের ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে। এরপর ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত একটানা ঘটনার বিবরণ। শেষটা ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ ফেরা। মাঝে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ও আন্দোলনের কাহিনি এবং ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশের জন্য কর্মতৎপরতা। গ্রন্থটিতে আরো রয়েছে তৎকালীন বৈশ্বিক চিত্র। রয়েছে চীন-মার্কিনিদের যুদ্ধের অপতৎপরতা। "জয় ইন্দিরা জয় মুজিব"ই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রকাশিত ঐতিহাসিক গ্রন্থ। মনোহর সাহিত্য মন্দিরই প্রথম আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাস। স্বাধীনতার সুবর্ণ-জয়ন্তীতে আকাশ প্রকাশনা সংস্থা একাত্তরের মতো আমাদের মিত্ররাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বইটি ছেপে একটি জাতীয় দায়িত্ব পালন করল। এজন্য আকাশ-এর স্বত্বাধিকারী আলমগীর সিকদার লোটনকে অজস্র ধন্যবাদ। বইটি বিবরণদর্শী হলেও ইতিহাসের সোপানগুলো তৈরিতে এ ধরনের গ্রন্থ রচনায় সহায়তা করেছে। বইটিতে বেশকিছু তথ্য বিভ্রাট ছিল। আমি এগুলো যত্নসহকারে সংশোদন করে দিয়েছি। খুব সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রকাশিত আকর গ্রন্থ হিসেবে জয় ইন্দিরা জয় মুজিব-এর অবদান কোনো দিন ম্লান হবার নয়। বইটি ছদ্মনামে প্রকাশিত হলেও সপ্তবহ্নি আমাদেরই লোক। তাঁকে অজস্রবার ধন্যবাদ জানাই। সদ্য শমুক্ত বাংলাদেশের নতুন বছর ছিল বায়াত্তর। আর সেই বায়াত্তরের মার্চে প্রকাশিত বইটির মূল্য আজও অমলিন। তখন শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন আমাদের স্ট্যাচু। আমরা তাঁদের সম্পর্কে কতটুকুই জানতাম। কিন্তু সে-সময় বইটি আমাদের অনেকের জানাই ইচ্ছেটা পূরণ করেছিল। স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তীতে নতুন প্রজন্মের অতীত ইতিহাস জানার ইচ্ছেও পূরণ করবে প্রায় অর্ধশতাব্দী বছর আগে প্রকাশিত জয় ইন্দিরা জয় মুজিব ঐতিহাসিক গ্রন্থটি। জয়বাংলা। খালেক বিন জয়েনউদদীন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ফেলো, ২০২১ বাংলা একাডেমি, ঢাকা