বাঙলায় মুসলমান সমাজের প্রগতি ও উন্নতির সোপান হিসাবে লর্ড কার্জন যখন ১৯০৫ সালে বঙ্গ-বিভাগের পরিকল্পনা করেছিলেন তখন হিন্দু নেতারা তাতে বাধা দিয়ে মুসলমানদের স্বেচ্ছামতো উন্নতির পথটি বন্ধ করবার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং ইংরেজ সরকার হিন্দু নেতাদের সেই দাবি মেনে নিয়ে পরে কার্জনের পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়েছিলেন। ১৯৪৬-এর ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনায় মুসলমান-প্রধান প্রদেশগুলিকে কার্যত স্বাধীন করে দেওয়া হয়। অবশ্য এই ব্যবস্থায় হিন্দু-প্রধান প্রদেশগুলিও প্রায় স্বাধীন হয়ে উঠতো। কিন্তু কংগ্রেস নেতারা প্রদেশগুলির প্রায়-স্বাধীন হওয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। কিন্তু মুসলমানরা আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার বহুদিন থেকে দাবি করছিলেন। তারা দেখলো এর ফলে চিরদিনের জন্য কেন্দ্রের হিন্দু রাজত্বের অধীন হয়ে যেতে হবে। সেই অধীনতার অবস্থা মুসলমান-প্রধান প্রদেশগুলি মেনে নিতে রাজি হলো না। তারা তখন মুসলমান-প্রধান প্রদেশগুলি নিয়ে এক স্বাধীন রাজ্য পাকিস্তানের দাবি নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠলো। ভারত-বিভাগ সহজেই এড়ানো যেতো যদি কংগ্রেস নেতারা মুসলিম-প্রধান প্রদেশগুলিতে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা চালু রাখতে রাজি হতেন এবং হিন্দু-প্রধান প্রদেশগুলিকে নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো শাসন-ব্যবস্থা প্রচলিত করতে চাইতেন। মুসলমান যেমন হিন্দু-প্রধান কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকতে রাজি হয়নি তেমনি বাঙালি হিন্দুরা ও পাঞ্জাবের শিখেরা মুসলমান-প্রধান সরকারের অধীনে থাকতে অস্বীকার করলো। ফলে, বাঙলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করে এই সমস্যার সমাধান করতে হলো। এখানে মনে রাখা দরকার যে মুসলমানরা কেউই বাংলাকে ভাগ করতে চায়নি এবং হিন্দুরা প্রত্যেকেই বাংলা ভাগ চেয়েছিল। ভারত-ভাগে সহায়তা করার জন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাধারণভবে হিন্দুদের যে একটা প্রচন্ড ক্ষোভ ছিল পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র বলে ঘোষিত হওয়ায় এবং পাকিস্তান থেকে বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সংখ্যালঘু হিন্দুরা চলে আসতে থাকায়, সেই ক্ষোভ দিনে দিনে গভীরতর হয়েছে। এই চাপা ক্ষোভকে মূলধন করে এখন কোনো কোনো রাজনৈতিক দল প্রকাশ্য মুসলিম-বিদ্বেষে ইন্ধন জোগাচ্ছে। পাকিস্তানে এবং ভারতবর্ষে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যে একদিন বিপাকে পড়তে পারে তারই সম্ভাবনা বিবেচনা করে দূরদর্শী নেতা মুহম্মদ আলি জিন্নাহ বহুদিন আগে চেয়েছিলেন পারস্পরিক লোক বিনিময় করে পাকিস্তানকে একটা পূর্ণাঙ্গ মুসলিম রাষ্ট্রে এবং ভারতকে একটি পূর্ণাঙ্গ হিন্দু রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করা হোক। তখন জিন্নাহর কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। কিন্তু এখন ভারতের এক বিশাল সংখ্যক মুসলমানকে যদি হিন্দু বিদ্বেষের শিকার হয়ে পড়ে থাকতে হয় তার ফলাফল খুব উদ্বেগজনক হতে বাধ্য। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল যে এই মুসলিম-বিদ্বেষকে মূলধন করে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে তাতে ভারতের ভবিষ্যৎ নিঃসন্দেহে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠবে।
দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল ও শ্রীমতী হেমন্তকুমারী শাসমলের একমাত্র পুত্র বিমলানন্দ শাসমল মেদিনীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৪ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি কলকাতায় গান্ধিজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে গান্ধিজি তাকে বলেছিলেন, "You have to carry on the work of your father." ছাত্রাবস্থায় তিনি পিতৃহীন হন। ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৪৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দুর্ভিক্ষপীড়িতদের মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য লেখক ভারতরক্ষা আইনে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৯৪৫-এ তিনি সোদপুরে খাদি প্রতিষ্ঠানে গান্ধিজির অবস্থানকালে তাঁর শিবিরে সংবাদপত্র জগতে যোগাযোগকারী কর্মী হিসেবে কাজ করতে থাকেন। এই সময় তিনি গান্ধি শান্তি সেবাদল নামে এক অহিংস কর্মীদল গঠন করেন। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় তিনি গুরুতরভাবে আহত হয়ে সাতাশ দিন অজ্ঞান অবস্থায় পি. জি. হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তখনকার রাজনীতি ছিল পঙ্কিলতায় ভরা, এই ধারণায় লেখক স্বাধীনতার পর থেকে রাজনীতি-জগৎ থেকে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। লেখক প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “বেদান্ত দর্শন ও বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিক সূত্র” এই বিষয়ের উপর ফরাসি ভাষায় ডক্টরেট হন এবং ফ্রান্সের জাতীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিষদ থেকে স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। লেখকের সংক্ষিপ্ত ভাষ্য রেডিওযোগে সমগ্র ইউরোপে প্রচারও করা হয়েছিল এবং বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আলবার্ট সোয়াইৎযার তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। লেখক আইন পাশ করেন এবং বিভিন্ন কলেজ যেমন- সুরেন্দ্রনাথ, সিটি কমার্স, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী প্রভৃতি কলেজে অধ্যাপনা করেন। সমাজসেবার কাজেও লেখক অগ্রণী ছিলেন। বছর খানেক মাদার টেরিজার সঙ্গে কুষ্ঠরোগীদের সেবাও করেছেন। এ ছাড়া অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য হিসাবে বিভিন্ন দেশের অত্যাচারিত ও নিপীড়তদের পক্ষ নিয়ে অনেক তদবির করেছেন। কিছুদিন আগে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির বন্দীদের স্বপক্ষে আবেদন জানালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার সহানুভূতির সাথে বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছিলেন। মেদিনীপুরের সেন্ট্রাল জেলে তিরিশ জন তফসিলি জাতির বন্দীদের জন্য প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের কাছে আবেদন করে মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। ছাত্রাবস্থায় লেখক তাঁর কাব্যগ্রন্থ “পতিতা” প্রকাশ করেন। তাঁর গদ্য-পদ্যের সংকলন “এসো রেণু” খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ১৯৬৮ সালে তিনি “লা ভেরীতে” (সত্য) নামে ইংরেজি সাপ্তাহিক কাগজও বের করনে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করে লেখক দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ওই রিপোর্টে বিধানচন্দ্র রায়সহ কয়েকজন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ হয়েছিল। লেখকের অনুপম অবদান প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইতিহাসের তথ্য ও তত্ত্ব সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক দলিল “স্বাধীনতার ফাঁকি”।